১.

বাংলাদেশে বন্যা-খরা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-তাপদাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটা যেতে না যেতেই আরেকটা আসে। প্রতিটি দুর্যোগ মানুষের জীবন, ঘরবাড়ি, ফসল, পশুসম্পদ ও জীবিকা কেড়ে নেয়। ভুক্তভোগী মানুষ একের পর এক শারীরিক এবং আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সামলাতেই হিমশিম খায়। সীমিত সক্ষমতা নিয়ে রাষ্ট্র সেই ক্ষয়ক্ষতির পাশে খুব সামান্যই দাঁড়াতে পারে। আর সেখানে ভুক্তভোগী মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা দূর পরিকল্পনার নিচে চাপা পড়ে থাকে।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি খানিকটা ‘অভ্যস্ত হয়ে গেছি’ বা ‘অত চিন্তা করতে গেলে পেট চলে?’ ধরনের। কিন্তু চিন্তা করবে না বললেই কি মাথা থেকে অনিশ্চয়তাগুলো ঝেড়ে ফেলা যায়? ধারকর্জ করে করা পাকা ধান, ঘেরের মাছ, হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল ভেসে যাওয়ার পর যারা বেঁচে থাকল, তারা সারা বছর খাবে কী? কীভাবে সংসার চালাবে, চিকিৎসা করবে, সন্তানদের স্কুলে পাঠাবে, পরের বছর বীজ-সার-পানি কিনবে? ঋণের গভীরে ডুবে যেতে যেতে নানান দুশ্চিন্তায় সংসারে বেঁচে থাকাটাই দুর্যোগকবলিত মানুষের জন্য বরং একটা অভিশাপ হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে দুর্যোগ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। সময়োপযোগী পূর্বপ্রস্তুতির কারণে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ফসল বা জীবিকার ক্ষতি কতটা রোধ করা গেছে? সামান্য ত্রাণ, ভর্তুকি আর কাঠামোগত সহায়তা দিয়ে খাতা-কলমে দায় শোধ হয়, কিন্তু ভুক্তভোগীর দুর্যোগ-পরবর্তী মানসিক ব্যাধি, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা তাতে কতটুকুই প্রশমিত হয়? পরিবেশগত দুর্যোগকবলিত মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্য, পুনরায় উঠে দাঁড়ানোর মতো, ফসল ফলানোর মতো আত্মবিশ্বাসের দিকে নজর দেওয়ার কথা দেশের, পঞ্চবার্ষিক বা জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন পরিকল্পনাগুলোর কোথাও আছে?

২.

প্রতিবছর ১০ অক্টোবর পালিত হয় ওয়ার্ল্ড মেন্টাল হেলথ ডে বা বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। দ্য ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথের শুরু করা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমর্থনে পালিত দিনটির ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য ‘সেবা প্রাপ্তির সুযোগ, দুর্যোগ ও জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য’। প্রতিপাদ্যটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দেশটিতে ক্রমবর্ধমান বন্যা-খরা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-তাপদাহের মতো নানান দুর্যোগ শুধু মানুষের জীবন-জীবিকাই নয়, তাদের মানসিক সুস্থতাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।

আমরা সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত দুর্যোগের কারণে মানুষ যেসব মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়, সেগুলোর চিকিৎসা প্রক্রিয়া বা মেন্টাল হেলথ ইন্টারভেনশনের ওপর একটি আন্তর্জাতিক পর্যালোচনা সম্পন্ন করেছি। তাতে দেখা যায়, কার্যকর মানসিক চিকিৎসা প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও সেগুলোর অধিকাংশই উচ্চ আয়ের দেশে পরিচালিত। বাংলাদেশের মতো নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা হয় না বললেই চলে। এর মানে হলো, দুর্যোগপীড়িত মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে দেশটির নিজস্ব পটভূমিতে গবেষণা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কার্যত অনুপস্থিত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক সহায়তা পিরামিডের মাধ্যমে দেখিয়েছে যে কার্যকর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে পরিবার, সম্প্রদায় এবং স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ পর্যন্ত বহুমাত্রিক এবং সমন্বিত হতে হবে। কিন্তু আমাদের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অধিকাংশ উদ্যোগ ব্যক্তি-স্তরের সেবা ও বিশেষজ্ঞনির্ভর চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ। পরিবার, সম্প্রদায় বা প্রাথমিক সেবার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা দেওয়ার উদাহরণ খুবই কম। অথচ বাস্তবে দুর্যোগের অভিঘাত মোকাবিলায় পরিবার ও সম্প্রদায়ই প্রথম আশ্রয়স্থল।

৩.

