পানিসম্পদ ‘উপদেষ্টাকে কাকুতি-মিনতির কথাটা জানাবেন’
Published: 4th, October 2025 GMT
‘পা ধরি বাবা, হামার বাড়িটা বাঁচান বাবা। কয়টা বস্তা দিয়া ভাঙা বন্ধ করি দেও। আল্লাহ তোমার ভালো করবে বাবা।’ সম্প্রতি ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁ তীরে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী-রাজীবপুর উপজেলায় ভাঙন পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিলাম। তখন রৌমারী উপজেলার ঘুঘুমারিতে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বয়স্ক এক নারী হাতজোড় করে কথাগুলো বলছিলেন।
ওই স্থানে অনেকেই যখন ভাঙন বন্ধের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করছিলেন, তখন আমার পাশের চেয়ারে বসা পার্শ্ববর্তী মসজিদের ইমাম আবদুল মজিদের দুচোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। অশ্রুসিক্ত ইমাম। তাঁর ভিটেমাটি এখন যেকোনো সময় নদীগর্ভে বিলীন হবে। ভাঙনের আশঙ্কায় ঘর তুলে একটু দূরে রেখেছেন। ৪০টি ফলবান সুপারিগাছসহ সব গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে। কোথায় যাবেন, কী করবেন জানেন না। কেবলই দুচোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে।
রৌমারী উপজেলার পাখি ধরা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক রইচ উদ্দীন ভাঙনের কথা বলতে গিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন। তাঁর কান্নার সময় উপস্থিত নারী-পুরুষ অনেকেই কাঁদছিলেন। স্কুলশিক্ষক বলছিলেন, ‘মানুষের বাঁশের ঝোপের তলায় কোনাকাঞ্চিতে কোনোমতে মানুষের জমিতে একটা ছাপরা (চালা) তুলে থাকা যে কী বেদনাদায়ক, সেটা আপনারা জানেন কি না আমি বুঝি না। আমি আপনাদের পায়ে ধরে মিনতি করি, আমাদের আর নিরাশ করবেন না, আর নিঃস্ব করবেন না, বাস্তুহীন করবেন না। মাননীয় উপদেষ্টা মহোদয়কে আমাদের আকুতি-মিনতির কথাটা জানাবেন।’
চর মেন্দার আলগায় গিয়েছিলাম ভাঙন দেখতে। সেখানে অনেক বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এখনো অনেক বাড়ি ভাঙবে বলে মনে করছেন নদীতীরের বাসিন্দারা। চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে এক ব্যক্তি সহায়তা চাইলেন সরকারের। কাঁদতে থাকা ব্যক্তিটির বাড়ি নদীতে গেলে সন্তান নিয়ে কোথায় যাবেন, এই অনিশ্চয়তা তার। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনকবলিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, এমন সময় এক প্রবীণ নারী কোথা থেকে ছুটে এসে আহাজারি করতে থাকলেন। ভাঙন থেকে মুক্তি চান। নাম তাঁর হয়রান বেগম। রাষ্ট্র তাঁকে যেন চরম হয়রানির মধ্যে রেখেছে।
কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁ তীরের দুই উপজেলা রাজীবপুর ও রৌমারী। এ দুই উপজেলার পাশ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র প্রায় ৪২ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়। এর মধ্যে প্রায় ১৪ কিলোমিটারে তীব্র ভাঙন আছে। বাঁ তীরে কয়েকটি স্থানে ভাঙনকবলিত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, বর্তমানে যেখানে নদী আছে, অর্ধশত বছর আগে নদী সেখান থেকে স্থানবিশেষে প্রস্থে কোথাও ১০-১২ কিলোমিটার, কোথাও ৭-৮ কিলোমিটার দূরে ছিল নদী।
যে কয়েকটি এলাকায় ভাঙনকবলিত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, সেখানে শিশুদের চেহারা একই রকম। বোঝা যাচ্ছে, শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দীন গত বছর আশির দশকে চিলমারীর জীবন নিয়ে যেসব প্রতিবেদন করেছিলেন, সেই প্রতিবেদনে থাকা শিশুদের মুখচ্ছবি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। করুণ মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। অনেকবার বাড়ি ভেঙেছে—এ রকম অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। একজন জানালেন, ১৬ বার তাঁর বাড়ি ভেঙেছে।রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের পাইকানটাড়ি পাড়ায় নজরুল ইসলাম জোতদার নামে সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হয়। যে স্থানে কথা বলছিলাম, সেই স্থানে প্রস্থে ১২-১৪ কিলোমিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ওই স্থানে ভাঙন রোধে কোনো সরকার অতীতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। হাজারো বাড়িঘর ভেঙে গেলেও কোনো সরকার একজন ব্যক্তিকেও পুনর্বাসন করেনি। বাড়ি ভেঙে গেলে দু-একবার কয়েক কেজি চাল দিয়েছে।
