এক বছরে গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা কতটা পূরণ হলো
Published: 6th, August 2025 GMT
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন। কিন্তু এটি রাস্তায় নেমে আসা লাখ লাখ ছাত্র–জনতার একমাত্র প্রত্যাশা ছিল না। গণ-অভ্যুত্থানের কোনো লিখিত ইশতেহার না থাকলেও মিছিলে, স্লোগানে, বক্তৃতায়, দেয়াললিখনে প্রত্যাশাগুলো ফুটে উঠেছিল।
এ রকম কতগুলো দেয়াললিখন ও স্লোগান হলো, ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’, ‘সংস্কার চলছে’, ‘আমরাই গড়ব বৈষম্যহীন সরকার’, ‘মেয়ে–ছেলে বৈষম্য নয়, মানুষ হিসেবে সবার পরিচয়’, ‘ধর্মবৈষম্য নিপাত যাক’, ‘সমতল থেকে পাহাড়, এবারের মুক্তি সবার’, ‘চা–শ্রমিকের বেতন বাড়াও’, ‘একজন রিকশাচালকের সন্তানও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখে’, ‘এলিটদের রাষ্ট্রব্যবস্থা না, গণমানুষের রাষ্ট্রব্যবস্থা’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ ইত্যাদি।
এসব দেয়াললিখনের মধ্য দিয়ে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণি ইত্যাদি সব ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছিল। শুধু ব্যক্তি নয়, গোটা ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবি উঠেছিল। গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় কতটা পূরণ হলো সেসব প্রত্যাশা?
২.
অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল গণ-অভ্যুত্থানে নিহতদের তালিকা তৈরি, আহতের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন; ছাত্র–জনতার ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞের বিচার, বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন। এর মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ৮৩৬ জনের একটি তালিকা হয়েছে বটে, কিন্তু সেটা পূর্ণাঙ্গ ও ত্রুটিমুক্ত কি না প্রশ্ন রয়ে গেছে। ৭৫ জন জুলাইযোদ্ধাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বিভিন্ন দাবিতে আহতদের প্রায়ই রাস্তায় নামতে হয়েছে।
ব্যবস্থা পরিবর্তনের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার মোট ১১টি কমিশন এবং বেশ কিছু টাস্কফোর্স ও কমিটি গঠন করেছিল। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি মৌলিক সংস্কারের অভিধা পেলেও বাদবাকি কমিশন যেমন স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী, গণমাধ্যম ইত্যাদি কমিশনের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন কোনো আলোচনার মধ্যেই নেই।
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সংসদীয় কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমাসম্পর্কিত বিধান, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, পুলিশ কমিশন গঠন এবং রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন।
যেসব বিষয়ে ভিন্নমতসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিধান, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও ক্ষমতা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা, রাষ্ট্রের মূলনীতি ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ। এ সিদ্ধান্তগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখনো বাকি আছে।
অন্যদিকে যেসব সংস্কার করতে খুব বেশি রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন নেই, যেমন পুলিশ ও জনপ্রশাসনকে ঘুষ দুর্নীতিমুক্ত করা, সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ নেই। আমলাতন্ত্র জনবান্ধব তো হয়নি, বরং সরকার নিজেই আমলাতন্ত্রবান্ধব হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপর প্রশাসনের বিভিন্ন পদে ঢালাও বদলি ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বাজেটে বিশেষ সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে। রাজস্ব আয়ের বিপুল ঘাটতির মধ্যেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতনকাঠামো নির্ধারণ করতে বেতন কমিশন গঠন করা হয়েছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আগেই কতিপয় রাজনৈতিক দলের সুপারিশে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, যার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা দল এনসিপির প্রতি পক্ষপাতিত্বেরও অভিযোগ রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনা ঘিরে আন্দোলনের ক্ষেত্রে এনসিপির প্রতি সহনশীল আচরণ করলেও শিক্ষক, পল্লী বিদ্যুতের কর্মী, তথ্য আপা, পোশাকশ্রমিক ইত্যাদি পেশাজীবী ও শ্রমজীবীদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে পুলিশকে নির্মম আচরণ করতে দেখা গেছে।
৩.
বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এসব সংস্কার বাস্তবায়ন যে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করবে, সে রাজনৈতিক দল পরিচালনা ও নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতন্ত্রায়ণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য কোনো সংস্কার উদ্যোগ দেখা যায়নি।
রেমিট্যান্সে ও বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি এবং সেই তুলনায় আমদানি না বাড়ার কারণে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে, যদিও তা মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মধ্যে অর্থনীতির গতি মন্থর হয়েছে, বিনিয়োগ স্থবিরতায় কর্মসংস্থান কমে গেছে, বেড়েছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। দারিদ্র্য বাড়া সত্ত্বেও ভর্তুকি দামে খাদ্যপণ্য বিক্রি-সরবরাহ কমেছে।
দেশের ব্যাংক খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করতে সরকার ব্যাংক রেজ্যুলেশন অধ্যাদেশ জারি করেছে। ব্যাংক খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদও পুনর্গঠন করেছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসছে, যদিও খেলাপি ঋণ উদ্ধারে অগ্রগতি হয়নি, দায়ী ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকদেরও শাস্তি হয়নি। উল্টো খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগের মতোই টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনায় অগ্রগতি নেই।
দেশের অর্থনীতির ওপর বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিদেশি সংস্থার প্রভাব কমেনি। দেশের বাজেট, মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিতে রয়েছে আইএমএফের শর্তের ছাপ। বাজেট–কাঠামোয় কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরাবরের মতোই পরোক্ষ কর–নির্ভর বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অপ্রতুল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে সরকার গঠিত বিভিন্ন কমিশন ও টাস্কফোর্সের সুপারিশের প্রতিফলন ঘটেনি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কুখ্যাত দ্রুত সরবরাহ আইন বাতিল করা হয়েছে। তবে সেই আইনের অধীনে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো বহাল আছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। রামপাল, রূপপুর কিংবা আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা হয়নি। জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা রয়ে গেছে, জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে আগের মতোই লুকোচুরি করা হয়েছে। জনগণকে অন্ধকারে রেখেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক বিষয়ে দর-কষাকষি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দিতে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতাই রক্ষা করছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীর কাছে বন্দরকে আকর্ষণীয় করতে বন্দরের বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। হাসিনার আমলে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তিগুলো প্রকাশ ও পুনর্মূল্যায়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
হাসিনা সরকার ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বিষয়ে কখনো প্রতিবাদ করেনি। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারপরও সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারত থেকে পুশ ইন। এ পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি মানুষকে ভারত বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে, যাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বহুদিন আগে অভিবাসী হওয়া ব্যক্তি যেমন আছেন, তেমনি ভারতীয় নাগরিক, এমনকি রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও আছেন। সীমান্ত ও পানিবণ্টনের সমস্যার যে মাত্রায় আন্তর্জাতিকীকরণ প্রয়োজন, সেখানে ঘাটতি রয়ে গেছে।
৪.