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা স্বাভাবিক সময়েই সীমাবদ্ধতার মুখে থাকে। চিকিৎসকের ঘাটতি, অবকাঠামোর অভাব এবং বাজেট–সংকটে মানুষ প্রাথমিক শারীরিক স্বাস্থ্যসেবাই সঠিকভাবে পায় না। সেখানে দুর্যোগকালীন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা আরও কঠিন। অথচ প্রয়োজন হলো সমন্বিত ও বহুস্তরবিশিষ্ট পদক্ষেপ, যেখানে হাসপাতালকেন্দ্রিক বিশেষজ্ঞ সেবার পাশাপাশি থাকবে পাড়া-মহল্লাভিত্তিক কাউন্সেলিং, পরিবারকেন্দ্রিক সচেতনতা বৃদ্ধি, স্কুল পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা।

বাংলাদেশে মানসিক ব্যাধিকে এখনো উপেক্ষা, কলঙ্ক, আর অবহেলার চোখে দেখা হয়। দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনকে নীতি ও পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ গবেষণা বলছে, অদৃশ্য এই ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী ও প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মানুষের দারিদ্র্য বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে তা মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বহু গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এই পটভূমিতে এবারের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে বাংলাদেশের জন্য আহ্বান হয়ে আসুক, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি। প্রয়োজন সরকারি পরিকল্পনা ও বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো এবং স্থানীয় পটভূমিতে উপযুক্ত চিকিৎসাপদ্ধতি তৈরি ও প্রয়োগ করা।

পরিবেশগত দুর্যোগের অভিঘাত থেকে শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি চোখে দেখা যায়, কিন্তু মানসিক ক্ষত থাকে অদৃশ্য। তাহলে কি এই ক্ষতই দেশটির অভিযোজন সক্ষমতা, সামাজিক বন্ধন ও জাতীয় উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে? বাংলাদেশ যদি টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই পরিবেশগত দুর্যোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যকে সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ নানামুখী সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে দেশটির ১৮ কোটি মানুষ কি আদৌ তাদের প্রয়োজনীয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে পারবে?

মাসুমা পারভিন মিশু, এম এম গোলাম রব্বানী, রুমানা হক, সাইদুর রহমান মাশরেকী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। যোগাযোগ: [email protected]

দুর্যোগকবলিত মানুষের মানসিক ব্যাধি নিরাময়–সম্পর্কিত পর্যালোচনামূলক গবেষণা আর্টিকেলটি পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.tandfonline.com/doi/full/10.1080/09603123.2025.2568035#abstract

কৃতজ্ঞতা: সিল্কে ভেরিকেন, এমা টাক, জ্যাকি মার্টিন-কেরি, ফাইয়াজ চৌধুরী, আবরার ওহাব, রিচার্ড ফ্রেন্ড, ইসমাইল সাদী।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর ব র পর ব শ

এছাড়াও পড়ুন:

বন্দরে কক্সবাজারের নারী মাদক ব্যবসায়ীসহ গ্রেপ্তার ২  

বন্দরে পৃথক অভিযান চালিয়ে এক নারী মাদক কারবারিসহ ২ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই সময় সংশ্লিষ্ট পুলিশ  ধৃত মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ২০১৬ পিছ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

ধৃত মাদক কারবারিরা হলো সুদূর কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার জালিয়াপাড়া এলাকার মৃত হাজী আবুল হোসেন মিয়ার মেয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী সলিমা বেগম (৫০) ও বন্দর থানার ২০ নং ওয়ার্ডের আকাশ মিয়ার ছেলে ইয়াবা ব্যবসায়ী হৃদয় (২৫)।

পৃথক স্থান থেকে ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধারের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারি সংস্থা বাদী হয়ে  ধৃতদের বিরুদ্ধে বন্দর থানায় মাদক আইনে পৃথক মামলা রুজু করেছে। যার মামলা নং- ৩৮(১১)২৫ ও ৩৯(১১)২৫। ধৃতদের বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে বন্দর থানায় রুজুকৃত পৃথক মাদক মামলায় এদেরকে আদালতে প্রেরণ করা হয়।

এর আগে  গত বুধবার (২৬ নভেম্বর) বিকেল ৫টায় বন্দর থানার ঢাকা টু চট্টগ্রাম মহাসড়কের মদনপুরস্থ রাফি ফিলিং স্টেশনের সামনে  যাত্রীবাহী ঢাকা মেট্রো ব ১৪- ৯৯৪৫ নাম্বারে ষ্টার লাইন পরিবহন ও একই তারিখ দিবাগত রাত সোয়া ২টায় বন্দর থানার মাহমুদনগর ছোট ব্রীজের সামনে পৃথকঅভিযান চালিয়ে উল্লেখিত ইয়াবাসহ এদেরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।

থানা সূত্রে জানা গেছে, ধৃত মাদক কারবারিরা দীর্ঘ দিন ধরে অবাধে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উল্লেখিত পৃথক স্থানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ এদেরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