ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি
Published: 5th, November 2025 GMT
বছর ঘুরলেই আগামী বছর ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) থেকে পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে ভোটার তালিকায় ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ বা এসআইআর।
আর এই দিনেই এসআইআর-এর বিরোধিতা করে সরাসরি পথে নামলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার তারই নেতৃত্বে এক পদযাত্রা বের হয়, যাতে সামিল হন মমতার ভাতিজা ও সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম মন্ত্রী, অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেন, সুজিত বসু, দলের সাংসদ জুন মালিয়া, রচনা ব্যানার্জি, শতাব্দী রায়, সায়নী ঘোষ, বিধায়ক দেবাশীষ কুমার, নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়সহ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রী, অসংখ্য দলীয় কর্মী, সমর্থক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা, সিনেমা ও টিভি সিরিয়ালের একাধিক অভিনেতা-অভিনেত্রী।
আরো পড়ুন:
পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকা সংশোধন আতঙ্কে ফের মৃত্যুর অভিযোগ
সুন্দর ঝড়ে সিরিজে সমতা ফেরাল ভারত
এই মিছিল কলকাতার রেড রোডে অবস্থিত সংবিধানের প্রণেতা ড.
পরে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “যারা মারা গেছে খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আপনারা বিজেপির চক্রান্তে মূল্যবান প্রাণ নষ্ট করবেন না। কারণ একটা মানবিক প্রাণ অনেক কষ্টে তৈরি হয়।”
ভোটারদের আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমরা থালা বাটি বেঁচেও আপনাদের সাহায্য করব, মন প্রাণ দিয়ে সাহায্য করবো। আপনাদের যদি কোনো কাগজ না থাকে আপনারা আমাদের শিবিরে যোগাযোগ করুন। চিন্তার কোনো কারণ নেই, আতঙ্কিত হবেন না। আমরা সেগুলো করে দেব। আমরা চাই আপনাদের সবার নাম ভোটার তালিকায় থাকুক, যাতে আপনারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। আমাদের লড়াই রাস্তাতেও জারি থাকবে, আদালতেও জারি থাকবে।”
মতুয়াদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, “বাংলায় কাউকে গায়ে হাত দিতে দেব না। আপনারা ভয় পাবেন না। আপনাদের দিদি আছে।”
এসআইআর করার সময়সীমা নিয়ে মমতার প্রশ্ন, “এটি করতে অন্তত তিন বছর সময় লাগে। সেক্ষেত্রে আগামী বছর নির্বাচনের দিন ঘোষণা হবে। তার আগে মাত্র তিন মাস সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কিভাবে সম্ভব? তাছাড়া ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে আপনারা (বিজেপি) কাদের ভোটে জিতেছেন? যদি একটা ভোটারও ভুয়া হয়, তাহলে আপনাদের সরকারও ভুয়া। আসলে প্রতিটি নির্বাচনের আগেই তাদের কিছু না কিছু করতে হবে। একবার হঠাৎ করে নোট বাতিল ঘোষণা দিয়ে নোট বাতিল করে দিল। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তে কি কালো রূপি দেশে ফিরে এসেছে? উল্টে লাইন দিতে গিয়ে প্রায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এরা নির্লজ্জ, এদের লজ্জা হওয়া উচিত।”
বিজেপিকে নিশানা করে মমতা বলেন, “বাংলার উপর ওদের খুব রাগ। তার কারণ ওরা জানে সব রাজ্যকে কব্জা করতে পারলেও বা বোকা বানাতে পারলেও বাংলাকে পারবে না। তার কারণ ব্রিটিশ আমলে কলকাতা ভারতের রাজধানী ছিল। তারা বাংলার সঙ্গে পেরে না উঠতে পারে দিল্লিতে রাজধানী ছড়িয়ে নিয়ে যায়। কারণ বাংলার মানুষ বেশি আন্দোলন করে, প্রতিবাদ করে। আসলে কেন্দ্রের এই সরকার যেনতেনভাবে দুই কোটি মানুষের নাম বাদ দিতে চাইছে, পড়ে ওদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়ে না হয়, বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ে কোনো রকম ক্ষমতা দখল করবে। কিন্তু আমরা তা হতে দেবো না। একজন ভোটারের নাম বাদ গেলেও বিজেপি সরকারকে ভেঙে দেব।”
তার অভিমত, “বাংলা ভাষায় কথা বললেই বাংলাদেশি হয় না, যেমন উর্দু ভাষায় কথা বললেই সবাই পাকিস্তানি হয়ে যায় না। ভারতে একটা পাঞ্জাব আছে, পাকিস্তানেও একটা পাঞ্জাব আছে। ভারতে যারা পাঞ্জাব বলে লেখে আপনি কি তাদের পাকিস্তানি বলে তাড়িয়ে দেবেন? পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা ভারতের অন্য যেসব রাজ্যে কাজের সন্ধানে যাচ্ছে, সবাইকে বাংলাদেশি হিসাবে তকমা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই মূর্খ ও অর্ধশিক্ষিতরা জানেই না যে, ১৯৪৭ সালের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত- একসাথে ছিল। যখন দেশ স্বাধীন হলো তখন যাদের বাংলাদেশে যাবার ইচ্ছে তারা সে দেশে চলে গেল। পাকিস্তানে যাদের ইচ্ছে তারা সেখানে চলে গেল। আবার যাদের ভারতে আসার ইচ্ছে, তারা আবার ভারতে চলে এলেন।”