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোয় ব্যক্তির অদলবদল ঘটলেও মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হয়নি। গুম বিষয়ে কমিশন হলেও ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যা বিষয়ে কোনো কমিশন হয়নি। গুমের জন্য দায়ী কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও তাঁরা দেশত্যাগে সক্ষম হয়েছেন।
দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধির কিছু সংস্কার হয়েছে। যদিও ৫৪ ধারার মতো কুখ্যাত বিধান রয়ে গেছে। পুলিশের অপরাধের তদন্তের জন্য পুলিশ কমিশন গঠন বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ইতিবাচক খবর। তবে এর মাধ্যমে রাজনৈতিক বিবেচনায় পুলিশের নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতি বন্ধ হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। কুখ্যাত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। তবে জাতিসংঘের মতে, সদ্য প্রণীত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে এখনো অনেক ধারায় মতপ্রকাশকে ‘অপরাধ’ হিসেবে রাখা হয়েছে অস্পষ্ট সংজ্ঞার মাধ্যমে, যা অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। এতে পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের বিধানও রয়ে গেছে।
মতপ্রকাশে সরকারের দিক থেকে সরাসরি বাধা দেওয়া না হলেও মব সৃষ্টি করে গণমাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগ, সংবাদ সরাতে চাপ দেওয়া কিংবা সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য করার মতো ঘটনা ঘটেছে। এসব বন্ধ করতে সরকারের দিক থেকে কোনো শক্ত পদক্ষেপ দেখা যায়নি। প্রভাবশালীদের নিয়ে কটূক্তি বা সমালোচনার দায়ে কিছু ক্ষেত্রে মামলা বা চাকরি থেকে বরখাস্তের ঘটনা ঘটেছে। হাসিনা সরকারের আমলে নাগরিকদের ওপর নজরদারির যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, সেখানেও কোনো সংস্কার হয়নি।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুসারে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ৯ আগস্ট ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত ২৯টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কারা হেফাজতে বম নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, বকেয়া মজুরির দাবিতে আন্দোলনে নামা শ্রমিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দ করে দুমড়েমুচড়ে ডাম্পিং করা হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আন্দোলনের মুখে কেবল পোশাকশ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হয়, যা মূল্যস্ফীতির তুলনায় যথেষ্ট নয়। অন্য খাতের শ্রমিকেরা বাড়তি কিছু পাননি। শ্রম সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই, উদ্যোগ নেই জাতীয় ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নের।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের সবচেয়ে বড় উদ্যোক্তা শ্রেণি কৃষকের স্বার্থ তেমন গুরুত্ব পায়নি। কৃষকের সার-বীজের দাম ও প্রাপ্যতা, সেচের পানি কিংবা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিয়ে যে সংকট, তার সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বরাবরের মতো কৃষক সার ও সেচের সংকটে পড়েছে, আলু-পেঁয়াজের মতো ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
৫.
দেশে দক্ষিণপন্থার উত্থান দেখা যাচ্ছে। দেশজুড়ে ভিন্নমতাবলম্বী, প্রান্তিক, সংখ্যালঘু ও নারীদের ওপর হামলা-হয়রানি বেড়েছে, বেড়েছে মব–সহিংসতা। একের পর এক মাজারে হামলা, বিভিন্ন মেলা, ওরস, বাউল উৎসব বন্ধ, নাটক ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে বাধা, ধর্ম অবমাননার দায়ে হামলা-হুমকির ঘটনা ঘটেছে। এসব থামাতে অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠোর হতে দেখা যায়নি। সহিংস মবকে ‘প্রেশার গ্রুপ’ বলে উৎসাহিত করার মতো ঘটনা ঘটেছে।
ভুঁইফোড় উগ্র জাতিবাদী সংগঠনের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তকের পেছনের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দসংবলিত গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এর প্রতিবাদে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ মিছিলও উগ্রবাদীদের হামলার শিকার হয়েছে। এ সময়ে দেশে খুন, ডাকাতি, দস্যুতা, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। দখল, দুর্নীতি, চাঁদাবাজিও চলছে, শুধু লোক বদল হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি দেখে একজন বিচারক ‘পুরো দেশটাই লাইফ সাপোর্টে’ আছে বলে মন্তব্য করেছেন।
বিমানবন্দর এলাকায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ কিংবা পলিথিন বন্ধের মতো কিছু অকার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হলেও দেশের পরিবেশ দূষণ পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি। ঢাকা এখনো বিশ্বের অন্যতম দূষিত নগরী। কর্তৃপক্ষের নাকের ডগাতেই কারখানাগুলো নদী দূষণ করে চলেছে। নদীগুলো দখলমুক্ত হয়নি। নদী হত্যা করে বালু ও পাথর উত্তোলন, বন ধ্বংস করে চিংড়িঘের নির্মাণ অব্যাহত আছে। মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনগুলো আগের মতোই রাজধানীর বাতাস দূষিত করে চলেছে।
