জাতীয় জাদুঘরে নতুন বিন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের গ্যালারি
Published: 26th, March 2025 GMT
জাতীয় জাদুঘরে মহান মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শনগুলো নতুন করে সাজানো হচ্ছে। নিদর্শনগুলো রয়েছে তিনটি গ্যালারিতে। এর মধ্যে ৩৮ ও ৩৯ নম্বর গ্যালারির কাজ শেষ, ৪০ নম্বরের নতুন বিন্যাস শুরু হয়েছে। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সমন্বয় করে নিদর্শন পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে।
জাতীয় জাদুঘরের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় সব নিদর্শন প্রদর্শন করা হয়েছে। মোট গ্যালারি ৪৫টি। প্রদর্শিত নিদর্শনের সংখ্যা ৪ হাজারের বেশি। তবে সংগৃহীত নিদর্শনের সংখ্যা আরও অনেক। সব নিদর্শন প্রদর্শন করা হয় না। সেগুলো সংরক্ষিত থাকে।
জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে তৃতীয় তলার ৩৮, ৩৯ ও ৪০ নম্বর গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এতে মোট নিদর্শন ছিল ৬১৭টি।
‘বাঙালি, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ’
গ্যালারিগুলোর মধ্যে ৩৮ নম্বর একটু ব্যতিক্রমী। এটির নাম ‘বাঙালি, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ’। গ্যালারিটি অনেক বড়। এখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দিয়ে। এক পাশের দেয়ালে ছাদ থেকে মেঝে অবধি বিশালাকার সাদা–কালো আলোকচিত্র রাখা। এর মধ্যে আছে ভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ-মিছিল; ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফটকের সামনে ছাত্রসমাবেশের ছবিও। ভাষা আন্দোলনের এমন বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ছবি রয়েছে দেয়ালজুড়ে। আগে এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের একটি বড় ছবি ছিল। ১৮ মার্চ গিয়ে দেখা যায়, ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দেশের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সে কারণে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সমন্বয় করে নিদর্শন পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। মো.সাইফুল ইসলাম, জাতীয় জাদুঘরের সচিব
এই গ্যালারির নিচের তলায় দর্শকেরা দেখতে পাবেন ভাষাশহীদ আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন, আবদুস সালাম, সফিউর রহমান, আবুল বরকতের আবক্ষ ভাস্কর্য। আরও দেখা যাবে, শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের লাল রঙের ফেজ টুপি, শহীদ সফিকুর রহমানের জুতা, রক্তমাখা শার্ট ও কোট; শহীদ আসাদের ভাস্কর্য; মাওলানা ভাসানীর ব্যবহৃত তালের আঁশের টুপি, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের বিমানবাহিনীর ট্রফি; শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের হারমোনিয়াম। এ ছাড়া আছে সেই সময়ের বিভিন্ন আলোকচিত্র, পত্রপত্রিকা, স্মরণিকাসহ বিভিন্ন নিদর্শন।
গ্যালারির একটি কোণে তৈরি করা হয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের স্টুডিওর আদলে কর্নার। সেখানে আছে ট্রানজিস্টর, বাদ্যযন্ত্র, ‘চরমপত্র’খ্যাত এম আর আখতার মুকুল ও ‘পিণ্ডির প্রলাপ’ কথিকার লেখক সাংবাদিক তোয়াব খানের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিসহ মোট ২৫টি নিদর্শন।
এই গ্যালারির দ্বিতীয় তলায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অনেক ছবি, বিদেশি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রতিবেদন। আছে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত রাইফেল, কামানসহ অনেক যুদ্ধাস্ত্র; মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত বিমানের অংশবিশেষ; ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র; আলবদর বাহিনী গঠনের প্রতিবেদন; বেশ কিছু আলবদর সদস্যের পরিচিতি ও সনদপত্র; শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়া খানের প্রতিকৃতি অবলম্বনে তৈরি বিখ্যাত পোস্টার ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’। আরও আছে পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের ব্যবহৃত বিদ্যুতের শক দিয়ে নির্যাতন করার যন্ত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাবে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সময়ের রক্তমাখা কার্পেট।
