তরুণ প্রজন্মই তামাক কোম্পানির প্রধান লক্ষ্য। এক প্রজন্মের তামাকসেবী যখন মৃত্যুবরণ করে কিংবা ঘাতক ব্যাধির প্রকোপে তামাক সেবন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই তামাক কোম্পানির জন্য তখন নতুন প্রজন্মের তামাকসেবী তৈরি করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মোহনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে যে শিশু বা কিশোর-কিশোরী আজ ঠোঁটে তামাকপণ্য তুলে নিচ্ছে, কাল সে-ই পরিণত হচ্ছে তামাক কোম্পানির আমৃত্যু ভোক্তায়। গবেষণায় জানা গেছে, বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। বিপুল মৃত্যু এবং ব্যাধির উৎসমূল হওয়া সত্ত্বেও নানা ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করে তামাক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণ, কার্যকর কর ও মূল্য পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ রোধে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আর্টিক্যাল ৫.

৩ বাস্তবায়নের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসকে সামনে রেখে বুধবার প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং এন্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স-আত্মা আয়োজিত ভার্চুয়াল সভায় এসব বিষয় উঠে আসে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি’।

ভার্চুয়াল সভায় জানানো হয়, বাংলাদেশে তারুণ্যই তামাক কোম্পানির আগ্রাসী বিজ্ঞাপনের প্রধান লক্ষ্য। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ২০১৬ সালের গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় বিদ্যালয়ের ১০০ মিটার ব্যাসার্ধ এলাকার মধ্যে অবস্থিত ৫০৭টি মুদি দোকানের ৪৮৭টিতেই চকলেট, ক্যান্ডি, কোমল পানীয় ইত্যাদির পাশেই তামাকপণ্য প্রদর্শন করা হয়েছে, যা শিশুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভার্চুয়াল সভায় আরও জানানো হয়, নিকোটিনযুক্ত প্রাণঘাতি পণ্যে আকৃষ্ট করতে নানা কারসাজির আশ্রয় নেয় কোম্পানিগুলো। স্কুলপড়ুয়া শিশুদের আকৃষ্ট করতে বাবলগাম, চেরি, চকলেট ইত্যাদি সুগন্ধীর ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং পণ্য বাজারজাত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, এসব পণ্যে ১৬ হাজারের বেশি সুগন্ধি ব্যবহার করছে তামাক কোম্পানিগুলো। ইউএসবি স্টিক, ক্যান্ডি, কলমসহ বিভিন্ন পণ্যের আদলে আকর্ষণীয় ডিজাইনে বাজারজাত করা হচ্ছে এসব পণ্য।

সভায় তরুণ প্রজন্ম সুরক্ষায় তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত করার দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের নিম্ন এবং মধ্যম স্তরকে একত্রিত করে মূল্যস্তরের সংখ্যা ৪টি থেকে ৩টিতে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহার, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা থেকে সিগারেট বাদ দেওয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তামাক ও নিকোটিন পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচার ও বাজারজাতকরণ বন্ধ করার দাবি জানানো হয়।

আত্মা’র সহ-আহ্বায়ক নাদিরা কিরণের সঞ্চালনায় ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে মূল উপস্থাপনা তুলে ধরেন প্রজ্ঞা’র হেড অব প্রোগ্রামস হাসান শাহরিয়ার। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. অনুপম হোসেন, বিসিআইসি এর সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোস্তাফিজুর রহমান, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের (এনটিসিসি) সাবেক সমন্বয়কারী মুহাম্মাদ রূহুল কুদ্দুস, ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক সাইফুদ্দিন আহমেদ, নারী মৈত্রী’র নির্বাহী পরিচালক শাহীন আকতার ডলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক, গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ, প্রত্যাশা’র সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমেদ, এইড ফাউন্ডেশনের প্রকল্প পরিচালক শাগুফতা সুলতানা, আত্মা’র আহ্বায়ক মর্তুজা হায়দার লিটন ও সহ-আহ্বায়ক মিজান চৌধুরী এবং প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের।
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রজন ম পর চ ল

এছাড়াও পড়ুন:

