জাতীয় জাদুঘরে মহান মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শনগুলো নতুন করে সাজানো হচ্ছে। নিদর্শনগুলো রয়েছে তিনটি গ্যালারিতে। এর মধ্যে ৩৮ ও ৩৯ নম্বর গ্যালারির কাজ শেষ, ৪০ নম্বরের নতুন বিন্যাস শুরু হয়েছে। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সমন্বয় করে নিদর্শন পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে।

জাতীয় জাদুঘরের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় সব নিদর্শন প্রদর্শন করা হয়েছে। মোট গ্যালারি ৪৫টি। প্রদর্শিত নিদর্শনের সংখ্যা ৪ হাজারের বেশি। তবে সংগৃহীত নিদর্শনের সংখ্যা আরও অনেক। সব নিদর্শন প্রদর্শন করা হয় না। সেগুলো সংরক্ষিত থাকে।

জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে তৃতীয় তলার ৩৮, ৩৯ ও ৪০ নম্বর গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এতে মোট নিদর্শন ছিল ৬১৭টি।

‘বাঙালি, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ’

গ্যালারিগুলোর মধ্যে ৩৮ নম্বর একটু ব্যতিক্রমী। এটির নাম ‘বাঙালি, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ’। গ্যালারিটি অনেক বড়। এখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দিয়ে। এক পাশের দেয়ালে ছাদ থেকে মেঝে অবধি বিশালাকার সাদা–কালো আলোকচিত্র রাখা। এর মধ্যে আছে ভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ-মিছিল; ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফটকের সামনে ছাত্রসমাবেশের ছবিও। ভাষা আন্দোলনের এমন বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ছবি রয়েছে দেয়ালজুড়ে। আগে এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের একটি বড় ছবি ছিল। ১৮ মার্চ গিয়ে দেখা যায়, ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দেশের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সে কারণে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সমন্বয় করে নিদর্শন পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। মো.

সাইফুল ইসলাম, জাতীয় জাদুঘরের সচিব

এই গ্যালারির নিচের তলায় দর্শকেরা দেখতে পাবেন ভাষাশহীদ আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন, আবদুস সালাম, সফিউর রহমান, আবুল বরকতের আবক্ষ ভাস্কর্য। আরও দেখা যাবে, শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের লাল রঙের ফেজ টুপি, শহীদ সফিকুর রহমানের জুতা, রক্তমাখা শার্ট ও কোট; শহীদ আসাদের ভাস্কর্য; মাওলানা ভাসানীর ব্যবহৃত তালের আঁশের টুপি, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের বিমানবাহিনীর ট্রফি; শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের হারমোনিয়াম। এ ছাড়া আছে সেই সময়ের বিভিন্ন আলোকচিত্র, পত্রপত্রিকা, স্মরণিকাসহ বিভিন্ন নিদর্শন।

গ্যালারির একটি কোণে তৈরি করা হয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের স্টুডিওর আদলে কর্নার। সেখানে আছে ট্রানজিস্টর, বাদ্যযন্ত্র, ‘চরমপত্র’খ্যাত এম আর আখতার মুকুল ও ‘পিণ্ডির প্রলাপ’ কথিকার লেখক সাংবাদিক তোয়াব খানের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিসহ মোট ২৫টি নিদর্শন।

এই গ্যালারির দ্বিতীয় তলায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অনেক ছবি, বিদেশি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রতিবেদন। আছে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত রাইফেল, কামানসহ অনেক যুদ্ধাস্ত্র; মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত বিমানের অংশবিশেষ; ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র; আলবদর বাহিনী গঠনের প্রতিবেদন; বেশ কিছু আলবদর সদস্যের পরিচিতি ও সনদপত্র; শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়া খানের প্রতিকৃতি অবলম্বনে তৈরি বিখ্যাত পোস্টার ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’। আরও আছে পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের ব্যবহৃত বিদ্যুতের শক দিয়ে নির্যাতন করার যন্ত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাবে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সময়ের রক্তমাখা কার্পেট।

এই গ্যালারিতে দর্শকেরা আরও দেখবেন সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতীক, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর ছবি ও তাঁর ব্যবহৃত নিদর্শন; যুদ্ধের সময়ের সামরিক মানচিত্র, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ব্যবহৃত ফুটবল, জার্সি; পতাকা; জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের সামরিক টুপি, ছড়ি; জেড ফোর্সের প্রতীকসহ বিভিন্ন নিদর্শন। গ্যালারির শেষে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক টেবিল, যার ওপর আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। এ গ্যালারিতে এখন মোট নিদর্শন আছে ২৪৩টি।

গ্যালারি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা যদি করা হয়, তবে ঠিক হয়নি। এটা ইতিহাস বিকৃতি। আমরা পক্ষপাতহীন স্বাধীন চিন্তাশীল দৃষ্টিতে ইতিহাস দেখতে চাই। সেখানে শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা রয়েছে। তাঁদের মধ্যে শেরেবাংলা ও মাওলানা ভাসানী প্রথম পর্যায়ের সংগ্রামী চেতনার বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমান পরিপক্ব পরিবেশে আন্দোলনকে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। কাজেই যদৃচ্ছভাবে কারও ছবি সরিয়ে ফেলা বা অবদান অস্বীকার করা ঠিক নয়।

