জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সংলাপে সংস্কা‌র কমিশনগুলোর অধিকাংশ প্রস্তা‌বের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছে এ রাজনৈতিক দলটি। কিছু বিষয়ে দ্বিমত জানানো হয়েছে এবং কিছু বিষয়ে নতুন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।

বুধবার (৭ মে) জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে এ সংলাপ হয়। এতে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমাদ। প্রতিনিধিদলে ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন ও অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম ও অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ, সহকারী মহাসচিব মাওলানা সৈয়দ এসহাক মুহাম্মাদ আবুল খায়ের, প্রচার সম্পাদক শেখ ফজলুল করীম মারুফ, আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শওকত আলী হাওলাদার, রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট হাফেজ মাওলানা হাসিবুর রহমান এবং দপ্তর সম্পাদক মাওলানা লোকমান হোসেন জাফরী।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে নেতৃত্ব দেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এ সময় বদিউল আলম মজুমদার, ড.

ইফতেখারুজ্জামানসহ কমিশনের অন্যান্য সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

সংবিধান সংস্কারে যেসব প্রস্তাব দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ

১. সংবিধানের মূলনীতিতে প্রস্তাবিত ‘বহুত্ববাদ’ বাদ দিয়ে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করতে হবে।

২. প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনে নারীদের জন্য কোটা ব্যবস্থা তাদের জন্য অসম্মানজনক। এজন্য সকল পর্যায়ের নির্বাচনে নারী-পুরুষ সবাই সমান সুযোগ নিয়ে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

৩. রাষ্ট্রপতিও সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। সর্বোচ্চ দুই বার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

৪. একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ প্রধান ও দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না। দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।

৫. আইনসভা ভেঙে যাওয়ার পর বা মেয়াদ শেষে অন্তবর্তী সরকার নয়, বরং নির্বাচনকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে। যেহেতু, তাদের প্রধান কাজ হবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করা।

নির্বাচন কমিশন সংস্কার নিয়ে যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে

১. স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। নিজস্ব জনবল এবং আর্থিক স্বাধীনতা থাকতে হবে।

২. নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

৩. নির্বাচনকালীন সরকারের সময়কালে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের সকল নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। বিশেষ করে, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে হবে।

৪. সংসদের উচ্চকক্ষ এবং নিম্নকক্ষের সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। কোথাও কোনো কোটা থাকবে না।

৫. স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান ও মেয়র বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন। প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে নয়।

বিচার বিভাগ সংস্কারে যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে

১. বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে কার্যকরভাবে স্বাধীন থাকবে। বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় থাকবে।

২. সকল পর্যায়ে আলাদা শরিয়া আদালত স্থাপন করতে হবে এবং মুসলমানদের বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার এবং পারিবারিক অন্যান্য বিষয়ে সুষ্ঠু বিচারের জন্য অভিজ্ঞ ইসলামী স্কলার নিয়োগ দিতে হবে।

৩. রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলেই কাউকে সাধারণ ক্ষমা করতে পারবেন না। এটাকেও একটি স্বচ্ছ নিয়মের আওতায় আনতে হবে।

জনপ্রশাসন সংস্কারে যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে
১. অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট-১৯২৩ বাতিল করতে হবে। ঔপনিবেশিক আমলের এ আইন সাধারণ নাগরিকদের জন্য অমর্যাদাকর।

২. যেহেতু বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা এবং স্বাধীন; অতএব জেলা প্রশাসককে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। জেলাগুলোতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আছে।

৩. প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা যাবে না।

৪. জেলা পরিষদ বাতিল না করে বরং তা আরো কার্যকর করতে হবে এবং জনগণের সরাসরি ভোটে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে
দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে।

পুলিশ সংস্কার বিষয়ে কমিশনের ১৫টি প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হ‌য়ে‌ছে ইসলামী আন্দোলন। তার সঙ্গে আরো নয়টি প্রস্তাব দি‌য়ে‌ছে দল‌টি।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/রফিক

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ঐকমত য র জন য প রব ন ইসল ম সরক র ন করত

এছাড়াও পড়ুন:

পাথর তোলায় রাজনৈতিক দলের ‘ঐকমত্য’, পরে লুট, ঘটল কীভাবে

বড় পাথর, মাঝারি পাথর, ছোট পাথর। তার মধ্য দিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলধারা। সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের সেটাই ছিল আকর্ষণ। পর্যটকেরা গিয়ে পাথরের ওপর বসতেন, ছবি তুলতেন।