তবে আশার কথা হলো এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের কতগুলো আকাঙ্ক্ষা অনেক মূর্ত ও স্পষ্ট হয়েছে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও রীতিনীতি বিষয়েও সচেতনতা বেড়েছে। ফলে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাতারাতি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন না ঘটলেও আশা করা যায়, ভবিষ্যতে কোনো শাসক দলের পক্ষেই আগের মতো একচেটিয়া দুঃশাসন চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না।
কল্লোল মোস্তফা লেখক ও গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র ব যবস থ গঠন কর ঐকমত য র র মত র মত ই ত হয় ছ ত র জন র জন য র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
নারী আসন নিয়ে পুরুষদের এত আপত্তি কেন
সব সম্ভবের বাংলাদেশ। এখানে যাঁরা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ, তাঁদের সঙ্গে প্রকৃত শ্রমিকদের সম্পর্ক ক্ষীণ। যাঁরা কৃষকের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, তাঁরা কৃষকের সমস্যাটাই জানেন না। শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে তাঁরাই মাঠ গরম করেন, যাঁদের ছাত্রত্ব অনেক আগেই শেষ হয়েছে।
চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে যে নারী সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, রাষ্ট্র সংস্কারে তারাই সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হলো। সরকার গঠিত ১১টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে নারী অধিকারসংক্রান্ত কমিশন ছাড়া কোনোটির প্রধান পদে নারী ছিলেন না। অন্যান্য কমিটিতে নারী বা সংখ্যালঘু ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নারীর অধিকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ম্যারাথন আলোচনা করলেও কমিশনে কোনো নারী প্রতিনিধি ছিলেন না। এ ছাড়া তারা যেসব দলের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের মধ্যেও নারী প্রতিনিধি ছিলেন খুবই কম। অর্থাৎ জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আলোচনাটি হয়েছে কার্যত নারীকে বাদ দিয়ে। আর এত দীর্ঘ আলোচনার পর জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে যে সিদ্ধান্ত হলো, তা পর্বতের মূষিক প্রসব ছাড়া আর কিছু নয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, নারী আসন ১০০ করা ও সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা। বর্তমানে সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত আসন আছে, যা দলীয় আসনের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভায় রাজনৈতিক দলগুলো আসন বাড়ানোর বিষয়ে একমত হলেও ভোটের পদ্ধতি নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি। এদের মধ্যে এমন দলও আছে, যারা নারীর প্রতিনিধিত্বেই বিশ্বাস করে না।
কিছু রাজনৈতিক দল ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে অতিরিক্ত ১০০ আসনে সরাসরি ভোট করার পক্ষে ছিল, যা অনেকটা মহিলা পরিষদের দেওয়া প্রস্তাবের কাছাকাছি। মহিলা পরিষদ বিদ্যমান ৩০০ আসনের মধ্যে ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে সরাসরি ভোটের প্রস্তাব দিয়েছিল। সংবিধান সংস্কার কমিশন আসন বাড়িয়ে ৪০০ করার কথা বলেছে। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল এই প্রস্তাব নাকচ করে এই যুক্তিতে যে নতুন করে আসনবিন্যাস করতে হলে নির্বাচন পিছিয়ে যাবে।
শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিদ্যমান ৫০ আসনের পাশাপাশি ৫ শতাংশ হারে নারী প্রার্থী বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়, যা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো খুব আপত্তি করেনি। নারী সংগঠনগুলোর মূল আপত্তিই ছিল সংরক্ষিত আসনব্যবস্থায়; যেখানে জনগণের ভোট নয়, দলীয় নেতৃত্বের কৃপায় এমপি হতে হয়।
নারী সংগঠনগুলোর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জবাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ কমিশনের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, সংসদে নারীদের জন্য আসন বাড়ানো ও সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া হলেও তারা তা শোনেননি। দলগুলো ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে।
এই অভিযোগ ও আর্তি কেবল ফাতেমা খানমের নয়। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নেওয়া অনেক নারী নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছেন, হতাশা ব্যক্ত করেছেন। অনেকে সামাজিকভাবে হেনস্তারও শিকার হয়েছেন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারক কিংবা আন্দোলনের পুরুষ সহযাত্রীরা তাদের পাশ দাঁড়িয়েছেন, এ রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। বরং আমরা দেখছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সভাসমাবেশে একশ্রেণির লোক নারীদের হেনস্তা ও অসম্মান করতে পারলেই পুলকিত হন।তাঁর ভাষ্য থেকে আমরা আরও জানতে পারি, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন ১০০ আসন বাড়িয়ে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এটাকে নতুনভাবে নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ করে নির্বাচন পেছানোর অজুহাত বলা শুরু করে। আমরা এমনও বলেছি, সংরক্ষিত আসন বাতিল করে দেন। দল থেকে ৩৩ শতাংশ নারীকে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়ন দেন। তাতেও দলগুলো রাজি হয়নি।’
