ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি নিহত হয়েছেন। তিনি ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ ও দেশের সর্বোচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। শুক্রবার ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন তাঁর নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বাঘেরি মোহাম্মদ হোসেইন আফশোরদি নামেও পরিচিত। তাঁর জন্ম সাল নিয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য রয়েছে। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ বলছে, তিনি ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন, অন্যরা সালটি ১৯৫৮ বলে উল্লেখ করেছেন। শিক্ষাজীবনে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে তারবিয়াত-ই মোদারেস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনৈতিক ভূগোলে ডক্টরেট ডিগ্রি নেন।
ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) ও ইরানের পুরো সামরিক বাহিনীর কার্যক্রম দেখভাল করতেন। পাশাপাশি তিনি এসব বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্বেও ছিলেন। তাঁর সামরিক জীবন সম্পর্কে বিশদভাবে খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও তিনি আইআরজিসিতে একজন অভিজ্ঞ ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক নানা নিষেধাজ্ঞা ও একাডেমিক অর্জনের বাইরে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তথ্য খুব কমই প্রকাশ পেয়েছে।
১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর ১৯৮০ সালে আইআরজিসিতে যোগ দেন বাঘেরি। ওই বছরই শুরু হয় ইরান-ইরাক যুদ্ধ, যেখানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এই যুদ্ধে তাঁর বড় ভাই হাসান বাঘেরি নিহত হন।
ভাইয়ের মৃত্যুর পর ১৯৮৩ সালে আইআরজিসির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হন মোহাম্মদ বাঘেরি। যুদ্ধ শেষে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন, যেমন– উপপ্রধান (ডেপুটি) গোয়েন্দা ও অপারেশনপ্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনীর সাধারণ কার্যক্রমের প্রধান।
২০১৬ সালে তিনি মেজর জেনারেল সাইয়্যেদ হাসান ফিরোজাবাদির স্থলাভিষিক্ত হয়ে আইআরজিসির চিফ অব স্টাফ হন। তিনি বিপ্লবী এই বাহিনীর একটি ‘এলিট ফোর্স’-এর সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন, যাদের দায়িত্ব ছিল বিশেষ ও স্পর্শকাতর মিশন পরিচালনা করা, বিশেষ করে বিমানঘাঁটিভিত্তিক অভিযানের ক্ষেত্রে।
২০১৯ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময় বাঘেরিকে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনে। পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাঁকে রাশিয়ায় ড্রোন সরবরাহের অভিযোগে নিষিদ্ধ করে। এ ছাড়া কানাডা ও যুক্তরাজ্যও ২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর দেশে চলমান বিক্ষোভ দমন অভিযানের জন্য তাঁকে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
বাঘেরির মৃত্যুর পর ইরান সরকার আহমাদ বাহিদিকে (সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) অন্তর্বর্তী সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।
বাঘেরির পাশাপাশি ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস কর্পসের প্রধান হোসেইন সালামি ও সশস্ত্র বাহিনীর উপপ্রধান গোলাম আলি রাশিদও নিহত হয়েছেন। এই হামলায় ইরানের ছয় পরমাণু বিজ্ঞানীও প্রাণ হারিয়েছেন।
এই হামলা এমন সময় ঘটল, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান আগামী রোববার ওমানের মাসকাটে পারমাণবিক আলোচনার আরেকটি রাউন্ড শুরু করতে যাচ্ছিল। হামলার ফলে আলোচনা স্থবির হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খবর দ্য ইকোনমিক টাইমসের।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল সশস ত র ব হ ন র আইআরজ স
এছাড়াও পড়ুন:
হনুমান কি পর্বত কাঁধে করে উড়ে এসেছিলেন?