অবশ্য এখন তা অতীত। চার মাস ধরে লুট করা হয়েছে সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথর। এই লুটের কথা সবাই জানত। কারণ, দিনদুপুরে চলেছে লুটপাট। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসন কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু তা জোরালো ছিল না। ফলে পাথর লুট ঠেকানো যায়নি।

সরেজমিনে গত মঙ্গলবার দেখা যায়, সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রে যেখানে বড় বড় পাথর ছিল, সেখানে এখন গর্ত। সব জায়গায় পাথর তুলে নেওয়ার চিহ্ন। প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর লুট করা হয়েছে। ফলে সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে। কমেছে পর্যটকের সংখ্যা।

বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ থাকলেও পাথর উত্তোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নেতাদের মধ্যে ঐকমত্য ছিল। কারণ, পাথর উত্তোলন, পরিবহন, মজুত রাখা, ভাঙা ও বিক্রির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

স্থানীয় প্রশাসনও পাথর উত্তোলনের পক্ষে সম্প্রতি মত দিয়েছে। কিন্তু সরকার সাড়া দেয়নি। পরে হয় শুরু গণলুট। লুটের জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদেরই দায়ী করছেন পরিবেশকর্মীরা। প্রথম আলোর অনুসন্ধানেও তাঁদের নাম এসেছে। কেউ কেউ আত্মগোপনেও চলে গেছেন।

পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেটের সদস্যসচিব আবদুল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পাথর লুট ঠেকাতে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। এর সঙ্গে প্রকাশ্যে ও গোপনে জড়িত রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারা। তিনি বলেন, বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতারা যেভাবে সভা-সমাবেশে কোয়ারি চালুর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন, এটা দুঃখজনক। পাথর লুটের দায় এসব নেতা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

পাথর উত্তোলনে ‘ঐকমত্য’

সারা দেশে ৫১টি কোয়ারি (পাথর, বালু ইত্যাদি উত্তোলনের নির্দিষ্ট স্থান) রয়েছে। এর মধ্যে সিলেটের কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে রয়েছে আটটি পাথর কোয়ারি। এর বাইরে সিলেটে আরও ১০টি জায়গায় পাথর রয়েছে। যেমন সাদাপাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি ও উৎমাছড়া। এসব জায়গা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

পাথর আসে সীমান্তের ওপারে ভারতের পাহাড়ি নদী থেকে। বহু বছর ধরে পানির স্রোতের সঙ্গে এসব পাথর এসে কোয়ারি তৈরি হয়েছে। ২০২০ সালের আগে সংরক্ষিত এলাকা বাদে সিলেটের আটটি কোয়ারি ইজারা দিয়ে পাথর উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হতো। তবে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির কারণে ২০২০ সালের পর আর পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়া হয়নি।

বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতারা যেভাবে সভা-সমাবেশে কোয়ারি চালুর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন, এটা দুঃখজনক। পাথর লুটের দায় এসব নেতা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেটের সদস্যসচিব আবদুল করিম চৌধুরী

উল্লেখ্য, জাফলং (জাফলং-ডাউকি নদী) পরিবেশ অধিদপ্তর ঘোষিত প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)। জাফলংসহ অন্যান্য এলাকা থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হলে পরিবেশ আইনে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আবার খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইনেও এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

দেশের নির্মাণ খাতে পাথরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশ থেকে প্রায় ৯৫ লাখ মেট্রিক টন পাথর আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা, যার দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। দেশের নির্মাণ খাতে পাথরের চাহিদার বড় অংশ আমদানি করে মেটানো হয়। বাকিটা চাহিদার বেশির ভাগ পূরণ হয় দিনাজপুরের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প ও সিলেট থেকে উত্তোলন করা পাথর দিয়ে।

সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের আগের অবস্থা। ছবিটি গত ৩০ এপ্রিল তোলা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঐকমত‍্য কমিটি গঠনের পর
  • আইনে যা-ই থাকুক, প্রাধান্য পাবে জুলাই সনদের প্রস্তাব
  • পাথর তোলায় রাজনৈতিক দলের ‘ঐকমত্য’, পরে লুট, ঘটল কীভাবে
  • নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার সুযোগ নিতে পারে পতিত ফ্যাসিস্ট
  • বাংলাদেশের ‘তরুণকম্পের’ সম্ভাবনা ও ঝুঁকি