কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) মব সৃষ্টি করে সাংবাদিকদের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত বুধবার রাত ১১টার দিকে এই হামলার ঘটনা ঘটে। অভিযুক্তরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মী এবং সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান শুভর অনুসারী বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা।

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, বুধবার রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত কনসার্টে মার্কেটিং বিভাগ এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এ সময় সংঘর্ষে অংশ নেওয়া সাদেক সরকার ও সাখাওয়াত অরণ্য নামে দুই ছাত্রদল কর্মীকে এক পাশে নিয়ে যান মোস্তাফিজুর রহমান শুভ। তখন সাংবাদিক চৌধুরী মাছাবিহ্ ও আবু শামা তাকে প্রশ্ন করেন হামলায় অংশ নেওয়া এই ছেলে আপনার কর্মী নাকি? আপনি এখানে তাকে শেল্টার দিচ্ছেন নাকি? তখন সাংবাদিক আবু শামাকে ধাক্কা দেন শুভ। এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকরা জানতে চাইলে শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক সাফায়েত সজল প্রশ্ন করতে বাধা দেন। একই সঙ্গে শুভর নির্দেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেন ছাত্রদলের কর্মীরা। ‘সাংবাদিকদের আগে মার’ বলেই ধাক্কাতে ধাক্কাতে মুক্তমঞ্চ থেকে গোলচত্বরের দিকে নিয়ে যান।

হামলায় অংশ নেন ছাত্রদলকর্মী ও বাংলা বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল মালেক আকাশ, ইংরেজি বিভাগের ১৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী জহিরুল ইসলাম জয়, মার্কেটিং-১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী তাওহিদ রহমান সাকিব, তাজওয়ার তাজসহ ২০-২৫ জন। হামলার শিকার হন সাংবাদিক চৌধুরী মাছাবিহ্ ও আকাশ আল মামুন।

হামলার ভিডিও ফুটেজ নিতে চাইলে চৌধুরী মাছাবিহ্ মোবাইল ফোন ছুঁড়ে মারেন ছাত্রদলকর্মী সাইফুল মালেক আকাশ। সাংবাদিকদের দিকে মারমুখী অভিব্যক্তি নিয়ে ধাক্কা দেন মার্কেটিং ছাত্রদলকর্মী তাওহিদ রহমান সাকিব। প্রতিবেদকের হাতে আসা ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ভুক্তভোগী চৌধুরী মাছাবিহ্ বলেন, আমি পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে প্রশ্ন করলে ছাত্রদলের সদস্য সচিব শুভ আমাকে ফোনের ভিডিও অফ করতে বলেন এবং তার কর্মী সাইফুল মালেক আকাশ হামলা চলাকালীন আমাকে ধাক্কা দিয়ে মোবাইল টান দিয়ে ফেলে দেন। এতে আমার মোবাইল ফোনের ডিসপ্লে ভেঙে যায়।

সাংবাদিক আবু শামা জানান, তিনি মোস্তাফিজুর রহমান শুভকে প্রশ্ন করতে গেলে ধাক্কা মারেন। সঙ্গে সঙ্গে তার কর্মীরা হামলা করেন।

তবে সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে বাধা ও তাদের ওপর হামলার নির্দেশ ও ইন্ধনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শাখা ছাত্রদলের সদস্য সচিব মুস্তাফিজুর রহমান শুভ। তিনি বলেন, পেছনে মারামারি হচ্ছিল। আমরা সামনে ছিলাম। এখানে উপস্থিত শিক্ষকরা আমাদের বিষয়টি দেখতে বলেন। যেই ছেলেটি মেরেছিল, তাকে সেখানে আটকে রাখা হয়।

রাজনীতি নিষিদ্ধ ক্যাম্পাসে কোন শিক্ষকরা বিষয়টি ছাত্রদলকে সামলাতে বলেছেন? এ প্রশ্নের জবাবে অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ড.

শরীফুল করীম ও ছাত্র পরামর্শক ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি ড. আব্দুল্লাহ আল মাহবুবের কথা জানান শুভ। তবে বিষয়টি অস্বীকার করে কমিটির আহ্বায়ক ড. শরীফুল করীম জানান, আইনশৃঙ্খলার রক্ষার দায়িত্ব তার না। এসব করার জন্য তিনি কাউকে দায়িত্ব দেননি। তার কাজ ছিল সব বিষয়ে কোঅর্ডিনেট করা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করা।

কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম এম শরিফুল করিম জানান, সাংবাদিকদের কাজ হচ্ছে সংবাদ সংগ্রহ করা, সেখানে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবে কাম্য না। প্রক্টর আবদুল হাকিমের ভাষ্য, বিষয়টি নিয়ে বসে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবেন তারা।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কুবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আবদুল্লা আল মামুনকে বারবার কল দিলেও রিসিভ করেননি। পরে কথা হয় কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি জোবায়ের আলম জিলানীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি এখনো অবগত নই। এমন কিছু ঘটে থাকলে তা দুঃখজনক। আমরা এমন ঘটনাকে প্রশ্রয় দেই না। বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলবো।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ছ ত রদল ম স ত ফ জ র রহম ন শ ভ ছ ত রদল র ল কর ম র কর ম ব ষয়ট

এছাড়াও পড়ুন:

হনুমান কি পর্বত কাঁধে করে উড়ে এসেছিলেন?

