চট্টগ্রামের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ সেন্ট প্লাসিডস স্কুলের মাঠে নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে। পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর স্থানীয় অধিবাসী, ক্রীড়ামোদী ও সচেতন মানুষ উদ্বিগ্ন ও হতাশ হয়েছেন।

১৮৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের প্রথম ইংরেজি মাধ্যমের এ স্কুলটি এখন কলেজে উন্নীত হয়েছে। এর জন্য নতুন ভবনের প্রয়োজন। কিন্তু মাঠ নিশ্চিহ্ন করে ভবন তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণযোগ্য নয় বলে চট্টগ্রামের প্রবীণ ক্রীড়াবিদ ও বিভিন্ন ক্লাবের কর্মকর্তাদের অভিমত।

এলাকার তরুণেরা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা তাঁদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে ভবন নির্মাণের প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে ফেলছেন তাঁরা।

প্রায় দুই শ বছর ধরে মাঠটি জমজমাট থাকত প্রতিদিন তরুণ খেলোয়াড়দের খেলাধুলায়। এই মাঠ থেকে উঠে এসেছে আবু তাহের পুতুর মতো দেশসেরা অনেক ফুটবলার। একটা সময় ফিরিঙ্গিবাজার ইয়ং স্টার ক্লাব, ইয়ং স্টার ব্লুজসহ পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গিবাজার ও আশপাশের অনেক ক্লাবের বিপুলসংখ্যক ফুটবলার এ মাঠেই অনুশীলন করত। আয়োজিত হতো নানা টুর্নামেন্ট। সকাল কিংবা বিকেল ফুটবলার, ক্রিকেটার, অ্যাথলেটরা এখানে প্র্যাকটিস করত। সেই সব মুখর দিনগুলো এখন শুধু ইতিহাস হয়ে থাকবে। এই ধূলিধূসর, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, ইটপাথরের শহরে নিশ্বাস ফেলার জন্য একটু খোলা জায়গার জন্য হাহাকার চলছে, সেখানে একটি ঐতিহ্যবাহী মাঠকে এভাবে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা কীভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের! সেটা ভেবে অবাক হই।

চট্টগ্রাম শহরে একসময় লালদীঘি মাঠ, কলেজিয়েট স্কুল মাঠ, পলোগ্রাউন্ড, জাম্বুরি মাঠ, আউটার স্টেডিয়াম মাঠ, চট্টগ্রাম সরকারি স্কুলের মাঠ, প্যারেড মাঠ, শহীদ শাহজাহান মাঠ, সেন্ট প্লাসিডস স্কুলের মাঠ, নাসিরাবাদ স্কুল মাঠ, জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ মাঠ, হালিশহর আবাহনী মাঠ খেলাধুলা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাঠ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। তা ছাড়া ছোট–বড় আরও অনেক খেলার মাঠ ছিল, যা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। জাম্বুরি মাঠ হারিয়ে গেছে পার্কের নিচে। অথচ পার্কের চেয়ে মাঠের প্রয়োজনীয়তা কোনো অংশেই কম নয়। সেন্ট প্লাসিডস স্কুলের মাঠ চলে যাচ্ছে।

স্বাধীনতার পূর্ব সময়ে আউটার স্টেডিয়ামে অন্তত ৪টি ফুটবল ম্যাচ খেলার পরিসর ছিল। অর্থাৎ আটটি দলে ৮৮ জন খেলোয়াড় একত্রে অনুশীলন করতে পারত। পাশাপাশি ক্রিকেটও খেলা হতো। চট্টগ্রাম থেকে অনেক জাতীয় দলের খেলোয়াড়ের জন্ম হয়েছিল এই আউটার স্টেডিয়ামে। অথচ এই আউটার স্টেডিয়ামকে বারবার ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। একবার করেছে পিডিবি, তাদের পাওয়ার স্টেশন তৈরি করে। এরপর করেছে স্বয়ং চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (সিজেকেএস)। তারা প্রথমে দক্ষিণ–পূর্ব কোণে বিশাল এক মার্কেট নির্মাণ করে, এরপর পূর্ব দিকে মার্কেটের কাজ শুরু করে আউটার স্টেডিয়ামকে অবরুদ্ধ করে দেয়। সর্বশেষ এক-তৃতীয়াংশ জায়গায় নির্মিত হয়েছে সুইমিংপুল। চট্টগ্রামবাসীর বিরোধিতার মুখেও সুইমিংপুল নির্মাণ করে আউটার স্টেডিয়ামটি সংকুচিত করা হয়েছে। খেলাধুলার মাঠ ধ্বংস করার এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতা পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কি না জানি না।

