‘তুচ্ছ কারণে’ও শিরোনাম হওয়া কনস্টাস নেই অস্ট্রেলিয়া দলে
Published: 5th, November 2025 GMT
মোটে ৫ টেস্টের ক্যারিয়ার। ১০ ইনিংসে করেছেন ১৬৩ রান, সর্বোচ্চ ৬০। যে কোনো দলের বিবেচনাতেই সাদামাটা ব্যাটিং পারফরম্যান্স। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট অভিষেকের পর এমন হতশ্রী ব্যাটিংয়ের পরও অনবরত আলোচনায় স্যাম কনস্টাসের নাম। অস্ট্রেলিয়া দলের নির্বাচক জর্জ বেইলি তো বলেই দিলেন ‘স্যামি (স্যাম কনস্টাস) বায়ু ত্যাগ করলেও শিরোনাম হয়।’
২০ বছর বয়সী কনস্টাস এবার আলোচনায় বাদ পড়ার কারণে। ২১ নভেম্বর পার্থে শুরু অ্যাশেজের প্রথম টেস্টের দলে রাখা হয়নি তাঁকে। কনস্টাসের জায়গায় ডাক পেয়েছেন এখনো অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা জ্যাক ওয়েদারাল্ড। আজ স্টিভেন স্মিথকে অধিনায়ক রেখে পার্থ টেস্টের জন্য ১৫ সদস্যের দল ঘোষণা করেছেন অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকেরা।
কনস্টাস আলোচনায় আসেন গত বছরের বক্সিং ডে টেস্টে সুযোগ পেয়ে। মেলবোর্নে ২৬ ডিসেম্বর ভারতের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে নজর কাড়েন এই ওপেনার। তাঁর রিভার্স স্কুপ, যশপ্রীত বুমরার বিপক্ষে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে এসে শট খেলার মতো মানসিকতা প্রশংসিত হয়।
তবে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৬০ রানের পর তাঁকে ঘিরে আলোচনা তুঙ্গে উঠলেও ব্যাটিংয়ে পারফরম্যান্স দিনে দিনে ম্লান হয়েছে। সর্বশেষ তিন ইনিংসে দুবার আউট হয়েছেন শূন্য রানে, সর্বশেষ ৯ ইনিংসে সর্বোচ্চ ২৫ রান। আর সেটিরই ফল, অ্যাশেজের প্রথম টেস্টের দল থেকে বাদ। এখন তাঁকে নিউ সাউথ ওয়েলস দলে ফিরে শেফিল্ড শিল্ডে খেলতে হবে। সফরকারী ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচেও অবশ্য খেলতে পারেন।
আজ পার্থ টেস্টের দল ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে কনস্টাসের প্রতি সহানুভূতিই ঝরেছে নির্বাচক বেইলির কণ্ঠে, ‘স্যামির জন্য আমার খারাপ লাগছে, কারণ এখন মনে হয় সে যদি বায়ু ত্যাগও করে, সেটা শিরোনাম হয়। দেশজুড়ে শিল্ড ক্রিকেটে তার বয়সী বেশ কয়েকজন তরুণ খেলছে, সবাই নিজেদের সেরা ক্রিকেটার হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। স্যামিও তার ব্যতিক্রম নয়।’
কনস্টাসকে শিল্ডের দলে ফিরে যতটা সম্ভব ব্যাটিং করা এবং রান করায় মনোযোগ দিতে বলেন বেইলি। একই বিষয়ে পরে বেইলি বলেন, কনস্টাস সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ‘রসিকতা ছিল না।’ কেন তুচ্ছ কারণেও কনস্টাস শিরোনাম হন বলেছেন, তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘সে শুধু খেলছে বলেই যে পরিমাণ শিরোনাম পায়, তা দেশের অন্যান্য একই অবস্থানে থাকা খেলোয়াড়দের তুলনায় একেবারেই ব্যতিক্রম। তার ওপর যে দৃষ্টি দেওয়া হয়, তা কিছু মাত্রায় প্রায় নজিরবিহীন।’
গত অক্টোবরে ২০ পূর্ণ করা এই তরুণের জন্য সহানুভূতি জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহও। অস্ট্রেলিয়া ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই অধিনায়ক তাঁর নিজের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের সঙ্গে কনস্টাসের পরিস্থিতির মিল খুঁজে পাচ্ছেন, ‘সে আসলে আমাকে নিজের শুরুর দিকের সময়টার কথা মনে করিয়ে দেয়। দলে নিজের অবস্থান নিয়ে পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী না থাকা, ওঠানামা করা, এবং ফর্মও ঠিক জায়গায় না থাকা।’
কনস্টাসকে তিনিও দিয়েছেন দিয়েছেন ঘরোয়ায় ফেরার পরামর্শ, ‘টেস্ট ক্রিকেট কীভাবে খেলতে হয়, সেটা টেস্ট ক্রিকেট খেলতে খেলতে শেখা খুব কঠিন। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল কয়েক বছর ধরে। তাই আমি শিল্ড ক্রিকেটে ফিরে যেতাম, লম্বা ইনিংস গড়ার চেষ্টা করতাম, যতক্ষণ সম্ভব ব্যাটিং করতাম, নিজের খেলা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানার চেষ্টা করতাম।’
পার্থ টেস্টের অস্ট্রেলিয়া দলস্টিভেন স্মিথ (অধিনায়ক), শন অ্যাবোট, স্কট বোল্যান্ড, অ্যালেক্স ক্যারি, ব্রেন্ডন ডগেট, ক্যামেরন গ্রিন, জশ হ্যাজলউড, ট্রাভিস হেড, জশ ইংলিস, উসমান খাজা, মারনাস লাবুশেন, নাথান লায়ন, মিচেল স্টার্ক, জ্যাক ওয়েদারাল্ড ও বো ওয়েবস্টার।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা
লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।
আরো পড়ুন:
আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র
মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা
চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।
তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।
শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।
তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।
তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।
ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।
রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।
“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”
“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”
“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”
টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”
“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।”
সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।
ঢাকা/আমিনুল