মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের মূল পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর সরাসরি হামলা চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বহু বছরের কূটনৈতিক ভারসাম্য ভেঙে দিয়েছেন। এর ফলে এখন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এই হামলা ইরানকে আরও দ্রুত পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার পথ তৈরি করে দিচ্ছে কিনা।

গত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান এক ধরনের সীমারেখা মেনে চলছিল, যাতে করে সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা এড়ানো যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্টরা বরাবরই এই সীমা অতিক্রম করা থেকে বিরত থেকেছেন। তারা সবাই জানতেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র কোন সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে সেটি হবে এক ভয়াবহ যুদ্ধ। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবার সেই সীমারেখা ভেঙে ফেলেছেন।

এই হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ, ইসফাহান এবং পাহাড়ের অনেক গভীরে নির্মিত ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে পেন্টাগন। এসব স্থাপনায় ‘বাঙ্কার বিধ্বংসী’ বোমা ব্যবহার করা হয়। যদিও ইরান দাবি করেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি টিকে আছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করা সম্ভব।

এই ঘটনাকে ‘বিশ্ব রাজনীতির এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত’ আখ্যা দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। তেহরানের অবস্থান থেকে এটি শুধু একটি সামরিক আঘাত নয়, বরং গোটা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ভাবমূর্তির ওপর আঘাত। বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি সামরিক পদক্ষেপ নয়, এটি ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।

৮৬ বছর বয়সী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সামনে এখন কঠিন সিদ্ধান্তের প্রশ্ন: জোরালো প্রতিশোধ নিয়ে ‘সম্মান’ রক্ষা করবেন, নাকি পরিস্থিতি সামলে ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখবেন? চ্যাথাম হাউসের বিশ্লেষক সানাম ভাকিল বলেন, ‘এই মুহূর্তে খামেনির প্রতিটি পদক্ষেপ হবে শুধু তার নিজের রাজনৈতিক জীবনের জন্যই নয়, বরং ইতিহাসে তার অবস্থান নির্ধারণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।’

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক হামলায় ইতোমধ্যেই ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক প্রকল্পের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকেই নিহত হয়েছেন। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) হুঁশিয়ারি দিয়েছে, হামলার এমন প্রতিশোধ নেওয়া হবে যা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘স্থায়ী অনুশোচনায়’ ফেলবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিটি পথই বিপজ্জনক। মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির ২০টির বেশি ঘাঁটিতে প্রায় ৪০ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। তাই যেকোনো হামলা বড় ধরনের যুদ্ধ ছড়াতে পারে। আবার হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া বা উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ালে তেল সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে চীনসহ ইরানের প্রধান অর্থনৈতিক অংশীদারদের ওপরও।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ হামিদ রেজা আজিজ বলেন, ‘এটা এমন একটি যুদ্ধ, যা ইরান চায় না। কিন্তু এখন দেশের ভেতরেই চাপ তৈরি হয়েছে। শুধু ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নয়, বরং জাতীয় সম্মানের প্রশ্নেও ইরানের প্রতিক্রিয়া দেখানো জরুরি।’

এদিকে ট্রাম্প প্রশাসন কূটনীতির দ্বারও কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে। ইরান বলছে, আমেরিকা ও ইসরায়েল যখন বোমা ফেলছে, তখন কোনো আলোচনার প্রশ্নই আসে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বলেছেন, ‘শান্তি আলোচনা এখন আত্মসমর্পণের শামিল। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’

ইউরোপীয় ইউনিয়ন একদিকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে, অন্যদিকে বলছে, ইরানকে পারমাণবিক বোমা বানাতে দেওয়া যাবে না। তারা ইরানের ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণকে ‘অশুভ ইঙ্গিত’ হিসেবে দেখছে, যা অস্ত্রোপযোগী মাত্রার (৯০%) কাছাকাছি।

ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের উপ-পরিচালক এলি গেরানমায়ে বলেন- ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এমন একদিকে টানছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, যার শক্তিশালী বাহিনী ইরানের ওপর আরও আঘাত হানতে থাকবে, ফলে ইরানের পাল্টা হামলার ঝুঁকিও বাড়বে।’

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও চাপের মুখে পড়েছেন ট্রাম্প। তার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই যুদ্ধের পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন আইনপ্রণেতারা। এছাড়া তাঁর সমর্থকদের একাংশ মনে করছেন, দীর্ঘ যুদ্ধ থেকে আমেরিকাকে দূরে রাখার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা তিনি ভঙ্গ করেছেন।

এই মুহূর্তটি ইরানের কট্টরপন্থী নীতিনির্ধারকদের সামনে একটি কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরেছে, কীভাবে নিজেদের লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে এড়িয়ে আবারও প্রতিরোধের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যায়। ‘এটাই সবচেয়ে পরিহাস’ বলেন গেরানমায়েহ। ‘যদিও ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক হুমকি দূর করার চেষ্টা করেছেন, তিনি এখন ইরানের পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন।’

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতিতে ইরান যদি পারমাণবিক কর্মসূচি গোপনে আরও জোরদার করে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপে তা ঠেকাতে কূটনীতির জায়গা এখন অনেকটাই সংকুচিত হয়ে গেল।

সূত্র: বিবিসি, ভাষান্তর- আসিফ মাহমুদ

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র পদক ষ প

এছাড়াও পড়ুন:

অভিনন্দন বিশ্ব, এখন শান্তির সময়: ট্রাম্প

কাতার ও ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলার পর নিজের ট্রুথ সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক পোস্ট দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। লিখেছেন, ‌‌‘অভিনন্দন বিশ্ব, এখন শান্তির সময়।’

ইরানের হামলার বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ইরানের প্রতিক্রিয়া ‘খুবই দুর্বল’। ‘আমাদের আগেই নোটিশ দেওয়ার জন্য’ তাদের ধন্যবাদ।

ট্রুথ সোশ্যালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘ইরান তাদের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া খুবই দুর্বলভাবে দিয়েছে, যা আমরা আশা করেছিলাম এবং খুবই কার্যকরভাবে প্রতিহত করা হয়েছে।’ ওই অঞ্চলের শান্তির জন্য কাতারের আমির যা করেছেন, সেজন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ট্রাম্প।

তিনি বলেছেন, ইরান ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে যার ১৩টি ‘ধ্বংস’ করা হয়েছে। আরেকটি অন্যদিকে চলে গেছে। ওই হামলায় কোনা আমেরিকানের ক্ষতি হয়নি। ‘তেমন কোনো সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতিও হয়নি।’ এমনকি কাতারের কোনো বাসিন্দাও নিহত বা আহত হয়নি।’

 ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা তাদের ‘সিস্টেম’ থেকে সবকিছু বের করে এনেছে। আশা করি, আর কোনো ঘৃণা থাকবে না। আমাদের আগেই নোটিশ দেওয়ায় আমি ইরানকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। সম্ভবত ইরান এখন এই অঞ্চলের শান্তি ও সম্প্রীতির দিকে এগোতে পারে। আমি উৎসাহের সঙ্গে ইসরায়েলকেও একই কাজ করতে বলবো।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