আমরা লক্ষ করেছি যে, খেলার মাঠগুলোর কোনো কোনোটিতে বাণিজ্য মেলা, বৃক্ষমেলা, শিল্পমেলা, আমমেলা, বিজয় মেলা, স্বাধীনতা মেলা, বৈশাখী মেলা, তাঁতবস্ত্র মেলা, খাদ্য মেলা ইত্যাদি বিভিন্ন মৌসুমি মেলার কারণে খেলাধুলা বন্ধ প্রায়। মাঠে যখন মেলা হয়, তখন ইট–বালির কারণে ঘাস নষ্ট হয়। তখন আর খেলার পরিবেশ থাকে না। অথচ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথে রাখতে, মাদকসহ বিভিন্ন খারাপ অভ্যাস হতে মুক্ত রাখতে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নাই। কিন্তু মাঠ নিশ্চিহ্ন হতে থাকলে খেলবে কোথায়! এই চিন্তা কারও মাথায় আছে বলে মনে হয় না।

পুকুর/দিঘি আর খেলার মাঠ আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া অমূল্য সম্পদ, আর নগরবাসীর জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ। আমরা অর্বাচীনের মতো এমন মূল্যবান সম্পদকে ধ্বংস করছি অবলীলায়।

নগরে এখন মাত্র দুটি খেলার মাঠ আছে। একটি চকবাজারের প্যারেড মাঠ, অন্যটি কাজীর দেউড়ির সংকুচিত আউটার স্টেডিয়াম। আউটার স্টেডিয়ামে একসময় অনুশীলন করেছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, নুরুল আবেদীন নোবেল, আফতাব আহমেদ, তামিম ইকবাল। এখানেই খেলতেন ফুটবলার আশীষ ভদ্র, ইকবাল খান, দিলীপ বড়ুয়া, সুহাস বড়ুয়াসহ আরও অনেকে। দেশের দ্রুততম মানব অ্যাথলেট মোশাররফ হোসেন শামীমও অনুশীলন করতেন আউটার স্টেডিয়ামে। এদিকে আগ্রাবাদের জাম্বুরি মাঠ, লালদীঘি মাঠ, হালিশহরের চট্টগ্রাম আবাহনী মাঠ ও পলোগ্রাউন্ড, জমিয়তুল ফালাহ মাঠ, সিআরবি মাঠ সংরক্ষণ করার ফলে সেখানেও কমেছে খেলাধুলার সুযোগ।

১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মহাপরিকল্পনায় শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে মাথায় রেখে পুরো নগরের ১০ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত রাখার বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু তখন যতগুলো মাঠ ছিল, এখন তা–ও নেই। গত কয়েক দশকে নগরে জনসংখ্যা বাড়লেও খেলার স্থানগুলো এভাবে হারিয়ে যেতে বসায় চট্টগ্রাম থেকে আগের মতো খেলোয়াড় উঠে আসছে না। কিন্তু আমরা সবাই কেমন করে জানি মাঠবিমুখ হয়ে পড়েছি। এই মাঠবিমুখতা মানে আসলে জীবনবিমুখতা।

শিশু খেলবে, মাঠে দৌড়াবে, ঘুড়ি ওড়াবে, খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়াবে—এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এই নগরের শিশুদের আমরা সেই স্বাভাবিক জীবনটা দিতে পারছি না। এ কারণেই সে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে না। তাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম দুই–তিন ইঞ্চির মুঠোফোনের রঙিন মনিটর। সেখানেই সে সারা দিন ঝুঁকে ঝুঁকে খেলছে, মগ্ন থাকছে, কারও সঙ্গে কথা বলছে না, কারও দিকে তাকাচ্ছে না। দুনিয়ার কোথায় কী হচ্ছে, কারও দিকে তার খেয়াল নেই। ক্রমে অসামাজিক ও একধরনের অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশুরা। এই সব শিশুর কাঁধে আসুন একবার হাত রাখি, বলি, চলো, আকাশটা একটু দেখি, নাটাইটা হাতে নিয়ে ঘুড়িটা ওড়াতে শিখি।

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আউট র স ট ড য় ম ফ টবল র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

রাজকীয় ভোজে ট্রাম্প–মেলানিয়াকে কী কী খাওয়ালেন রাজা চার্লস

জমকালো সাজে সেজেছে যুক্তরাজ্যের উইন্ডসর ক্যাসলের সেন্ট জর্জেস হল। উপলক্ষটাও অনন্য, রাজকীয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সস্ত্রীক যুক্তরাজ্য সফর উপলক্ষে এখানে রাজকীয় নৈশ্যভোজ আয়োজন করেন রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি ক্যামিলা।

বুধবার রাতের রাজকীয় এ আয়োজনে কূটনীতি, খাবার, ঐতিহ্য, সংগীত আর আভিজাত্য একসুতোয় বাঁধা পড়েছিল। ট্রাম্প–মেলানিয়াসহ রাজার অতিথি হয়েছিলেন বিশ্বের ১৬০ জন গণমান্য ব্যক্তি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্মানে রাজা তৃতীয় চার্লসের আয়োজন করা রাজকীয় ভোজের টেবিল। যুক্তরাজ্যের উইন্ডসর ক্যাসলের সেন্ট জর্জেস হল, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