অন্যদিকে এদিনই রাজ্যটির বিরোধী দলনেতা শ্রী শুভেন্দু অধিকারীর সক্রিয় উপস্থিতিতে ‘পরিবর্তন মিছিল’ এর আয়োজন করা হয়। দলের কলকাতা উত্তর শহরতলী জেলার তরফে আয়োজিত এই মিছিল উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পানিহাটি ট্রাফিক মোড় থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় আগরতলা তেতুলতলা মোড়। শুভেন্দু ছাড়াও দলের সাবেক সাবেক সাংসদ অর্জুন সিং সহ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সব মিলিয়ে নির্বাচনের মাত্র কয় মাস আগেই এসআইআর নিয়ে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি।
ঢাকা/সুচরিতা/ফিরোজ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর বন দ য প ধ য য আপন দ র আপন র কলক ত আতঙ ক সরক র ন মমত
এছাড়াও পড়ুন:
ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় ঢাবিতে মানবেন্দ্র লারমাকে স্মরণ
সাবেক আইনপ্রণেতা ও বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হয়েছে। সোমবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় এক স্মরণসভায় তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
স্মরণসভার শুরুতে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন এম এন লারমার ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা।
মানবেন্দ্র লারমা গরিব মেহনতি মানুষের নেতা উল্লেখ করে স্মরণসভায় সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, ‘তিনি কেবল পাহাড়ি মানুষের নেতা ছিলেন না। বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সমগ্র নিপীড়িত মানুষের কথা বলেছেন। তিনি বাহাত্তরের সংবিধানে আদিবাসী, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি সে সময় সংসদে দাড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন যে তিনি একজন চাকমা, একজন চাকমা কোনো দিন বাঙালি হতে পারেন না।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, ‘জুলাই সনদে আজকে আদিবাসী মানুষের কথা বলা নেই। অথচ কেবল মুখে বহুত্ববাদী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে। বিগত সময়ের দলীয় সরকার নাহয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেনি। কিন্তু গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় পাহাড়ি আদিবাসীরা কমপক্ষে দুটি সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিভাবে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো উচ্চারণ করেনি।’
ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক বলেন, ‘চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান যে চেতনা নিয়ে শুরু হয়েছিল, আজ সেই চেতনা মৌলবাদী শক্তির কাছে লুট হয়ে গেছে। সত্তরের দশকে নতুন বাংলাদেশে মহান নেতা মানবেন্দ্র লারমা সেই স্বপ্ন দেখছিলেন, যে স্বপ্ন একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার, গরিব মেহনতি তথা নিপীড়িত পাহাড়ি আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বুনেছিলেন।’
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানে নিপীড়িত মানুষের অধিকারের কথা বলা হয়নি, নারী-পুরুষের বৈষম্য বিলোপ এবং মেহনতি মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা তুলে ধরা হয়নি। সে সময় শোষিত মানুষের বন্ধু মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁদের হয়ে কথা বলেছেন। তিনি সংবিধান প্রণয়নের সময় শ্রমিক, গরিব ও আদিবাসী নিপীড়িত মানুষের কথা বলেছিলেন।
সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের যত রাজনৈতিক দল আছে, তারা অন্য জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করার মতো মানসিকতা এখনো তৈরি করতে পারেনি। ভোটের আগে মুখে বললেও তা বাস্তবে বাস্তবায়ন করে না।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল কাফি রতন বলেন, ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জুম্ম জাতির জন্য ছাত্রজীবন থেকে অধিকারের কথা বলেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সংবিধান যখন বাঙালি বলে আদিবাসী মানুষের পরিচয় করে দিতে চেয়েছিল, সেই সময় গণপরিষদে এম এন লারমা প্রতিবাদ করেছিলেন।’
স্মরণসভায় আরও বক্তব্য দেন লেখক ও সাংবাদিক এহসান মাহমুদ, সাংবাদিক সাইফুর রহমান, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা ও নারীনেত্রী শিরিন হক। স্মরণসভা শেষে গান, কবিতা পাঠ ও প্রদীপ প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।