আসলে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের সংস্কার না হলে নারীর ক্ষমতায়ন যে সম্ভব নয়, তা আবারও তারা প্রমাণ করল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তে নারী সংগঠনগুলো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। শনিবার ব্র্যাক সেন্টারে ‘নারীকে বাদ দিয়ে নারীর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় নারী অধিকারকর্মীরা কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের কোনো সুপারিশ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গ্রহণ করেনি। নারী অধিকারকর্মীদের দেওয়া প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয়েছে।’
তাঁদের মতে, নারী অধিকারকর্মী ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন এই সুপারিশ গ্রহণ করেনি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী নারী হলেও ঐকমত্য কমিশনে নারীর কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। কমিশন নারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। তারা শুধু রাজনৈতিক দলের কথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রশ্ন আসে সরকার যদি নারীদের ক্ষমতায়নে এত দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, তাহলে ঢাকঢোল পিটিয়ে কমিশন গঠন করল কেন? সংসদে নারীদের জন্য আসন বাড়িয়ে ১০০ করে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছিল নারীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সংসদের আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে ৩০০টি আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছিল।
ঐকমত্য কমিশন যেসব দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে, সেসব দল নারীর প্রতিনিধিত্ব করে কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন নারী সংগঠনের প্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, ‘যেসব রাজনৈতিক দল সেখানে আলোচনা করেছে, তারা কোনোভাবে নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে না। নারীদের বাদ দিয়ে সংস্কার হলে আগামী নির্বাচনে নারীরা ভোট দেবেন না।’
অন্যদিকে মহিলা পরিষদ এক বিবৃতিতে ২০৪৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদে মনোনয়নের মাধ্যমে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন বহাল রাখার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তকে ‘পশ্চাৎপদ’ বলে অভিহিত করে।
জাতীয় সংসদে নারীর আসনসংখ্যা ও নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে, তখন চট্টগ্রাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামের সাবেক মুখপাত্র ফাতেমা খানমের ফেসবুকে দেওয়া বার্তাটি চোখে পড়ল। তিনি বলেছেন, ‘চট্টগ্রামে যাঁদের সঙ্গে জুলাই আন্দোলন করেছি, তাঁরাই আজ নারীদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বয়ান (ন্যারেটিভ) তৈরির চেষ্টা করছেন। নারীদের ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন। এগুলো নেওয়া যায় না।’
গত শুক্রবার রাত ১০টা ৪৪ মিনিটে নিজের ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে আসেন ফাতেমা খানম। এ সময় তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের কিছুসংখ্যক মানুষের স্বার্থের কাছে, তাঁদের চাওয়া-পাওয়ার কাছে আমাদের রাজনীতি হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছেন আন্দোলনের সম্মুখসারিতে থাকা অনেকে। এখন বলতে গেলে কেউই নেই। এই সবকিছুর জন্য কিছুসংখ্যক ভাই-ব্রাদার দায়ী। তাঁরা কেন্দ্রের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চট্টগ্রামে একটার পর এক কোরাম বানিয়েছেন। এর দায় আপনাদের নিতে হবে।’
এই অভিযোগ ও আর্তি কেবল ফাতেমা খানমের নয়। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নেওয়া অনেক নারী নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছেন, হতাশা ব্যক্ত করেছেন। অনেকে সামাজিকভাবে হেনস্তারও শিকার হয়েছেন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারক কিংবা আন্দোলনের পুরুষ সহযাত্রীরা তাদের পাশ দাঁড়িয়েছেন, এ রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। বরং আমরা দেখছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সভাসমাবেশে একশ্রেণির লোক নারীদের হেনস্তা ও অসম্মান করতে পারলেই পুলকিত হন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংসদে নারীর আসন ও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যে উপসংহারে এল, তা কোনোভাবে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
সোহরাব হাসান, কবি ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
মতামত লেখকের নিজস্ব