চার মাসেও তালা খোলেনি বেগম রোকেয়া টেকনিক্যাল কলেজের

চার মাস আগে সুপারের বিরুদ্ধে নিয়োগবাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হয়েছে। সত্যতাও পাওয়া গেছে। কিন্তু তালা খোলা হয়নি। দীর্ঘদিন লেখাপড়া থেকে দূরে থাকায় ৩৫০ শিক্ষার্থীর জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মিঠাপুকুর উপজেলার বড় হযরতপুর ইউনিয়নের নানকর বেগম রোকেয়া টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজে এ ঘটনা ঘটেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, ভুক্তভোগীরা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন চার মাস আগে। এক শিক্ষক বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগও দিয়েছেন। তদন্ত চলছে। সব ঠিক আছে। প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ থাকবে? কেন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠান চালু রাখার ব্যবস্থা করেনি? আমাদের সন্তানদের জীবন থেকে চার মাস চলে গেলে এ দায় কার? এসব প্রশ্নের জবাব আমরা কার কাছে পাব? 
মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল মমিন মণ্ডল বলেন, তদন্তে অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে। সুপারের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এতদিনেও কেন প্রতিষ্ঠানের তালা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হলো না জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেননি এ কর্মকর্তা। এক পর্যায়ে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। 
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সুপার জাহিদুল ইসলাম। চাকরি না পেয়ে ভুক্তভোগীরা চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি সুপারের কার্যালয় ও শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন। এরপর থেকে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। সুপারও পাওনাদারের চাপের মুখে প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন না। অন্য শিক্ষকেরা মাঝেমধ্যে অফিসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে চলে যান। 
নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাব্বি মিয়া ও দ্বাদশ শ্রেণির জেসমিন খাতুন জানায়, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলছে। শিক্ষকরাও আসেন না। বছরের প্রায় অর্ধেক চলে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে পড়ালেখার কী হবে? তারা এর সমাধান চায়। 
একাদশের নয়ণ চন্দ্র বর্মণ আক্ষেপ করে বলে, ‘সুপারের কারণে আজ আমাদের এ অবস্থা। তার অপরাধের শাস্তি পাচ্ছি আমরা। কর্তৃপক্ষ কেন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে না বুঝতে পারছি না। এভাবে কতদিন আমাদের পড়ালেখা বন্ধ থাকবে?’ 
জানা গেছে, জাহিদুল ইসলাম ২০১৮ সালে যোগদান করেন। এরপর থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে স্থানীয় বেকার যুবকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। অনেককে ভুয়া নিয়োগপত্রও দিয়েছেন। ভর্তি ও ফরম পূরণ ফি বাবদ আদায় করা ৩০ লাখ টাকা, রিজার্ভ ও জেনারেল তহবিলের লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়াও নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। প্রতিনিয়ত লোকজন প্রতিষ্ঠানে এসে টাকার জন্য তাঁকে চাপ দিচ্ছিলেন। পাওনাদারের চাপের মুখে সুপার ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রতিষ্ঠানে আসছেন না। 
ভুক্তভোগী শাহীন মিয়া জানান, ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে নৈশপ্রহরী পদে লোক চেয়ে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সুপার তাঁকে চাকরি দেবেন বলে জানান। বিনিময়ে ৭ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। জমি বিক্রি করে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা সুপারকে দেন। নিয়োগপত্র নিয়ে যোগদান করতে গেলে জানতে পারেন সেটি ভুয়া। টাকা ফেরত চাইলে টালবাহানা শুরু করেন সুপার। 
একই ঘটনা ঘটেছে স্থানীয় আব্দুল মোত্তালিবের ক্ষেত্রেও। চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাঁর কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেন সুপার। কিন্তু, চাকরি দেননি। টাকাও ফেরত দেননি। আব্দুল মোত্তালিব বলেন, ‘মুই গরিব মানুষ। কোনোমতে বউ ছইলোক নিয়া করি খাও। চাকরি দিবার চায়া মোর কাছে জাহিদুল সুপার দেড় লাখ টাকা নেচে। চাকরিও দেয় নাই, ট্যাকাও দেওচে না। মুই এর বিচার চাও।’
এদিকে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে টাকা আত্মসাৎ, ভর্তি ও ফরম পূরণের টাকা আত্মসাৎ, দিনের পর দিন প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিতসহ ৮টি অভিযোগ এনে শিক্ষক প্রতিনিধি শরিফুল ইসলাম ইউএনওসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল মমিন মণ্ডল তদন্ত করেছেন। তিনি গত ১৫ এপ্রিল ইউএনওর কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও এখনও পর্যন্ত সুপারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 
অভিযোগের বিষয়ে সুপার জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের ৮০ ভাগই মিথ্যা। সত্য হলো কয়েকজনের কাছে টাকা ধার নিয়েছিলাম। দ্রুত পরিশোধ করব। কাউকে ভুয়া নিয়োগপত্র দিইনি।’ লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের বিষয়ে বলেন, ‘একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে। তাদের কারণে প্রতিষ্ঠানে যেতে পারছি না। সব ঝামেলা মিটিয়ে শিগগিরই প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত হবো।’
ইউএনওর (অতিরিক্ত) দায়িত্বে থাকা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুলতামিস বিল্লাহ্ বলেন, ‘শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেব।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