ঢাকার উপকণ্ঠে সবুজে ঘেরা শ্রীপুর যেন এখন কাঁঠালের রাজ্য। রাস্তার দুই পাশে, বাজারে, বাড়ির আঙিনায় যেদিকে চোখ যায়, শুধুই কাঁঠাল। দেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল এবার পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের মর্যাদা, আর সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুরের বিখ্যাত কাঁঠাল।

আকার, স্বাদ, ঘ্রাণে ও অনন্য এই কাঁঠাল দীর্ঘদিন ধরেই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও জায়গা করে নিয়েছে। এখন নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের অন্তত ১৫টি দেশে। স্থানীয় প্রশাসনও শ্রীপুরের কাঁঠালকে ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করতে নিয়েছে নানা উদ্যোগ। ইতোমধ্যে উপজেলা চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল কাঁঠালের ভাস্কর্য, যার স্লোগান ‘সবুজে শ্যামলে শ্রীপুর, মিষ্টি কাঁঠালে ভরপুর’।

প্রতি বছর মে-জুন মাসে শ্রীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় কাঁঠালের মৌসুম। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত জমে ওঠে কাঁঠালের বাজার। সবচেয়ে বড় হাট বসে জৈনা বাজার এলাকায়। এছাড়া চকপাড়া, টেপিরবাড়ি, রাজাবাড়ি, চন্নাপাড়া, কেওয়াসহ আরও অনেক এলাকায়ও বসে বড়-ছোট বাজার। এসব হাটে আসেন রাজধানীর কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, হেমায়েতপুর ও উত্তরার পাইকাররা।

চাষিরা প্রতিদিন গাছ থেকে কাঁঠাল সংগ্রহ করে ঠেলাগাড়ি ও ভ্যানে করে বাজারে নিয়ে আসেন। বিকেল নাগাদ মহাসড়কের পাশে সারি সারি ট্রাকে তোলা হয় শত শত কাঁঠাল। দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায় এসব কাঁঠাল। এই মৌসুমি ব্যস্ততায় জীবন্ত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গাজীপুর জেলায় মোট ৯ হাজার ১০৩ হেক্টর জমিতে কাঁঠালের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শ্রীপুরে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ৫৫২ হেক্টর জমিতে। জেলায় উৎপাদিত কাঁঠালের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।

এ অঞ্চলে খাজা, গালা ও দুরসা জাতের কাঁঠাল চাষ হয়। উঁচু জমি, বন্যামুক্ত পরিবেশ, ও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এখানকার কাঁঠাল হয় বড়, মিষ্টি আর ঘ্রাণে ভরপুর।

শুধু দেশে নয়, গাজীপুরের এই কাঁঠাল পাড়ি দিচ্ছে দেশের সীমানা। নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা থেকেও আসছেন ব্যবসায়ীরা, কেউবা সরাসরি বাগান থেকেই কাঁঠাল কিনে নিচ্ছেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী কামাল হোসেন জানান, শ্রীপুরের কাঁঠালের চাহিদা এখন বিশ্বব্যাপী। তবে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “এত সম্ভাবনার জায়গায় এখনো কোনো হিমাগার নেই। শুধু সংরক্ষণের অভাবে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার কাঁঠাল পচে যায়।”

কাঁঠাল শ্রীপুর অঞ্চলের অন্যতম অর্থকরী ফসল হলেও চাষিদের নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। অনেক বাজারে মৌসুমি ফলের জন্য নির্ধারিত স্থান নেই। ফড়িয়াদের দাপটে প্রকৃত দাম থেকে বঞ্চিত হন চাষিরা। নেই সরকারি প্রশিক্ষণ বা ব্যাংক ঋণের সুবিধাও।

কাপাসিয়া ও কালীগঞ্জ উপজেলার অনেক হাটেই নেই আলাদা কাঁঠাল বিক্রির জায়গা। এতে কৃষকদের হয়রানির শিকার হতে হয়। অথচ এখানেও ভালো ফলন হচ্ছে।

শ্রীপুরের বাগান মালিক আব্দুল মালেক বলেন, “সরকার যদি কাঁঠাল চাষে প্রশিক্ষণ দিত, সংরক্ষণের ব্যবস্থা করত, তাহলে বিদেশে আরও বেশি কাঁঠাল পাঠানো যেত।”

গাজীপুরে জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ মো.

