শেখ হাসিনার পতন ঘটানো গণঅভ্যুত্থানের সূত্রপাত করা ছাত্র নেতৃত্বের রাজনৈতিক দল আগামী মাসের মধ্য থেকে শেষ ভাগে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। সংসদীয় আসন, উপজেলা ও ইউনিয়নে বিএনপির দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের দলে টানার চেষ্টা করবে তারা। আওয়ামী লীগ বাদে অন্যান্য দলের নেতাদের জন্যও দুয়ার উন্মুক্ত রাখবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে বাহাস শুরু হলেও, তিন ছাত্র উপদেষ্টার মধ্যে অন্তত একজন দলের নেতৃত্বে আসতে পারেন। সরাসরি বিএনপি বিরোধিতা না করে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে ছাত্র নেতৃত্বের দল। মূলনীতি এবং কর্মসূচি যাই হোক, চাঁদাবাজি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বিরক্ত থাকায়, এ ইস্যুতে আত্মপ্রকাশের আগে লংমার্চ কর্মসূচি দিতে পারে তারা। তবে তা নির্ভর করছে মধ্য ফেব্রুয়ারির আগে কতগুলো উপজেলা ও থানায় কমিটি করা যায়, তার ওপর।

ছাত্র নেতৃত্বের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে। এসব সংগঠনের নেতাদের ভাষ্য, দল গঠনের পরও নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সক্রিয় থাকবে। আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও নতুন রাজনৈতিক দলের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে।

গত বৃহস্পতিবার নাগরিক কমিটির সদস্য আখতার হোসেন জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারিতেই আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা আসবে। শতাধিক নামের প্রস্তাব এলেও, এখনও নাম ঠিক হয়নি।
নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন সমকালকে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য কয়েকটি সময় রয়েছে দলের আত্মপ্রকাশে। তবে কোনোটিই চূড়ান্ত হয়নি।

সাড়া ফেলার চেষ্টা
গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তরের চেয়ে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে গৌরবান্বিত দেখানোর অভিযোগ করা হচ্ছে। তা মোচনে প্রাথমিকভাবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে দলের আত্মপ্রকাশের চিন্তা ছিল। কিন্তু রমজান এবং ওই দিন থেকে ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরু হওয়ায় আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বড় জমায়েত সম্ভব হবে না– চিন্তা থেকে ফেব্রুয়ারি বেছে নেওয়ার কথা জানিয়েছে নাগরিক কমিটির সূত্র।

গত ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৩০ উপজেলা ও থানায় প্রতিরোধ কমিটি করেছে নাগরিক কমিটি। সামান্তা শারমিন বলেন, ঢাকায় থানার পর ওয়ার্ড কমিটি গঠন শুরু হয়েছে। ৪০০ উপজেলা ও থানায় কমিটি শেষে দল আত্মপ্রকাশ করবে।
গত ১৮ জানুয়ারি নাগরিক কমিটির সাধারণ সভায় লংমার্চের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের প্রস্তাব আসে। চাঁদা, দখল, ঘুষ, দুর্নীতি, সিন্ডিকেট নির্মূলের দাবিতে গণঅভ্যুত্থানে রংপুরে শহীদ আবু সাঈদ থেকে শুরু করে চট্টগ্রামে শহীদ ওয়াসিম আকরামের কবর পর্যন্ত লংমার্চের আলোচনা হয়। জনদৃষ্টি আকর্ষণে হেঁটে এ কর্মসূচি করার প্রস্তাবও রয়েছে।

চাঁদা, দখল, দুর্নীতিবিরোধী বয়ান
নাগরিক কমিটির মূল্যায়ন, ৫ আগস্ট রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হলেও চাঁদাবাজি, দখলদারি বন্ধ হয়নি। এতে গণঅসন্তোষ রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল বিএনপি নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি-দখলের জন্য দায়ী করছে। তারা আওয়ামী লীগের পরিবর্তে এখন বিএনপির দখলদারিত্ব এসেছে– এমন একটি  রাজনৈতিক বয়ান তৈরির চেষ্টা করছে। নাগরিক কমিটি এ বয়ানকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করে, আওয়ামী লীগহীন ভোটের মাঠে বিএনপির প্রতিপক্ষ হতে চাচ্ছে।