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণের এক বিশিষ্ট অধ্যায়ে উঠে আসে এক অলৌকিক ঘটনার কথা। রাম-রাবণের মহাযুদ্ধে শ্রীরামচন্দ্রের ভাই লক্ষ্মণ অচেতন হয়ে পড়লে, তাঁকে জীবিত রাখতে প্রয়োজন হয় একটি বিশেষ ভেষজ উদ্ভিদের—সঞ্জীবনী বুটি। আয়ুর্বেদাচার্য সুষেণের পরামর্শে হনুমান ছুটে যান হিমালয়ের পাদদেশে গন্ধমাদন পর্বতে।

রামায়ণে বর্ণিত আছে, নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে। বিশ্বাস করা হয় যে তিনি দীর্ঘ আকাশপথ পাড়ি দেন এই পাহাড় বহন করে। পথিমধ্যে তিনি কিছু স্থানে বিশ্রামও নেন; যেসব স্থান আজও ‘হনুমান টোক’, ‘হনুমান চট’, ‘হনুমান ধারা’ নামে পরিচিত।

নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে।

পৌরাণিক গ্রন্থগুলোয় সব ঘটনা রূপকভাবে লেখা আছে। এককথায় পুরাণের মধ্যে সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে আছে। গোলটা ফেলে মালটা বের করতে পারলে পৃথিবীর অনেক কল্যাণ হয়। এই ঘটনার রূপকতা ব্যাখ্যা করতে একটা গল্পের উল্লেখ করছি।

আরও পড়ুনভারতের আদিতম মহাকাব্য রামায়ণ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাড়িতে ২০০ মানুষকে নিমন্ত্রণ করে এক ব্যক্তি বাজারে গিয়ে অনেক বাজার করেছেন। ফেরার সময় তিনি নিজের সাইকেলের দুই হ্যান্ডলে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়েছেন, পেছনে দুটো ব্যাগ ঝোলানো, ক্যারিয়ারে একটা বস্তা বাঁধা। জায়গা না পেয়ে নিজের দুই কাঁধে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজার থেকে বাড়ির উদ্দেশে যাওয়ার পথে রাস্তায় এক লোক তাঁকে দেখে বললেন ‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন।

তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন। হনুমানের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটেছিল।

রামভক্ত হনুমান ছিলেন যোগী পুরুষ। তিনি যোগবলে অনেক অলৌকিক শক্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি যোগবলে নিজের আকার এত ছোট করে ফেলতে পারতেন যে তাঁকে খালি চোখে দেখা কষ্টকর হয়ে যেত। আবার তিনি ইচ্ছা করলে যোগবলে নিজের আকার অনেক বড় করে ফেলতে পারতেন। আর তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী।

‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন।

তিনি আসলে ‘সঞ্জীবনী বুটি’ চিনতে না পেরে যোগবলে নিজের শরীরটা অনেক বড় করে সামনে যত ধরনের বৃক্ষ ও লতাপাতা পেয়েছিলেন, সেই সবকিছু সংগ্রহ করে বিশাল এক বোঝা বানিয়ে নিজের পিঠের ওপর তুলে যখন অতি দ্রুত এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে লাফ দিচ্ছিলেন, তখন সেই বিশালদেহী হনুমানকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন গোটা পাহাড়টাই পিঠে তুলে নিয়ে লাফাচ্ছেন।

আরও পড়ুনদুর্গাপূজার কাহিনি২০ অক্টোবর ২০২৩

হনুমানের এই অসাধারণ কীর্তিকে অনেকেই অলৌকিক বলেই ভাবেন। কিন্তু অলৌকিকতা ছাপিয়ে এটা তাঁর গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা এবং গুরুর আদেশের প্রতি দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। ভারতের হিমাচল, উত্তরাখন্ড, মধ্যপ্রদেশ এমনকি বাংলাদেশের মহেশখালীর আদিনাথ ধামসহ কিছু স্থানে এই ঘটনার স্মৃতি বহন করে, এমন লোককথা এখনো প্রচলিত।

একটি পাহাড় কাঁধে বহন করে উড়ে যাওয়া প্রকৃতির নিয়মের বাইরে। আর অবতার, মহাপুরুষ বা প্রেরিত পুরুষেরা কখনো প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যান না। রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।

রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।

মনে করেন, একজন যোগী পুরুষ নদীর তীর থেকে যোগবলে অদৃশ্য হয়ে নদীর মধ্যে ভেসে উঠলেন। আমি দেখতে পাচ্ছি না, জানতে পারছি না যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই আমার কাছে অলৌকিক। আর ওই যোগী জানেন যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই তাঁর কাছে লৌকিক।

যুগের পর যুগ ধরে লাখ লাখ ভক্তের হৃদয়ে এই ঘটনা গুরুর প্রতি শিষ্যের ভালোবাসা এবং নিজেকে গুরুর প্রতি সম্যকভাবে ন্যস্ত করার এক আস্থা ও অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে রয়েছে। হনুমানের এই গাথা তাঁর ভক্তিমূলক চরিত্রকে যেমন সমৃদ্ধ করে, তেমনি মানবজাতির দুর্দম সাহস ও আত্মত্যাগের কথাও মনে করিয়ে দেয়।

তথ্যসূত্র: ১. বাল্মীকি রামায়ণ. ২. কৃত্তিবাসী রামায়ণ, ৩. শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কথিত ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ, ৪. মহেশখালীর আদিনাথ ধাম অঞ্চলের লোককথা।

পার্থ দেব বর্মন: গবেষক, সৎসঙ্গ রিসার্চ সেন্টার

আরও পড়ুনরামচন্দ্র, বিষ্ণুর অবতার কিন্তু মানবিক১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সম্পর্কিত নিবন্ধ