১৯৭২ সালে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫টি। পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে ২০১১ সালে এসে এই সংখ্যা ৫০–এ উন্নীত হয়। ১৫ থেকে ৫০-এ আসতে প্রায় ৩৯ বছর লেগেছে। অথচ বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী।

স্বাধীনতার পর শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত অনেক নারী এখনো ঠিকমতো মজুরিই পান না, জাতীয় ন্যূনতম মজুরি তো দূরের কথা। স্বাস্থ্য উন্নয়নের ডামাডোলে সবচেয়ে নিচে চাপা পড়ে থাকে নারীর শিক্ষা।

এর মধ্যেই লড়াই করছেন নারীরা। লড়াই করতে গিয়ে সম্মুখসারিতে থাকছেন। কিন্তু রাজনৈতিক পরিসরে এসে পেছনের আসনে বসতে বাধ্য হচ্ছেন।

এত দিনের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট যে রাজনৈতিক দলগুলোর সংসদে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে নারী আসন বণ্টন করা হলে রাজনৈতিক নেতাদের স্ত্রী, কন্যা বা আশীর্বাদপুষ্টরা মনোনীত হন। অনেক ক্ষেত্রে মনোনয়ন পেতে মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেন ঘটে। এর মধ্য দিয়ে সংসদে নারীর প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় না। তাই সরাসরি নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণের দরকার রয়েছে।

কিন্তু বিদ্যমান অসম সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে হুট করে পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে নারীদের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে না। তাই প্রথমে কতগুলো সংরক্ষিত আসনে নারীদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের পথ সুগম হবে। ফলে ধীরে ধীরে সংরক্ষিত আসনের বাইরে সাধারণ আসনগুলোতেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে এবং একসময় আর সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন হবে না।

গণ-অভ্যুত্থানে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণের পর অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণ নিয়ে দেশব্যাপী নারীদের সোচ্চার হতে দেখা গেছে। আবার একের পর এক নারীদের রাজনীতির ময়দান ছেড়ে দিতেও দেখা যাচ্ছে। তাঁদের রাজনীতির ময়দান ছেড়ে দেওয়ার গল্পগুলো যেমন আমাদের নিরাশ করে, তেমনি নারীকে সামাজিকভাবে হেয় করাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করাটা ক্ষুব্ধও করে। এমন একটি সময়ে আমরা দেখলাম, ঐকমত্য কমিশন নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় একমত হতে পারেনি।

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার পর গত ৩১ জুলাই ঐকমত্য কমিশন জানায়, ১০০ আসনে উন্নীত করার ব্যাপারে বেশির ভাগ দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি) জানিয়েছে। তাই সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা ৫০ রাখা এবং ৩০০ আসনের মধ্যে ন্যূনতম ৫ শতাংশ আসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে নারী প্রার্থী মনোনীত করার আহ্বান জানায় কমিশন।

এখন দেখা যাক, নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়ে তিনটি ভিন্ন সংস্কার কমিশন কী কী প্রস্তাব দিয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, ৪০০ আসন নিয়ে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে। ৩০০ জন সদস্য একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি নির্বাচিত হবেন। আরও ১০০ নারী সদস্য সারা দেশের নির্ধারিত ১০০টি নির্বাচনী এলাকা থেকে কেবল নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরাসরি নির্বাচিত হবেন।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে উল্লেখ আছে, সংসদের (নিম্নকক্ষ) আসনসংখ্যা ১০০ বাড়িয়ে মোট সংখ্যা ৪০০ করা হোক। এই ৪০০ আসনের মধ্যে নারীদের জন্য নির্ধারিত ১০০ আসন ঘূর্ণমাণ পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিধান করা হোক, যাতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট আসন থেকে নারীদের সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং দ্বৈত প্রতিনিধিত্বের অবসান হয়।

আর নারী সংস্কার কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে, সংসদ নির্বাচনে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য সংসদীয় আসনসংখ্যা ৬০০-তে উন্নীত করা, যেখানে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় একটি সাধারণ আসন এবং নারীদের জন্য একটি সরাসরি নির্বাচিত সংরক্ষিত আসন থাকবে। জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ করার সিদ্ধান্ত হলে সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন করা হবে, যেখানে নারী-পুরুষ মনোনয়ন পর্যায়ক্রমে জিপার পদ্ধতিতে দেওয়া হবে।

জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে নারী আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বের জন্য কমপক্ষে পাঁচটি আসন সংরক্ষণ করতে হবে। রাজনৈতিক দলে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের বিধান না মানলে দল পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা হারাবে, এমন বিধান রাখতে হবে।

লক্ষণীয় হলো, পুরুষপ্রধান সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন নারীর জন্য সংরক্ষিত ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন এই ১০০টি এলাকায় পর্যায়ক্রমে ঘূর্ণমাণ পদ্ধতিতে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের কথা বলেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ১০০টি নির্ধারিত এলাকা থেকে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের কথা বললেও এলাকাগুলো কীভাবে নির্ধারিত হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেনি।