সরকারি অফিসে ঘুষ, দুর্নীতি, সেবা পেতে ভোগান্তি নিয়েও নিজের পক্ষে বয়ান তৈরি করতে চায় নাগরিক কমিটি। কিন্তু ক্ষমতায় তাদের সমর্থিত ড.

মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার থাকায় এ প্রচার জোরদার করার চেয়ে চাঁদা, দখল এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে চিহ্নিত সিন্ডিকেটবিরোধী বয়ানে জোর দিচ্ছে।

নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সমকালকে বলেন, জুলাই বিপ্লবে মানুষ শুধু কোটা সংস্কারে জীবন দেয়নি। চাঁদাবাজি, দখল, দুর্নীতি, সিন্ডিকেটের নির্মূল চেয়েছিল। তা কি হয়েছে? ৫ আগস্টের পর কি চাঁদাবাজি, দখল হচ্ছে না? কারা করছে, তাও তো দেশের মানুষ দেখছে। তাদের পরিচয় জনগণের সামনে স্পষ্ট। মানুষ সত্যিই অতিষ্ট চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও দুর্নীতিতে। এগুলো আর চলতে দেওয়া যাবে না। এটাই নাগরিক কমিটির অবস্থান।

জুলাই গণহত্যা, শেখ হাসিনার শাসনামলের অপকর্মের বিচারের দাবিতে বিএনপির চেয়ে বেশি সোচ্চার এবং ভারতবিরোধী সুরও অন্যদের চেয়ে চড়া রাখবে নাগরিক কমিটি। তারা বিএনপিকে চাপে রেখে নির্বাচনের আগে সংস্কার নিশ্চিতে গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি রাখবে মাঠে। গতকালও সমাবেশের বক্তৃতায় নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এসব দাবির কথা তুলেছেন।

লক্ষ্য বিএনপির নেতাকর্মী
৫ আগস্টের পর বিএনপি, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে কোন্দল বেড়েছে। হচ্ছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, খুনাখুনি। এতে ক্ষুব্ধ, নবগঠিত কমিটির পদবঞ্চিত এবং আসন্ন নির্বাচনগুলোতে যারা বিএনপির মনোনয়ন ও সমর্থন প্রাপ্তিতে পিছিয়ে; তাদের নতুন দলে টানার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে ছাত্রদলসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের কমিটিতে ভেড়ানো হয়েছে।
নাগরিক কমিটির সূত্র এ তথ্য সমকালকে জানালেও সামান্তা শারমিন তা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেননি। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করেন– এমন সব নাগরিকের জন্য নতুন রাজনৈতিক দলের দুয়ার উন্মুক্ত। শুধু বিএনপি নয়, অন্য যে কোনো দলের যে কেউ জুলাই চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে এলে স্বাগত জানানো হবে। তবে যারা অতীতে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি তথা আওয়ামী লীগে যুক্ত ছিলেন, তাদের নেওয়া হবে না। বিভিন্ন কমিটিতে কয়েকজন অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য গোপন করে ঢুকে পড়েছিলেন। তা জানামাত্র বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানান সামান্তা।

উপদেষ্টারা কি দলে থাকবেন
সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ছাত্রদের সরকারের সহযোগিতা নিয়ে দল গঠন বা কিংস পার্টি হওয়া উচিত হবে না। উপদেষ্টারা ছাত্রদের দলে থাকলে অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা হারাবে। সে ক্ষেত্রে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রয়োজন হবে।

