জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পাশাপাশি আটক সব শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিককে ছেড়ে দিতে ২ আগস্ট ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচিতে জড়ো হন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। সেদিন বিকেলে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর এই কর্মসূচির পাশাপাশি আরও একাধিক সংগঠন গণগ্রেপ্তার বন্ধ ও শিক্ষার্থী-জনতা হত্যার বিচারের দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হয়েছিলেন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের কর্মসূচির নাম ছিল ‘শিক্ষার্থী-জনতার শোকযাত্রা’।
এসব কর্মসূচি ঘিরে সেদিন (২ আগস্ট ২০২৪ সাল) দুপুরে প্রেসক্লাব এলাকায় জনতার ঢল নামে। লোকে লোকারণ্য প্রেসক্লাবের সামনে কোন সংগঠনের কী কর্মসূচি, তা আলাদা করার সুযোগ ছিল না। একপর্যায়ে পুরো প্রেসক্লাবের সামনের উপস্থিতি একক গণকর্মসূচিতে রূপ নেয়। এই কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বক্তব্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন।
সেদিন বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আনু মুহাম্মদ তাঁর বক্তব্য শেষ করে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে ‘দ্রোহযাত্রা’ শুরুর ঘোষণা দেন। সেখান থেকে কদম ফোয়ারা, হাইকোর্ট মোড়, দোয়েল চত্বর ও টিএসসি ঘুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যায় দ্রোহযাত্রা। শহীদ মিনারে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে প্রথমে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। ঠিক সেই সময় সরকারের পদত্যাগ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে হাজারো জনতা স্লোগান দিতে থাকেন। স্লোগান ওঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’, ‘খুনি সরকারের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে’।
‘দ্রোহযাত্রায়’ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্পী, আইনজীবী, উন্নয়নকর্মী, মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। এই কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
দ্রোহযাত্রার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণার পাশাপাশি শহীদ মিনার থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) তৎকালীন সভাপতি রাগীব নাঈম। কারফিউ প্রত্যাহার, গণগ্রেপ্তার বন্ধ, বন্দীদের মুক্তি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন তিনি।
দ্রোহযাত্রা কর্মসূচির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট। সে সময় এই জোটের সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন রাগীব নাঈম। সেই কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের গুলি-গণগ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে কারফিউ ভেঙে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছিল ছাত্রজোট। একপর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে একটি কর্মসূচি আয়োজনের চিন্তা মাথায় আসে। সেই চিন্তা থেকে ২৮, ২৯ ও ৩০ জুলাই বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, শিক্ষক নেটওয়ার্ক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, শ্রমিক ও নারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করি। মানুষকে সাহস দেওয়া এবং আরও মানুষকে যুক্ত করার জায়গা থেকে দ্রোহযাত্রার পরিকল্পনা হয়।’
শুরুতে এই কর্মসূচির নাম ‘শোকযাত্রা’ ঠিক করা হয় বলে জানান রাগীব নাঈম। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে কর্মসূচি ঘোষণার এক দিনের মাথায় নাম পরিবর্তন করে ‘দ্রোহযাত্রা’ করা হয়। এক-দুই হাজার মানুষের জমায়েতের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু দ্রোহযাত্রায় আসেন হাজার হাজার মানুষ। সেদিন শহীদ মিনারে বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা ছিলেন। সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তে বিপুল জনসমাবেশ থেকে তৎকালীন সরকারের পদত্যাগের দাবি ঘোষণা করা হয়।
‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচির পাশাপাশি ২ আগস্ট ঢাকার ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের সামনে ‘গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজ’ ব্যানারে ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদে শামিল হন শিল্পীরা। সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই এই সমাবেশ হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি২ আগস্ট সারা দেশে জুমার নামাজ শেষে দোয়া ও কবর জিয়ারতের আহ্বান জানিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। মন্দির ও গির্জাতেও প্রার্থনার আহ্বান ছিল। এ ছাড়া জুমার নামাজ শেষে ছাত্র-জনতার গণমিছিলের কর্মসূচিও ছিল সেদিন। এই কর্মসূচিকে ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের পাঁচ জেলায় সংঘর্ষ, ভাঙচুর, সংঘাত ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
ডিবি কার্যালয় থেকে ১ আগস্ট ছাড়া পাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুম ২ আগস্ট গণমাধ্যমে একটি যৌথ বিবৃতি পাঠান। এতে বলা হয়, আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা-সংক্রান্ত ডিবি কার্যালয় থেকে প্রচারিত ভিডিও বিবৃতিটি তাঁরা স্বেচ্ছায় দেননি।
আজ আবারও ‘দ্রোহযাত্রা’জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় সাড়া জাগানো প্রতিবাদী কর্মসূচি ‘দ্রোহযাত্রার’ বর্ষপূর্তি আজ শনিবার। ‘ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর বিলোপ, চব্বিশের গণহত্যাসহ পাহাড় ও সমতলের সব গণহত্যার বিচার এবং নব্য ফ্যাসিবাদী প্রবণতা প্রতিহতের প্রতিবাদে’ আজ বেলা সাড়ে তিনটায় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘শিক্ষার্থী–শ্রমিক–জনতার দ্রোহযাত্রা’ ডাকা হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, যিনি গত বছরের দ্রোহাযাত্রায়ও সভাপতিত্ব করেছিলেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র পদত য গ ২ আগস ট স গঠন র জনত র
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