গণহত্যা ও নির্যাতন

‘গণহত্যা ও নির্যাতন’ নামের ৩৯ নম্বর গ্যালারিতে মোট নিদর্শন রয়েছে ২৬৯টি। এর মধ্যে আছে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের খুলি; সাত বীরশ্রেষ্ঠর আবক্ষ ভাস্কর্য; বীরশ্রেষ্ঠদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী; কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভাঙা অংশ, যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র ইত্যাদি।

এ গ্যালারির বেশ বড় অংশজুড়ে রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি, পরিচিতি ও তাঁদের ব্যবহৃত অনেক সামগ্রী। এতে আছে মুনীর চৌধুরীর টাইপরাইটার, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর কোট, ডা. আলীম চৌধুরীর অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি। স্মৃতিময় এসব নিদর্শন সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া গ্যালারির দেয়ালে রয়েছে রণাঙ্গনের ছবি, দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনের বড় বড় ডিজিটাল প্রিন্টসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক তথ্য-উপাত্ত।

পুনর্বিন্যাসের কাজ চলছে

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শেষ গ্যালারিটির নম্বর ৪০। গত বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা গেল, এটির নতুন বিন্যাসের কাজ চলছে। আগে নাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’। এতে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী, জাতীয় চার নেতার ব্যবহৃত সামগ্রী, জাতীয় সংসদের কপি, আলোকচিত্রসহ ১০৫টি নিদর্শন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিষয়ক গ্যালারিগুলোর পুনর্বিন্যাস বিষয়ে জাতীয় জাদুঘরের সচিব মো. সাইফুল ইসলাম গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের প্রতিটি জাদুঘরেই যত নিদর্শন সংগৃহীত থাকে, তার সব প্রদর্শন করা হয় না। জাদুঘরের স্থায়ী গ্যালারিগুলোতে বিভিন্ন সময় নিদর্শনগুলোর পরিবর্তন, নতুন করে বিন্যাস করা হয়। আবার অনেক সময় বিষয়ভিত্তিক বিশেষ প্রদর্শনী করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের নিদর্শনগুলো প্রদর্শন করা হয়। এটি চলমান প্রক্রিয়া।

মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দেশের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সে কারণে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সমন্বয় করে নিদর্শন পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ খ ম জ ব র রহম ন র জ ত য় জ দ ঘর দ র ব যবহ ত ব ন য স কর জ দ ঘর র প রদর শ র একট

এছাড়াও পড়ুন:

এপ্রিলে ডেঙ্গু রোগী মার্চের দ্বিগুণ

চলতি বছরের মার্চ মাসের চেয়ে সদ্য শেষ হওয়া এপ্রিলে দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি ছিল। গত চার মাসে দেশে যে পরিমাণ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, গত বছরের প্রথম চার মাসে তা হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের বছর ২০২৩ সালের প্রথম চার মাসেও ডেঙ্গুতে এত আক্রান্ত রোগী ছিলেন না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ মার্চ মাসে করা জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার বাইরে বাড়লেও ডেঙ্গুর শূককীট বা লার্ভার পরিমাণ বেশ কমেছে আগের জরিপের সময়ের চেয়ে। তবে এপ্রিল মাসে দেশজুড়ে থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টি লার্ভার পরিমাণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। চলতি মে মাসেও এমন ধারার বৃষ্টির প্রবণতা আছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর বিস্তার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদেরা। তাঁদের কথা, যদি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবার ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৫৭২। গত বছরের প্রথম ৪ মাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮৭৫।

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংক্রমণের বছর ২০২৩ সালে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এডিস মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ১ হাজার ৭০৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে রোগীর সংখ্যা আগের বছরের এক-তৃতীয়াংশের বেশি কমে যায়। মৃত্যুর সংখ্যাও তেমন হারেই কমে।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৫৭২। গত বছরের প্রথম ৪ মাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮৭৫।

সদ্য শেষ হওয়া এপ্রিল মাসে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৭০১। মার্চ মাসে এ সংখ্যা ছিল ৩৩৬।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের সঙ্গে এ বছরের তুলনা করলে দেখা যায়, এবার প্রতি মাসে আগের বছরের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের এপ্রিল মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৫০৪ জন। গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন যথাক্রমে ১ হাজার ৫৫, ৩৩৯ ও ৩১১ জন। এবার এই ৩ মাসে রোগীর সংখ্যা যথাক্রমে ১ হাজার ১৬১, ৩৭৪ ও ৩৩৬।

এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে প্রতি মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এটা ভালো ইঙ্গিত বহন করছে না। ডেঙ্গু আমাদের কাছে অপরিচিত রোগ নয়। কিন্তু এর ব্যবস্থাপনা এখন পর্যন্ত ভালো হয়নি। এবারের ঊর্ধ্বগতি ডেঙ্গুর প্রকৃত মৌসুম অর্থাৎ বর্ষাকালে সংক্রমণের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলার আশঙ্কা রেখে যাচ্ছে।জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন

নিছক সংখ্যা দিয়ে রোগের সম্ভাব্য প্রাদুর্ভাব নির্ণয় করা যায় না, এমন কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সংখ্যা নিঃসন্দেহে কিছু ইঙ্গিত বহন করে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে প্রতি মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এটা ভালো ইঙ্গিত বহন করছে না। ডেঙ্গু আমাদের কাছে অপরিচিত রোগ নয়। কিন্তু এর ব্যবস্থাপনা এখন পর্যন্ত ভালো হয়নি। এবারের ঊর্ধ্বগতি ডেঙ্গুর প্রকৃত মৌসুম অর্থাৎ বর্ষাকালে সংক্রমণের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলার আশঙ্কা রেখে যাচ্ছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