সিলেট থেকে এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারবাহী ট্রাক নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন চালক মো. রাসেল মিয়া। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্বরোডের খাঁটিহাতা মোড়ে এসে তিনি পৌঁছান বেলা ৩টার দিকে। বিকেল ৫টা পর্যন্ত ওই জায়গা থেকে নড়তে পারেননি। এই মহাসড়কে গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর দুর্ভোগে পড়েছেন চালক-যাত্রীরা।
ভুক্তভোগী, পুলিশ ও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া স্থলবন্দর সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ চলছে। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ চালু রাখতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়নি। যে কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অনেক জায়গায় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। টানা বর্ষণে এসব গর্ত আরও বড় হয়েছে। একই সঙ্গে নিয়ম লঙ্ঘন করে চালকরা ওভারটেক করতে গিয়ে যানজট পাকিয়ে ফেলছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্বরোডের ব্যবসায়ী জুনায়েদুল হক (৬০) বলেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এখানে কোনো বাস-ট্রাক এক ফুটও নড়েনি। যানজট নিয়ন্ত্রণে আসা পুলিশ সদস্যদের চালকরা পাত্তাই দিতে চান না। ভাঙাচোরা সড়কে চালকরা কে কার আগে যাবেন– এমন প্রতিযোগিতাই যানজটের মূল কারণ।’
বেলা আড়াইটার দিকে ভৈরবে অবস্থিত সড়ক সেতুর টোল প্লাজায় কথা হয় ট্রাকচালক কাজিম আলীর সঙ্গে। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সিলেট যাচ্ছিলেন। তিনি এখানে পৌঁছান দুপুর ১টার দিকে। কাজিম আলী বলেন, ‘দেড় ঘণ্টা ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। ১০ মিনিটের রাস্তা এসেছি চার ঘণ্টায়। কখন সিলেট পৌঁছাব, আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।’
এদিন বিকেল পৌনে ৫টার দিকে সরাইলের অরুয়াইলে পাওয়া যায় আহমেদ মিয়াকে। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় যাবেন। এ জন্য তিশা পরিবহনের একটি বাসে উঠেন। কিন্তু তিন ঘণ্টা ধরে বাসেই বসে আছেন।
বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত সরাইলের বিশ্বরোড মোড় গোলচত্বর, শান্তিনগর ও আশুগঞ্জের খড়িয়ালা পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার অংশে যানজট ছিল তীব্র। একই যানজট ছড়িয়ে পড়ে নরসিংদীর ইটাখোলা থেকে চৈতন্য, মরজাল, বারৈচা, নারায়ণপুর, ভৈরবের জগন্নাথপুর ব্রিজ, দুর্জয় মোড় বাসস্ট্যান্ড ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর টোল প্লাজা পর্যন্ত প্রায় ২৮ কিলোমিটারজুড়ে। এ ছাড়া বুধবার রাত ১০টার দিকে আশুগঞ্জের গোলচত্বর থেকে সরাইলের বেড়তলা, শান্তিনগর, বিশ্বরোড মোড়, কুট্টাপাড়া মোড়, বাড়িউড়া পর্যন্ত যানজট ছড়িয়ে পড়ে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্র জানায়, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার অংশ হিসেবে আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। ভারতীয় ঋণে ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। ৫ আগস্টের পর তারা কাজ বন্ধ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। প্রায় তিন মাস পর ফিরে এলেও কাজের গতি বাড়েনি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, প্রকল্পের বিভিন্ন অংশে একপাশের কাজ শেষ হলেও বিপরীত পাশের কাজ শুরু হয়নি। যে কারণে ওই অংশটি সরু হওয়ায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে দু’পাশের যানবাহন একপাশ দিয়ে চালাতে হয়। ফলে সড়কে অতিরিক্ত চাপ পড়ে খানাখন্দের সৃষ্টি হচ্ছে।
ভৈরবের দুর্জয় মোড়ে দুপুরে কর্মরত ছিলেন পুলিশের টিএসআই দুলাল মিয়া। তিনি বলেন, সকাল ৬টায় এসেই যানজট পান। দুপুর পর্যন্ত তিন-চারটা করে গাড়ি সিগন্যাল থেকে ছাড়ছেন। সন্ধ্যা ৭টার পর যানবাহন চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক হয়। সরাইল খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানার ওসি মামুনুর রহমান বলেন, চার লেন প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ না হলে এ অবস্থার উন্নতি কঠিন। তারা যানজট নিরসনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের একাংশের পিডি শামীম আহমেদের ভাষ্য, যানবাহন চলাচল চালিয়ে যেতে সংস্কার নিয়মিতই চলছে, তবে তা অস্থায়ী। ভারী বৃষ্টি হলেই সমস্যা বেড়ে যায়। প্রকল্পের সমস্যা নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা চলছে। এগুলো মিটে গেলে দু-তিন মাসের মধ্যে কাজের গতি বাড়ার আশা করছেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প র ব শ বর ড য নজট
