৫ আগস্টের পর জন্ম হওয়া দলগুলোই শুধু নির্বাচন চায় না: আমীর খসরু
Published: 31st, May 2025 GMT
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ৫ আগস্টের পর যেসব দলের জন্ম হয়েছে, শুধু সেসব দলই নির্বাচন চায় না।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আমীর খসরু এ কথা বলেন। আজ শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে জিয়া পরিষদ নামের একটি সংগঠন এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের বার্তা জনগণ আর কীভাবে দেবে, এমন প্রশ্ন রেখে আমীর খসরু বলেন, নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে অবশ্যই হতে হবে। দেশের ভেতর ও বাইরের বিনিয়োগকারীরা জিজ্ঞাসা করে, নির্বাচন কবে? অন্যান্য যারা আছে, তারাও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। সবাই বলছে নির্বাচন কবে?
শুধু একটি নয়, কমপক্ষে ৫২টি দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় দাবি করে আমীর খসরু বলেন, ‘যদি কেউ বলে, শুধু একটি দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়, এটা কি সত্য কথা? তাহলে এ ধরনের একটা মন্তব্য কি আমাদের (বিএনপির) উদ্দেশে করা হয়েছে? এটা কী অর্থ বহন করে?’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে চায় না কারা, হাতে গোনা চার-পাঁচটি দল। তাদের সমর্থনের ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না, এটা জনগণ বুঝে নেবে। এরা এখনো নিবন্ধিত দলও নয়। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে এদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে বাধা তৈরিতে ওয়ান-ইলেভেনের পরও কিংস পার্টি নামক এ ধরনের দল সৃষ্টি করা হয়েছিল মন্তব্য করে আমীর খসরু বলেন, ‘তাহলে আমরা কি আবার ওই লাইনে চলছি নাকি? ৫ আগস্টের পর যেসব দলের জন্ম হয়েছে, শুধু সেসব দলই নির্বাচন চায় না।’
অন্তর্বর্তী সরকার ও জনগণের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, এ জন্য যার যা ইচ্ছা, সে করছে। আরও করবে, আরও ক্ষতি হবে। এটা চলতে পারে না।
আমীর খসরু বলেন, এখান থেকে মুক্ত হওয়ার পথ একটাই—একটা নির্বাচিত সংসদ, যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, জবাবদিহি থাকবে। এ সময় শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্রের উত্তরণ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ সুগম করার কথা এক সুরে এ দাবি অন্তর্বর্তী সরকারকে জানিয়ে দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এ সময় বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এই নেতা বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে অনেক বড় পরিবর্তন এসেছে। এটা যে রাজনীতিবিদ, যে রাজনৈতিক দল অনুধাবন করতে পারবে না, বাংলাদেশে তাদের ভবিষ্যৎ নেই।
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ফ্যাসিস্ট আমলের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, এমন অনুরোধ জানিয়ে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে আমীর খসরু বলেন, বিরোধী দলে থাকার সময় নেতা-কর্মীরা যেভাবে একটা স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিতাড়িত করে নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে যুদ্ধ করেছেন, সেটা যেন বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও সমুন্নত রাখেন।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিটি রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে জনগণকে সম্পৃক্ত করেছেন উল্লেখ করে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে আমীর খসরু আরও বলেন, দেশের মানুষ, নতুন প্রজন্ম ভবিষ্যৎ দেখতে চায়। তাদের স্বপ্ন দেখাতে হবে, তা বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জন করত হবে।
জিয়া পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো.
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কর ব্যবস্থার অতীত-বর্তমান
‘আপনি কি সরকারকে কর দেন’– এমন প্রশ্নে অনেক মানুষই হয়তো বলবেন, ‘না’। প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে ৪০ লাখ মানুষও আয়কর রিটার্ন জমা দেন না। যারা রিটার্ন জমা দেন না, স্বভাবতই তারা মনে করেন, তারা সরকারকে কর দেন না। আদতে বিদ্যমান ব্যবস্থায় এমন কেউ নেই যে কর দেন না।
প্রাচীনকাল থেকে যখন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন হয়, তখন থেকে কর ব্যবস্থার শুরু। সে কর ছিল প্রত্যক্ষ কর। তবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কর ব্যবস্থা বিস্তৃত হয়েছে। প্রত্যক্ষ করের বাইরে, পরোক্ষ করও আদায় করছে সরকার। অত্যাবশ্যক কিছু পণ্য ছাড়া উৎপাদন, সরবরাহ বা আমদানির বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার কর বা শুল্ক আরোপ করে। ফলে আপনি যে পণ্যই কিনুন না কেন, পরোক্ষভাবে সরকারকে কর দিচ্ছেন। আধুনিক কর ব্যবস্থায় শিশু থেকে বৃদ্ধ, হতদরিদ্র ভিক্ষুক থেকে ধনী– কেউই আদতে করজালের বাইরে নেই।
প্রাচীন যুগে কর
