মৌলভীবাজারের সেই গৃহবধূ নুরজাহানের কথা কি মনে আছে? যিনি সমাজপতিদের ষড়যন্ত্রমূলক সালিশের রায়ে পাথরের আঘাত ও অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন। সময় বদলেছে, ফতোয়াবাজি কমেছে। কিন্তু নতুন সময়ে নতুন কায়দায় নির্যাতিত হচ্ছে নারী। পরপর দু’বার সাফ চ্যাম্পিয়নের গৌরব এনে দেওয়া নারী ফুটবলাররা অপমানে কাঁদছেন। ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি পেয়েছেন একজন নারী ফুটবলার। সম্প্রতি জয়পুরহাট ও দিনাজপুর নারী ফুটবল দলের খেলা আয়োজন ভন্ডুল, নায়িকা অপু, পরীমণি ও মেহজাবিন চৌধুরীকে শোরুম উদ্বোধনে বাধা প্রমাণ করে, নারীর চলার পথ এখনও অমসৃণ।
যে দেশে জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত, সেখানে এমন ঘটনা গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের ঘটনা সংবিধানের ১৯ (সুযোগের সমতা), ২৭ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), ২৮ (ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য) অনুচ্ছেদগুলোর সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। একই সঙ্গে এটি দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও), সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
অবৈধ সালিশের পর অসহায় নারীর আত্মহত্যার ঘটনাও থামেনি। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে আইন ও বিচারবহির্ভূত সালিশের ১১টি ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতেই ঘটেছে ৪টি ঘটনা। এর মধ্যে রয়েছে– মাদারীপুরের শিবচরে কিশোরীকে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে ধর্ষণ, গর্ভপাত; সালিশে প্রেমিকের প্রেম অস্বীকার এবং প্রেমিকের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের সিদ্ধান্ত। কয়েক দিন পর কিশোরী আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় থানায় আত্মহত্যা মামলা এবং কয়েকজন সালিশকারকেও আসামি করা হয়েছে।
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে কিশোরীকে ধর্ষণ, অন্তঃসত্ত্বা ও সালিশ। এত নির্যাতন সইতে না পেরে মেয়েটির বিষপানে আত্মহত্যা। থানায় ধর্ষণ মামলা হলেও এখন পর্যন্ত আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলা হয়নি।
ময়মনসিংহে ধর্ষণের শিকার কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা হলে সালিশের মাধ্যমে তাঁকে গর্ভপাত ও বাড়িছাড়া করার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। অভিযুক্তকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়; ৮০ হাজার টাকা ভুক্তভোগীকে দেওয়া হলেও বাকি টাকা এখনও অপরিশোধিত। ধর্ষণের ঘটনায় মামলাও হয়নি।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে ধর্ষণ মামলা ধামাচাপা দিতে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয় ভুক্তভোগী কিশোরীসহ তাঁর পরিবারকে। এ ক্ষেত্রেও সালিশের মাধ্যমে ‘সমাধান’-এর চেষ্টা চলে। সালিশের পর ধর্ষণ মামলা হয়েছে; কিন্তু হত্যাচেষ্টা মামলা এখনও হয়নি।
প্রতিটি ঘটনায়ই ভুক্তভোগী কিশোরী। আর দু’জন কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। এসব ঘটনায় প্রথমে সালিশের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে, যখন সমাধান হয়নি তখন মামলা করা হয়েছে। যদি সমাধান হয়ে যেত, তাহলে ঘটনাটি হয়তো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হতো না। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে বাস্তবে ধর্ষণের ঘটনা এবং এ-সংক্রান্ত সালিশের সংখ্যা অনেক বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবৈধ সালিশের ঘটনায় প্রচলিত আইন অনুযায়ী সালিশকারদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না।
ধর্ষণসংক্রান্ত ঘটনা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ পরিবার প্রান্তিক শ্রেণির। ঘটনা ঘটার পর আইনসংক্রান্ত সচেতনতা না থাকা এবং ‘সম্ভ্রমহানির ভয়ে’ অনেকেই বুঝে উঠতে পারে না ধর্ষণ-পরবর্তী কী পদক্ষেপ নেবে। তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে গ্রামের মাতবর শ্রেণি ও স্বার্থান্বেষী মহল বোঝাতে থাকে, আইনের দ্বারস্থ হলে অনেক ঝামেলা। তারা সালিশ করে বিচার পাইয়ে দেবে। বিচার করিয়ে দেওয়ার নামে সালিশকারীরা দুই পক্ষ থেকে কমিশনও নেন। এতকিছুর পরও সালিশের পুরো টাকা ভুক্তভোগীর পরিবার পায় না। জমি বা আর্থিক লেনদেন নিয়ে বিরোধে সব পক্ষের সম্মতিতে সালিশ হতে পারে। কিন্তু ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তির সুযোগ নেই। মানবাধিকার কর্মীরা বহুদিন ধরেই বলে আসছেন, আইন ও বিচারবহির্ভূত সালিশের বিরুদ্ধে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার ও ধর্ষণসংক্রান্ত আইন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের দিক থেকে দৃশ্যমান কার্যক্রম নজরে আসছে না।
শিশু ও নারীর প্রতি নির্যাতন রোধে আইনানুগ সালিশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পারিবারিক সমস্যা সমাধানে সালিশে আদালতেরও অনুমোদন আছে। ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে সালিশের আয়োজন বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইনের প্রতি অবজ্ঞা ও আস্থাহীনতাই প্রকাশ করে।