আর নারী সংস্কার কমিশন নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব রেখেছে। এরপর এই প্রস্তাবগুলো বিবেচনার জন্য আনা হলো। নারী সংস্কার কমিশন আর ঐকমত্য কমিশনে রইল না। আমরা ঐকমত্য কমিশনে একটা ‘বয়েজ ক্লাব’ পেলাম। যে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রধানকে নিয়ে ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেখানে কোনো নারী নেই। যদিও যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হয়তো নারীর প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন, তবু এটাই সত্য যে সেখানে নারীদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কোনো নারী ছিলেন না। অন্যদিকে যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁরা বসেছেন, সেখানেও নারীর উপস্থিতি ছিল খুবই কম।

ঐকমত্য কমিশন তিন ধরনের প্রস্তাব দিয়ে আলাপ শুরু করেছে, যেখানে আগেই মতৈক্য ছিল না। এরপর যুক্ত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দলের নিজ নিজ স্বার্থ। এখানে এসে আলোচনা হয়েছে বাস্তবায়ন কীভাবে হবে। সব দল নিজ সমস্যা নিয়ে এসেছে। ফলে ঐকমত্য না হওয়ারই তো কথা। আসনসংখ্যা বাড়ানো, সরাসরি নির্বাচন, রাজনৈতিক দলের নারী প্রার্থী মনোনয়নের বাধ্যবাধকতা নিয়ে একেক দলের একেক অবস্থান থেকে সরে না আসার প্রবণতা দেখা গেছে। এই প্রবণতা থাকবে ধরে নিয়ে কিছু বিষয় শুধু রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে না করে বরং জনসংখ্যার অনুপাতে নারীর প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে হওয়া প্রয়োজন ছিল।

ড.

মোশাহিদা সুলতানা: সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রস ত ব দ য় র প রস ত ব আসনস খ য র জন য স ব যবস থ র র জন আসন র

এছাড়াও পড়ুন:

ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য হয়েছে: জহির উদ্দিন স্বপন

বিএনপির চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা ও বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া উপজেলা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় সংকটের বিকল্প কোনো সমাধান নেই। কিন্তু একটি চিহ্নিত মহল এই ঐকমত্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নির্বাচন তথা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বানচালের অপচেষ্টা করছে।

ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় মঙ্গলবার দুপুরে বিজয় মিছিল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিএনপি। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় জহির উদ্দিন এ কথাগুলো বলেন।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে জহির উদ্দিন বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের অনুকরণে বিএনপির কেউ যদি গডফাদার সংস্কৃতির প্রবর্তন করতে চায় তাদের চিহ্নিত করে দল এবং আইনের মুখোমুখি করার জন্য আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্দেশ দিয়েছেন। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ ধরনের দুর্বৃত্তায়নকে আমরা মোকাবিলা করবই।’

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক দেওয়ান মো. শহীদুল্লাহ, সদস্যসচিব মো. মিজানুর রহমান খান, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন অঙ্গরাজ্যের নিউ ইংল্যান্ড সিটি বিএনপির সভাপতি সৈয়দ বদরে আলম প্রমুখ।

বিজয় মিছিল উপলক্ষে সকাল থেকে গৌরনদী শহীদ মিনার চত্বরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দুপুরে শুরু হয় বিজয় মিছিল। মিছিলে গৌরনদী-আগৈলঝাড়া দুই উপজেলার দলীয় নেতা-কর্মীরা অংশ নেন। এতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে প্রায় এক ঘণ্টা যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে।

এক নেতার মৃত্যু, অসুস্থ ১০

বিএনপির কর্মসূচিতে যোগ দিতে এসে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মিরাজ ফকির (৪৬) নামের এক নেতার মৃত্যু হয়েছে। এ সময় হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে আরও অন্তত ১০ জন নেতা-কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদের গৌরনদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সভায় যোগ দিতে আগৈলঝাড়া উপজেলার বাকাল ইউনিয়ন থেকে অন্য নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ছোট যানবাহনে রওনা হন স্থানীয় বিএনপি নেতা মিরাজ ফকির। পথে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে দ্রুত গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক মো. মুনীম জানান, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মিরাজের মৃত্যু হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

মিরাজ আগৈলঝাড়া উপজেলার বাকাল ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ছিলেন। পাশাপাশি তিনি রাজিহার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অফিস সহকারী পদে কর্মরত ছিলেন।

মিরাজ ফকিরের মৃত্যুতে জহির উদ্দিন শোক প্রকাশ করে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।

একই দিন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে প্রচণ্ড গরম ও রোদে অন্তত ১০ জন নারী ও পুরুষ নেতা-কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদের গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসক মুনীম জানান, অসুস্থ সবার চিকিৎসা দেওয়া হয় বহির্বিভাগে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চট্টগ্রামে নারী শিক্ষার্থীদের কেয়ারগিভিং কোর্স, সম্পূর্ণ বিনা খরচে
  • ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য হয়েছে: জহির উদ্দিন স্বপন
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে আবার আলোচনা
  • দলগুলোর সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযোগ্য নয়
  • সরকারি অনুষ্ঠানে সারা দেশ থেকে আনা হবে ছাত্র-জনতাকে, আট জোড়া ট্রেন ভাড়া করল সরকার
  • সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন
  • ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে গতি আনতে চায় কমিশন
  • রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র আর বেশিদিন টিকবে না
  • খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ ও এক্সিকিউটিভ এমবিএ প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