মানব সভ্যতার ইতিহাসে কর ধারণা বেশ পুরোনো। এখন থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে প্রাচীন মিসরের ফারাও সম্রাটরা জনগণের কাছ থেকে কর আদায় করতেন। তখন কৃষকের ঘরে ঘরে গিয়ে কর আদায় করতেন সম্রাটের নিযুক্ত কর্মকর্তারা। কখনও গম, কখনও পশু, কখনওবা এক দিনের শ্রম– এ সবই ছিল করের উপাদান।
প্রাচীন মিসরের বাইরে মেসোপটেমিয়া (বর্তমানে ইরাক), ভারতীয় উপমহাদেশ– সবখানেই কর আদায়ের রীতি চালু ছিল কৃষি ও সামরিক খরচ মেটাতে। সে সময়ে কর আদায়ের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল– রাজপরিবার ও সামরিক বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ, ধর্মীয় বা রাজকীয় স্থাপনার নির্মাণ এবং যুদ্ধের জন্য রসদ সংগ্রহ। করের অর্থ জনগণের স্বার্থে ব্যবহারে সামন্ত শাসকদের কোনো দায় ছিল না।
ভারতের মৌর্য যুগে কৌটিল্য কর আদায়কে রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে দেখেছেন। বাংলার ইতিহাসেও পাল, সেন ও পরে মুসলিম শাসকরা কৃষিপণ্যের ওপর কর আদায় করতেন। মোগল আমলে আকবরের দহসালা ব্যবস্থা বাংলায় কার্যকর ছিল, যা ছিল একটি ভূমি জরিপ ও কর নির্ধারণ পদ্ধতি। ব্রিটিশ আমলে করের চরিত্র রূপ নেয় শোষণমূলক কাঠামোয়। ১৭৯৩ সালের স্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারদের হাতে কর আদায়ের ক্ষমতা দেওয়া হয়, যার ফলে কৃষকদের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়। এই সময় রাজস্ব আদায়ের অর্থ ঔপনিবেশিক সরকারের খরচ এবং মুনাফার জোগান দিত।
সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে কর ব্যবস্থার বদল হয়েছে। সময়ের প্রবাহে কর ব্যবস্থার রূপ ও উদ্দেশ্য বদলেছে। এখন প্রচলিত মুদ্রায় কর দিতে হয়। বলা চলে, করব্যবস্থাই মানব সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পথে এবং আজকের উন্নত সভ্যতা গড়ার পথে মূল নিয়ামকের ভূমিকা রেখেছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের অর্থ জনগণের স্বার্থে ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আছে সব দেশে।
বর্তমানে কর উন্নয়ন ও পুনর্বণ্টনের নিয়ামক
করের এখন অর্থ জীবনমান উন্নয়ন, নিরাপত্তাসহ জনগণের জন্য ব্যবহার হয়। একদিকে জনপ্রশাসন চালানোর সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আয় পুনর্বণ্টন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের বিশাল অঙ্কের কর চাহিদা রয়েছে। বর্তমান কর আদায়ের উদ্দেশ্য অবকাঠামো উন্নয়ন (যেমন– সড়ক, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল), শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকি ও সামাজিক সুরক্ষা এবং আয়বৈষম্য কমাতে ধনীদের ওপর অধিক কর।
করের নানা ধরন
বাংলাদেশে কর দুই প্রকার– প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয় বা সম্পদের ওপর সরাসরি যে কর আরোপ করা আছে, সেটি প্রত্যক্ষ কর। পণ্য বা সেবা কেনার সময় সরকার যে কর আদায় করে তা পরোক্ষ কর। কোনো ব্যক্তির আয় নির্দিষ্ট আয়সীমা অতিক্রম করলে তাকে কর দিতে হয়। এটিকে ব্যক্তি আয়কর বলা হয়। বর্তমানে করমুক্ত সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা। এটি অবশ্য স্বাভাবিক পুরুষ করদাতার ক্ষেত্রে। নারী, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বেশি। ব্যক্তি করহার ৫ থেকে ২৫ শতাংশ। স্বাভাবিক ব্যক্তি ভিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠান যখন আয়ের ওপর কর দেয়, তা করপোরেট কর হিসেবে পরিচিত। প্রাতিষ্ঠানিক করহার কোম্পানিভেদে ১০ থেকে ৪৫ শতাংশ। কর ফাঁকিসহ নানা কারণে মুনাফা না হলেও সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর লেনদেনের ওপর ন্যূনতম কর আরোপ করেছে। এটিকে বলা হয় টার্নওভ্যার ট্যাক্স।
এর বাইরে আরেক ধরনের প্রত্যক্ষ কর রয়েছে। এটি হলো উৎসে কর। যেমন– ব্যাংকে আমানত বা সরকারি বন্ড বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থেকে সুদ বা মুনাফা পেলে তার ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে রাখার বিধান করেছে। এর বাইরে কোনো ব্যবসা বা সেবা সরবরাহ করার পর মূল্য নেওয়ার জন্যও সরকারের আদেশে মূল্য পরিশোধকারী প্রতিষ্ঠান উৎসে কর কেটে নেয়। উচ্চ ধনীদের আয়েও সরকার কর আরোপ করেছে। ৪ কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে সরকার তার ওপর কর আরোপ করছে।
সরকার যখন জনগণের কাছ থেকে সরাসরি কর না নিয়ে পরোক্ষ ব্যবস্থায় কর নেয়, তখন সেটিকে পরোক্ষ করা বলা হয়। এই করব্যবস্থা পণ্য বা সেবা গ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কিত। আপনি যখন প্রক্রিয়াজাত বা প্যাকেটজাত বা আমদানি পর্যায়ের কোনো পণ্য কেনেন, তার ওপর নিজের অজান্তেই কর দিচ্ছেন। আবার গ্যাস বা বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছেন, তখনও পরোক্ষ করে আরোপ করে। এটিকে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বলে। পণ্য ও সেবার ওপর আরোপিত যে কর ভোক্তা পরোক্ষভাবে বহন করেন সেগুলোর একটি ভ্যাট। এছাড়া আমদানি শুল্ক আকারে বিদেশি পণ্যের ওপর করারোপ হয়। এর বাইরে বিলাসবহুল ও ক্ষতিকর পণ্যের ওপর সরকার বিশেষ কর আরোপ করে থাকে। এটি হলো সম্পূরক শুল্ক। একজন সাধারণ নাগরিকের আয়কর না লাগলেও, পণ্য কিনলে বা মোবাইলে রিচার্জ করলেও তিনি কর দিচ্ছেন, এটিই পরোক্ষ করের বাস্তবতা।