রফিকুল ইসলাম খান বলেন, “গাজীপুরের কাঁঠালের স্বাদ, গন্ধ ও গুণগত মানে রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ইডিসি)-এর সার্বিক সহযোগিতায় পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হয় জিআই স্বীকৃতির আবেদন। গাজীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই আবেদনটি দাখিল করা হয়।”

তিনি আরো বলেন, “পরবর্তীতে, ৬ মার্চ ২০২৪ তারিখে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩-এর ধারা ১২ অনুসারে, গাজীপুরের কাঁঠালকে জিআই জার্নাল-৪৬-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ৮ মার্চ ২০২৪ তারিখে এটি ডিপিডিটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। এতে করে কাঁঠাল বাংলাদেশের ৪৭তম নিবন্ধিত জিআই পণ্যে পরিণত হয়।”

এই কৃষিবিদ আরো বলেন, “শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর কর্তৃক ‘বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস ২০২৫’ উপলক্ষ্যে বুধবার (৩০ এপ্রিল) বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমির মাল্টি পারপাস হলে একটি আলোচনা সভা ও ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে গাজীপুরের কাঁঠাল জিআই স্বীকৃতি পায়।”

কাঁঠালের জিআই স্বীকৃতি শুধু একটি সম্মান নয়, এটি একটি সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। উপযুক্ত নীতিমালা, অবকাঠামো উন্নয়ন, হিমাগার স্থাপন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে গাজীপুরের কাঁঠাল হতে পারে জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।

ঢাকা/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ আই স ব ক ত

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশি পাট আমদানির ওপর ভারতের নিষেধাজ্ঞা 

বাংলাদেশ থেকে পাট এবং সংশ্লিষ্ট তন্তু/পণ্য আমদানির উপর বন্দর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা যাতে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে ভারতে পাট রপ্তানি করতে না পারে সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিয়েছে দিল্লি। রবিবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনোমিক টাইমস এ তথ্য জানিয়েছে।

সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, নহাভা শেভা বন্দর ব্যতীত সব স্থল ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পাট এবং সংশ্লিষ্ট তন্তু/পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত। তাদের পাট রপ্তানির মাধ্যমে উপরোক্ত বিধিনিষেধ লঙ্ঘন না করে, সেজন্য সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে।

দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি-সাফটার বিধান অনুসারে, বাংলাদেশ থেকে পাট ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায়। তবে সম্প্রতি দাবি করা হচ্ছে, ভারতীয় পাট শিল্প দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ থেকে পাটজাত পণ্য, বিশেষ করে সুতা, ফাইবার এবং ব্যাগের ডাম্পিং এবং ভর্তুকিযুক্ত আমদানির প্রতিকূল প্রভাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এতে লাভবান হচ্ছে বাংলাদেশ। এই উদ্বেগের প্রেক্ষিতে, অ্যান্টি-ডাম্পিং এবং অ্যালাইড ডিউটিজ মহাপরিচালক বিস্তারিত তদন্ত পরিচালনা করে এবং বাংলাদেশ থেকে উৎপাদিত পাট/পণ্যের উপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক  আরোপ করে। তবে এই শুল্ক আরোপের পরেও আমদানিতে উল্লেখযোগ্য হ্রাস পায়নি। বাংলাদেশের বিভিন্ন বৃহৎ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিগত ছাড়, অব্যাহতিপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মাধ্যমে রপ্তানি এবং উচ্চতর ভর্তুকি নিশ্চিত করার জন্য ভুল ঘোষণার মাধ্যমে শুল্ক এড়াতে সক্ষম হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে পাট এবং সংশ্লিষ্ট তন্তু/পণ্য আমদানির উপর বন্দর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা যাতে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে ভারতে পাট রপ্তানি করতে না পারে সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিয়েছে দিল্লি।

গত মাসে ভারত বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য সামগ্রীসহ পণ্য আমদানির উপর বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