একই কথা বলেছেন যে কয়েকটি ভাঙনকবলিত এলাকায় কথা বলেছি তাঁদের সবাই। অনেকে জানালেন, এ নদী এ রকম ছিল না। বর্ষা মৌসুমে জোরপূর্বক দুই কিলোমিটার প্রস্থে ছিল। এখন সেটি কোথাও কোথাও প্রায় ১৪ কিলোমিটারে পরিণত হয়েছে।
যে কয়েকটি এলাকায় ভাঙনকবলিত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, সেখানে শিশুদের চেহারা একই রকম। বোঝা যাচ্ছে, শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। মোনাজাত উদ্দীন গত বছর আশির দশকে চিলমারীর জীবন নিয়ে যেসব প্রতিবেদন করেছিলেন, সেই প্রতিবেদনে থাকা শিশুদের মুখচ্ছবি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। করুণ মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। অনেকবার বাড়ি ভেঙেছে—এ রকম অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। একজন জানালেন, ১৬ বার তাঁর বাড়ি ভেঙেছে।
নৌপথে যখন ব্রহ্মপুত্রের বাঁ তীর ঘেঁষে যাচ্ছিলাম, দেখলাম অনেক স্থানে বাড়ি ভাঙছে। অনেক স্থানে কাটা হচ্ছে গাছ, অনেক স্থানে ঘরবাড়ি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি সড়ক দেখলাম, যেগুলো নেমে গেছে নদীতে।
রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন, রাজীবপুরের মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, রৌমারীর মহির উদ্দীন খুব চেষ্টা করছেন ভাঙন বন্ধ করার জন্য যাতে সরকার কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে। তীরবর্তী ভাঙন রোধে আনোয়ার হোসেন মন্ত্রিসভার সচিব বরাবর একটি আবেদন করেছেন। সচিব সেই চিঠির বরাত দিয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন রোধে কিছু কিছু কাজ করেছে। সেই কাজ উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। দুই বছর আগে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন রোধের জন্য একটি প্রকল্প জমা দিয়েছিল। সেখানে যে টাকার কথা বলা হয়েছিল, সেই টাকা কমাতে বলেছিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড সেই টাকা কমিয়ে আবার প্রকল্প জমা দিয়েছে। এই প্রকল্প এখনো অগ্রগতিমূলক সবুজ পাতায় ওঠেনি। সরকার চাইলে সবুজ পাতায় ওঠানো কঠিন কিছু নয়।
রৌমারী ও রাজীবপুরের মানুষের দুঃখ–কষ্ট অতীতে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছায়নি। রৌমারী-রাজীবপুর যদি চট্টগ্রাম, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, কুমিল্লা কিংবা ফেনীর দুটি উপজেলা হতো, তাহলে বছরের পর বছর ব্রহ্মপুত্রে ভাঙন থাকত না। যেকোনো মূল্যে এই ভাঙন বন্ধ করা হতো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী বলছিলেন, সারা দেশে মানুষের জীবনমান উন্নয়নে লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়, কিন্তু কুড়িগ্রামে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় না।
সাধারণত মন্ত্রী–উপদেষ্টা-সচিব কিংবা প্রভাবশালী রাজনীতিক থাকলে তাঁদের এলাকায় বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। রংপুর বিভাগে এ রকম কেউ নেই। তবে ব্রহ্মপুত্রের তীরের সাধারণ মানুষ এখন মনে করেন, তাঁদের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আছেন। তিনি সারা দেশকে সমান চোখে বিচার করবেন। তাঁদের বিশ্বাস, বর্তমান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রহ্মপুত্র নদ ভাঙন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। সাধারণ মানুষের এই বিশ্বাসের জয় হোক।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক।
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ ঙনকবল ত ম ন ষ প গ রহণ কর উপদ ষ ট উপজ ল র প রকল প উদ দ ন এল ক য করব ন বলছ ল এ রকম সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
চিত্রকর্মটি বিক্রি হলো ২,৮৯১ কোটি টাকায়
পোর্ট্রেট অব এলিজাবেথ লেডেরার এখন সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হওয়া চিত্রকর্মের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে। প্রথমে রয়েছে জগদ্বিখ্যাত ইতালিয়ান শিল্পী লেওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা ‘সালভাতর মুন্দি’। যিশুখ্রিষ্টকে নিয়ে আঁকা চিত্রকর্মটি ২০১৭ সালে ৪৫ কোটি ৩০ লাখ ডলারে বিক্রি হয়েছিল।
পোর্ট্রেট অব এলিজাবেথ লেডেরার আঁকা হয় ১৯১৪ থেকে ১৯১৬ সালের মধ্যে। অস্ট্রিয়ার প্রভাবশালী ইহুদি পরিবারের মেয়ে এলিজাবেথ লেডেরারের বাবা অগাস্ট লেডেরার ছিলেন ক্লিমটের বড় পৃষ্ঠপোষক। ১৯৩৮ সালে অস্ট্রিয়া দখলের সময় চিত্রকর্মটি জব্দ করে নাৎসি বাহিনী। আশির দশকে সেটি আবার চিত্রকর্মের বাজারে আসে। তখন থেকেই এটি ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় ছিল।
গুস্তাফ ক্লিমট