এছাড়াও পড়ুন:
যশোর-খুলনা মহাসড়ক যেন চাষের জমি
দেখলে মনে হবে চাষ দেওয়া কোনো জমি। এবড়োখেবড়ো কাদামাটির স্তূপ, তাতে বড় বড় গাড়ির চাকার দাগ। কোথাও গভীর গর্ত হয়ে জমে আছে পানি। যশোরের অভয়নগরে যশোর-খুলনা মহাসড়কের চিত্র এখন এমনই। এতে নওয়াপাড়া নদীবন্দরের কার্যক্রমেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর অভয়নগরের প্রেমবাগ থেকে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত যশোর-খুলনা মহাসড়ক চলাচলের একেবারেই অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, গত কয়েক দিনের অতিবৃষ্টিতে সড়কটির প্রায় এক কিলোমিটার অংশ মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। গর্তে জমা পানি, কাদামাটির কারণে রাস্তাটি চেনার উপায় নেই। এর মধ্য দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে থেমে থেমে চলছে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী বড় বড় ট্রাক। খানাখন্দে চাকা পড়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। গত মঙ্গলবার পণ্যবোঝাই একটি ট্রাক উল্টে পাশের খাদে পড়ে যায়।
নওয়াপাড়া নদীবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের বিভিন্ন পণ্য এ সড়ক দিয়ে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলায় পাঠানো হয়। দেশের চাহিদার ৬০ ভাগ আমদানীকৃত সার মোংলা থেকে নদীপথে নওয়াপাড়া নদীবন্দরে এনে খালাস করা হয়। সেই সার ট্রাকের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। বেহাল সড়কের কারণে নদীবন্দরে যেতে অনীহা দেখাচ্ছেন ট্রাকচালকরা। ফলে আমনের ভরা মৌসুমে সঠিক সময়ে সার কৃষকের কাছে পৌঁছানো নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নওয়াপাড়া সার সিমেন্ট খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির নেতা নুরে আলম পাটোয়ারী বলেন, সড়কটির কারণে নওয়াপাড়া মোকাম থেকে সারসহ পণ্য পরিবহনে চালকরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এতে বন্দরের বার্জ কার্গো থেকে সারসহ বিভিন্ন পণ্য সঠিক সময়ে খালাস করা যাচ্ছে না। এতে অতিরিক্ত সময় লাগায় ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। ভুক্তভোগী উজ্জ্বল কুমার কুণ্ডু বলেন, বৃষ্টি হলেই সড়কটি কাদামাটিতে একাকার হয়ে যায়। সড়কের গর্তে পানি জমে। আর বৃষ্টি না হলে গাড়ির চাকার সঙ্গে ওড়ে ধুলা। মোটরসাইকেলচালকরা বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
যশোরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শাহজাদা ফিরোজ মোবাইল ফোনে জানান, ঠিকাদারদের ডাকা হয়েছিল, তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা এই সমস্যার সমাধান করব। ভারী বর্ষণের কারণে কাজে বিলম্ব হচ্ছে। আশা করছি, দ্রুতই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আপাতত ইট ফেলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।
মোংলা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে বেনাপোল স্থলবন্দর এবং নওয়াপাড়া নদীবন্দরের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম এই মহাসড়ক। খুলনা থেকে ঢাকাগামী বিভিন্ন পরিবহনের বাসও অভয়নগর হয়ে যাতায়াত করে। খুলনা থেকে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়ায় যাতায়াতের এটিই প্রধান সড়ক। এখন বাসগুলোকে মনিরামপুর, সাতক্ষীরা ঘুরে যেতে হয়।
বর্তমানে সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধানে সড়কটির বিভিন্ন অংশে আরসিসি ঢালাইয়ের কাজ চলছে। ২ হাজার ৩৫২ মিটার কাজের মধ্যে ৭০২ মিটার পড়েছে যশোর মুরলী মোড়ে। বাকিটা নওয়াপাড়া থেকে প্রেমবাগ গেট পর্যন্ত বিভিন্ন অংশে। কাজটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১ কোটি ৬৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। কাজটি শুরু হয়েছে গত ২৩ মার্চ।
এর আগে ২০১৮ সালে দু’জন ঠিকাদার ৩২১ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কের অভয়নগরের রাজঘাট থেকে যশোরের পালবাড়ি মোড় পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করে। কাজটি ২০২২ সালের জুনে শেষ হয়। ওই সময় কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তিন বছরের মধ্যেই সড়কটির বিভিন্ন অংশ বেহাল হয়ে পড়ায় আবার সংস্কারকাজ করতে হচ্ছে।