ছাত্র নেতৃত্ব এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যকে আরেকটি ১/১১-এর ইঙ্গিত আখ্যা দেন। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া স্পষ্ট করেন, উপদেষ্টা রাজনীতি করলে সরকার ছেড়েই করবে। বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি ফেসবুকে লেখেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সরকারি এবং সাংবিধানিক পদের নিয়োগে চাপ-তদবিরও অনুচিত। উপদেষ্টারা খোলাখুলি বলেন, সরকারের সব স্তরে বিএনপিপন্থিরাই রয়েছেন।

এমন বাহাস চললেও শোনা যাচ্ছে, নাহিদ ইসলাম আসতে পারেন নতুন দলের নেতৃত্বে। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। সামান্তা শারমিন সমকালকে বলেন, এ-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আলাপ-আলোচনা হয়নি। নাগরিক কমিটি মনে করে, উপদেষ্টাদের কেউ রাজনীতি করতে চাইলে সরকারের পদ ছাড়তে হবে। নইলে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। শুধু নাগরিক কমিটি নয়, একই নীতি অন্য দলের জন্যও প্রযোজ্য হতে হবে। সরকারের কোনো স্তর যেন কোনো দলের প্রতি অনুগত থাকতে না পারে।

সরকারি চাকরিতে আদালতের রায়ে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে সংগঠন গড়ে শিক্ষার্থীরা গত ১ জুলাই আন্দোলনে নামেন। এতে ছাত্রলীগের হামলার পর সাধারণ মানুষ যোগ দেন। পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ হত্যাযজ্ঞ চালালে আন্দোলন রূপ নেয় অভ্যুত্থানে। বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো আগের ১১ বছরে সরকার পতনের আন্দোলন ডেকে ব্যর্থ হলেও শিক্ষার্থীদের সূত্রপাত করা অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান।

বিএনপি ও রাজনৈতিক দলগুলো অভ্যুত্থানে তাদের অবদান স্মরণ করিয়ে সংকট নিরসনে দ্রুত নির্বাচন চাইলেও ছাত্র নেতৃত্ব সংস্কারে জোর দিচ্ছে। সংবিধানসহ বিভিন্ন ইস্যুতেও রয়েছে বিপরীতমুখী অবস্থানে। আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় ছাত্ররাই বিএনপির নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে– এমন সম্ভাবনা ও গুঞ্জন রয়েছে, যা নিয়ে নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন উপদ ষ ট র ৫ আগস ট সরক র র ব এনপ র র জন য গঠন র উপজ ল আওয় ম স গঠন সমক ল

এছাড়াও পড়ুন:

লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানাল জেএসডি

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের আলোচনা ও ঐকমত্যের সূচনাকে স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। দলটি বলেছে, আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জনগণ শুধু কথায় নয়, বাস্তবে সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতির পদক্ষেপ দেখতে চায়।

শুক্রবার জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন।

তারা বলেন, এই উচ্চপর্যায়ের সংলাপ দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত অভিপ্রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

বিবৃতিতে নেতারা বলেন, অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠক ও বিবৃতিতে আগামী বছরের পবিত্র রমজানের আগেই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ এবং তার পূর্বশর্ত হিসেবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচারের প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জনের ঘোষিত প্রত্যয়ে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

বিবৃতিতে বলা হয়, গণমানুষের রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম দাবি- গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাঠামোগত মৌলিক সংস্কার এবং গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদী শক্তির বিচারের ব্যবস্থা। এই বিষয় দুটির দৃশ্যমান অগ্রগতিই কেবল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভিত্তি রচনা করতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সমাজের শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবীদের মতামত, আকাঙ্ক্ষা ও অংশগ্রহণে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির মৌলিক সংস্কারের লক্ষ্যে দ্রুত ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের আহ্বান জানায় জেএসডি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • গণঅভ্যুত্থানে আহত সামিউলের দিন কাটছে অনিশ্চয়তায়
  • লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানাল জেএসডি