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণের এক বিশিষ্ট অধ্যায়ে উঠে আসে এক অলৌকিক ঘটনার কথা। রাম-রাবণের মহাযুদ্ধে শ্রীরামচন্দ্রের ভাই লক্ষ্মণ অচেতন হয়ে পড়লে, তাঁকে জীবিত রাখতে প্রয়োজন হয় একটি বিশেষ ভেষজ উদ্ভিদের—সঞ্জীবনী বুটি। আয়ুর্বেদাচার্য সুষেণের পরামর্শে হনুমান ছুটে যান হিমালয়ের পাদদেশে গন্ধমাদন পর্বতে।
রামায়ণে বর্ণিত আছে, নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে। বিশ্বাস করা হয় যে তিনি দীর্ঘ আকাশপথ পাড়ি দেন এই পাহাড় বহন করে। পথিমধ্যে তিনি কিছু স্থানে বিশ্রামও নেন; যেসব স্থান আজও ‘হনুমান টোক’, ‘হনুমান চট’, ‘হনুমান ধারা’ নামে পরিচিত।
নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে।পৌরাণিক গ্রন্থগুলোয় সব ঘটনা রূপকভাবে লেখা আছে। এককথায় পুরাণের মধ্যে সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে আছে। গোলটা ফেলে মালটা বের করতে পারলে পৃথিবীর অনেক কল্যাণ হয়। এই ঘটনার রূপকতা ব্যাখ্যা করতে একটা গল্পের উল্লেখ করছি।
আরও পড়ুনভারতের আদিতম মহাকাব্য রামায়ণ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩বাড়িতে ২০০ মানুষকে নিমন্ত্রণ করে এক ব্যক্তি বাজারে গিয়ে অনেক বাজার করেছেন। ফেরার সময় তিনি নিজের সাইকেলের দুই হ্যান্ডলে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়েছেন, পেছনে দুটো ব্যাগ ঝোলানো, ক্যারিয়ারে একটা বস্তা বাঁধা। জায়গা না পেয়ে নিজের দুই কাঁধে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজার থেকে বাড়ির উদ্দেশে যাওয়ার পথে রাস্তায় এক লোক তাঁকে দেখে বললেন ‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন।
তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন। হনুমানের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটেছিল।
রামভক্ত হনুমান ছিলেন যোগী পুরুষ। তিনি যোগবলে অনেক অলৌকিক শক্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি যোগবলে নিজের আকার এত ছোট করে ফেলতে পারতেন যে তাঁকে খালি চোখে দেখা কষ্টকর হয়ে যেত। আবার তিনি ইচ্ছা করলে যোগবলে নিজের আকার অনেক বড় করে ফেলতে পারতেন। আর তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী।
‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন।তিনি আসলে ‘সঞ্জীবনী বুটি’ চিনতে না পেরে যোগবলে নিজের শরীরটা অনেক বড় করে সামনে যত ধরনের বৃক্ষ ও লতাপাতা পেয়েছিলেন, সেই সবকিছু সংগ্রহ করে বিশাল এক বোঝা বানিয়ে নিজের পিঠের ওপর তুলে যখন অতি দ্রুত এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে লাফ দিচ্ছিলেন, তখন সেই বিশালদেহী হনুমানকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন গোটা পাহাড়টাই পিঠে তুলে নিয়ে লাফাচ্ছেন।
আরও পড়ুনদুর্গাপূজার কাহিনি২০ অক্টোবর ২০২৩হনুমানের এই অসাধারণ কীর্তিকে অনেকেই অলৌকিক বলেই ভাবেন। কিন্তু অলৌকিকতা ছাপিয়ে এটা তাঁর গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা এবং গুরুর আদেশের প্রতি দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। ভারতের হিমাচল, উত্তরাখন্ড, মধ্যপ্রদেশ এমনকি বাংলাদেশের মহেশখালীর আদিনাথ ধামসহ কিছু স্থানে এই ঘটনার স্মৃতি বহন করে, এমন লোককথা এখনো প্রচলিত।
একটি পাহাড় কাঁধে বহন করে উড়ে যাওয়া প্রকৃতির নিয়মের বাইরে। আর অবতার, মহাপুরুষ বা প্রেরিত পুরুষেরা কখনো প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যান না। রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।
রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।মনে করেন, একজন যোগী পুরুষ নদীর তীর থেকে যোগবলে অদৃশ্য হয়ে নদীর মধ্যে ভেসে উঠলেন। আমি দেখতে পাচ্ছি না, জানতে পারছি না যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই আমার কাছে অলৌকিক। আর ওই যোগী জানেন যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই তাঁর কাছে লৌকিক।
যুগের পর যুগ ধরে লাখ লাখ ভক্তের হৃদয়ে এই ঘটনা গুরুর প্রতি শিষ্যের ভালোবাসা এবং নিজেকে গুরুর প্রতি সম্যকভাবে ন্যস্ত করার এক আস্থা ও অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে রয়েছে। হনুমানের এই গাথা তাঁর ভক্তিমূলক চরিত্রকে যেমন সমৃদ্ধ করে, তেমনি মানবজাতির দুর্দম সাহস ও আত্মত্যাগের কথাও মনে করিয়ে দেয়।
তথ্যসূত্র: ১. বাল্মীকি রামায়ণ. ২. কৃত্তিবাসী রামায়ণ, ৩. শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কথিত ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ, ৪. মহেশখালীর আদিনাথ ধাম অঞ্চলের লোককথা।
পার্থ দেব বর্মন: গবেষক, সৎসঙ্গ রিসার্চ সেন্টার
আরও পড়ুনরামচন্দ্র, বিষ্ণুর অবতার কিন্তু মানবিক১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