‘নট আ গুড ফ্রেন্ড বাট চ্যাম্পিয়ন মেট’
Published: 10th, March 2025 GMT
আলোর বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তখন কেবল ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ গান চলছে। টিভির পর্দায় যতটুকু দেখা ও বোঝা যায় ততটুকুই অবলম্বন।
এমনিতেই দুবাই রাতের নগরী। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজসিক দুবাইয়ের সৌন্দর্য ফুটে উঠে। উচুঁ উচুঁ দালানে কেবল আলোর ঝলকানি। এমন নগরীতেই ভারতের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপা উদযাপন আনন্দ বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুন। আতশবাজি পোড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাতের আকাশ হয়ে উঠে আরো ঝলমলে। ওই আলোয় ২২ গজে মেন ইন ব্লু জার্সিতে দুজনকে ‘গারবা ডান্স’ করতে দেখা আশ্চর্যজনক ঘটনা।
নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপা জেতার পর রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলির ভাগ্যে একটি করে স্ট্যাম্প জুটে। ওই দুই স্ট্যাম্প নিয়ে দুই কিংবদন্তির ‘গারবা ডান্স’ চলে কিছুক্ষণ। নবরাত্রি উপলক্ষ্যে ভারতে গারবা ডান্স বেশ প্রসিদ্ধ। অতি প্রিয় দুজন মানুষের সঙ্গে দুই লাঠি হাতে চলে এই ডান্স।
ভাববেন না, রোহিত-বিরাটের বেশ মাখামাখি সম্পর্ক বা তারা দুজন দুজনের অতি প্রিয়। কিন্তু মিশন সাকসেসফুল হওয়ার পর দুজনের গারবা ডান্স মনে করিয়ে দেয় প্লুটোর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘‘বন্ধুদের মধ্যে সবকিছুতেই একতা থাকে।’’ বিরাট ও রোহিতের বন্ধুত্ব তেমনই। মাঠের ভেতরে তাদের সবকিছুতে একতা। মাঠের বাইরে সম্পর্কটা কেবল সম্মানের। এর এক চুল বেশি-ও নয়। কমও নয়।
তাই-তো টানা দুই আইসিসি ইভেন্ট জয়ের পর তারা বলতে পারেন, ‘‘নট আ গুড ফ্রেন্ড বাট চ্যাম্পিয়ন মেট।’’
মাহেন্দ্র সিং ধোনি দায়িত্ব ছাড়ার পর পরম্পরা ধরে রেখে বিসিসিআই সহ অধিনায়ক বিরাট কোহলিকে ভারতের দায়িত্ব দেয়। বিশ্ব ক্রিকেটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বিরাটের প্রাপ্তির খাতাও টইটুম্বুর। কিন্তু আইসিসি ইভেন্টে শিরোপা ছোঁয়া হয় না তার। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, ২০১৯ বিশ্বকাপ। শূন্য হাতে অধিনায়ক বিরাটকে বিদায় নিতে হয়েছিল। হেরেছিলেন আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালও।
তার থেকে অধিনায়কত্ব ছিনিয়ে নিয়ে রোহিতকে অধিনায়ক করেছিলেন ভারতের মহারাজ খ্যাত সৌরভ গাঙ্গুলি। ‘দাদা’ তখন বিসিসিআইয়ের সভাপতি। রোহিতকে অধিনায়ক করার পেছনে গাঙ্গুলির কারণ ছিল দুইটি। এক, রোহিতের শিরোপা ভাগ্য যা আইপিএলে দেখা গেছে অনেকবার। দ্বিতীয়ত, বিরাটকে আরো নির্ভার করে দেওয়া।
তাতে সুফল মিলেছে। ২০২৪ সালে ভারত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতে রোহিতের নেতৃত্বে। এবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। ২০২৩ সালে ঘরের মাঠে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া বাধা টপকাতে পারেনি। নয়তো টানা তিন বছর ভারতের শোকেসে উঠত তিন শিরোপা।
তাদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে ফিসফাস আজকের না। বেশির ভাগের মত, ভারতীয় অধিনায়কের সঙ্গে রোহিতের সম্পর্কটা বিরোধপূর্ণ। এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার কথা বলতে হয়েছে ভারতের সাবেক ক্রিকেট দলের কোচ রবি শাস্ত্রীকে।
তবে সেসবকে পাশ কাটিয়ে মাঠের সবুজ ঘাসে, ২২ গজের উইকেটে তাদের বোঝপড়া দেখে বোঝার উপায় আছে মাঠের বাইরে সম্পর্কটা নিবিড় নয়। সেটা জরুরী নাকি সেটাও বিরাট প্রশ্নের। যে ধারাবাহিকতায় ভারতীয় ক্রিকেট এগিয়ে যাচ্ছে এবং সাফল্য পাচ্ছে তাতে একটি বিষয় তো স্পষ্ট, ব্যাট-বলের মজবুত রসায়নের বাইরে কিছুর প্রয়োজন নেই। সেটাই করে যাচ্ছে রোহিত ও বিরাট।
ভারতীয় গণমাধ্যম তাদের জুটির নাম দিয়েছে ‘রোকো’। রোহিতের ‘রো’, কোহলির ‘কো।’ মিলিয়ে রোকো। ২০১৩ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জেতা হয়েছে ‘রোকো’ জুটির। সামনে কী হবে তা সময় বলে দেবে। আপতত, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ের আনন্দে ভারতবর্ষ ডুবে থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঢাকা/ইয়াসিন
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন
দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।
নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।
মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।
ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।
শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।
চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।
কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।
পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।
ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।
এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।