কেবল অবৈধ সালিশ বন্ধ নয়; নারী ফুটবলার কিংবা চিত্রনায়িকাদের জনপরিসরে অংশগ্রহণের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায়ও অন্তর্বর্তী সরকারের আশু দৃষ্টি প্রয়োজন। অন্যথায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের স্বপ্ন অধরাই রয়ে যাবে।
তানিয়া খাতুন: মানবাধিকার কর্মী
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ঘটন য় আইন র র ঘটন ফ টবল
এছাড়াও পড়ুন:
রাশিয়ার কাছাকাছি দুটি পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েনের নির্দেশ ট্রাম্পের
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের ‘অত্যন্ত উস্কানিমূলক’ মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় দুটি পারমাণবিক সাবমেরিন ‘যথাযথ অঞ্চলে মোতায়েন’ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
শুক্রবার (১ আগস্ট) ট্রুথ সোশ্যালে একটি পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, “ওই মন্তব্য় যদি নেহাতই বোকামি ও উস্কানিমূলক বক্তব্য না হয়ে, তার থেকে বেশি কিছু হয়, তাই আমি দুটি পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছি।” খবর বিবিসির।
ট্রাম্প আরো লিখেছেন যে, “শব্দগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রভাবও অপ্রত্যাশিত হতে পারে। তবে আশা করি এই বিবৃতি তেমন কিছু ঘটাবে না।”
আরো পড়ুন:
পুতিনকে এবার ১০ দিনের আল্টিমেটাম দিলেন ট্রাম্প
পুতিনকে এবার ১২ দিনের আল্টিমেটাম দিলেন ট্রাম্প
মার্কিন সামরিক প্রোটোকল মেনে দুটি সাবমেরিন কোথায় মোতায়েন করা হচ্ছে, তা তিনি বলেননি।
একদিন আগেই ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে মস্কোকে আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এরপরই প্রতিক্রিয়া দেন মেদভেদেভ।
পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় জানিয়ে শুক্রবার ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, “রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ, যিনি বর্তমানে রাশিয়ান ফেডারেশনের নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান, তার অত্যন্ত উস্কানিমূলক বক্তব্যের ভিত্তিতে, আমি দুটি পারমাণবিক সাবমেরিনকে উপযুক্ত অঞ্চলে মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছি।”
ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া পোস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পারমাণবিক চালিত নাকি পারমাণবিক অস্ত্রধারী সাবমেরিনের মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছেন, তা খোলাসা করেননি।
রাশিয়া এবং আমেরিকার কাছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র আছে এবং উভয় দেশেরই পারমাণবিক সাবমেরিনের বহর রয়েছে।
শুক্রবার পরবর্তীতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ট্রাম্প বলেন, “একটি হুমকি দেওয়া হয়েছিল এবং আমরা এটিকে উপযুক্ত মনে করিনি। তাই আমাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে।”
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, “আমি মার্কিন জনগণের নিরাপত্তার ভিত্তিতে এটি করেছি। রাশিয়ার একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট হুমকি দিয়েছিলেন। এবং আমরা আমাদের জনগণকে রক্ষা করব।”
ক্রেমলিন এখনও পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো প্রকাশ্য মন্তব্য করেনি, তবে ট্রাম্পের বক্তব্যের পর মস্কোর শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে।
সম্প্রতি ট্রাম্প এবং মেদভেদেভ সোশ্যাল মিডিয়ায় একে অপরের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যক্তিগত আক্রমণে জড়িয়ে পড়েছেন।
ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার জন্য ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দুই দফায় নতুন করে সময় বেধে দিয়েছেন, তবে যুদ্ধ থামানোর কোনো লক্ষণ পুতিন এখনও দেখাননি।
মেদভেদেভ- যিনি ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন- এই সপ্তাহের শুরুতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ‘রাশিয়ার সঙ্গে আল্টিমেটাম খেলা’ খেলার অভিযোগ করেছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে মেদভেদেভ বলেছিলেন, “প্রতিটি নতুন আল্টিমেটাম একটি হুমকি এবং যুদ্ধের দিকে একটি পদক্ষেপ।”
এর আগে, তিনি জুলাইয়ের শুরুতে তিনি ট্রাম্পের আল্টিমেটামকে ‘নাটকীয়’ বলে অভিহিত করে বলেছিলেন, “রাশিয়া এসবের পরোয়া করে না।”
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) টেলিগ্রামে একটি পোস্টে মেদভেদেভ ট্রাম্পকে রাশিয়ার ‘ডেড হ্যান্ড’ সম্পর্কে সতর্ক করেন। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘ডেড হ্যান্ড’ হলো রাশিয়ার প্রতিশোধমূলক পারমাণবিক হামলা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কোডনাম।
এরপরই শুক্রবার ট্রাম্প মেদভেদেভের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় প্রথমবারের মতো প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি মেদভেদেভকে ‘রাশিয়ার ব্যর্থ সাবেক প্রেসিডেন্ট, নিজেকে এখনো প্রেসিডেন্ট বলে ভাবেন’ বলে কটাক্ষ করেন।
ট্রাম্প মেদভেদেভকে ‘তার কথার দিকে নজর রাখার’ বিষয়ে সতর্কও করে বলেন, “তিনি খুব বিপজ্জনক অঞ্চলে প্রবেশ করছেন!”
মেদভেদেভ ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আক্রমণকে সমর্থন করেন এবং পশ্চিমাদের একজন স্পষ্ট সমালোচক।
ঢাকা/ফিরোজ