এই গ্যালারিতে দর্শকেরা আরও দেখবেন সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতীক, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর ছবি ও তাঁর ব্যবহৃত নিদর্শন; যুদ্ধের সময়ের সামরিক মানচিত্র, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ব্যবহৃত ফুটবল, জার্সি; পতাকা; জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের সামরিক টুপি, ছড়ি; জেড ফোর্সের প্রতীকসহ বিভিন্ন নিদর্শন। গ্যালারির শেষে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক টেবিল, যার ওপর আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। এ গ্যালারিতে এখন মোট নিদর্শন আছে ২৪৩টি।
গ্যালারি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা যদি করা হয়, তবে ঠিক হয়নি। এটা ইতিহাস বিকৃতি। আমরা পক্ষপাতহীন স্বাধীন চিন্তাশীল দৃষ্টিতে ইতিহাস দেখতে চাই। সেখানে শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা রয়েছে। তাঁদের মধ্যে শেরেবাংলা ও মাওলানা ভাসানী প্রথম পর্যায়ের সংগ্রামী চেতনার বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমান পরিপক্ব পরিবেশে আন্দোলনকে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। কাজেই যদৃচ্ছভাবে কারও ছবি সরিয়ে ফেলা বা অবদান অস্বীকার করা ঠিক নয়।
গণহত্যা ও নির্যাতন
‘গণহত্যা ও নির্যাতন’ নামের ৩৯ নম্বর গ্যালারিতে মোট নিদর্শন রয়েছে ২৬৯টি। এর মধ্যে আছে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের খুলি; সাত বীরশ্রেষ্ঠর আবক্ষ ভাস্কর্য; বীরশ্রেষ্ঠদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী; কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভাঙা অংশ, যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র ইত্যাদি।
এ গ্যালারির বেশ বড় অংশজুড়ে রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি, পরিচিতি ও তাঁদের ব্যবহৃত অনেক সামগ্রী। এতে আছে মুনীর চৌধুরীর টাইপরাইটার, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর কোট, ডা. আলীম চৌধুরীর অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি। স্মৃতিময় এসব নিদর্শন সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া গ্যালারির দেয়ালে রয়েছে রণাঙ্গনের ছবি, দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনের বড় বড় ডিজিটাল প্রিন্টসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক তথ্য-উপাত্ত।
পুনর্বিন্যাসের কাজ চলছে
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শেষ গ্যালারিটির নম্বর ৪০। গত বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা গেল, এটির নতুন বিন্যাসের কাজ চলছে। আগে নাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’। এতে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী, জাতীয় চার নেতার ব্যবহৃত সামগ্রী, জাতীয় সংসদের কপি, আলোকচিত্রসহ ১০৫টি নিদর্শন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিষয়ক গ্যালারিগুলোর পুনর্বিন্যাস বিষয়ে জাতীয় জাদুঘরের সচিব মো. সাইফুল ইসলাম গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের প্রতিটি জাদুঘরেই যত নিদর্শন সংগৃহীত থাকে, তার সব প্রদর্শন করা হয় না। জাদুঘরের স্থায়ী গ্যালারিগুলোতে বিভিন্ন সময় নিদর্শনগুলোর পরিবর্তন, নতুন করে বিন্যাস করা হয়। আবার অনেক সময় বিষয়ভিত্তিক বিশেষ প্রদর্শনী করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের নিদর্শনগুলো প্রদর্শন করা হয়। এটি চলমান প্রক্রিয়া।
মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দেশের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সে কারণে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সমন্বয় করে নিদর্শন পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ খ ম জ ব র রহম ন র জ ত য় জ দ ঘর দ র ব যবহ ত ব ন য স কর জ দ ঘর র প রদর শ র একট
এছাড়াও পড়ুন:
পাল্টাপাল্টি হামলার তীব্রতা বাড়ল
ইরান ও ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা ঘিরে আরও অশান্ত হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হামলার তীব্রতা বাড়াচ্ছে দুই দেশ। ইসরায়েলে গত শনিবার রাতভর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। একই রাতে ইরানের গ্যাসক্ষেত্র ও তেল শোধনাগারে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ হামলায় ইরানের কতজন নিহত হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি।
গতকাল রোববার ছিল দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হামলার তৃতীয় দিন। শনিবার রাতের পর রোববার দিনের বেলায়ও পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল ও ইরান। এদিন ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা জানিয়েছে ইয়েমেনের সশস্ত্র
গোষ্ঠী হুতি। চলমান সংঘাতে এই প্রথম ইরানপন্থী কোনো গোষ্ঠী যোগ দিল। এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশকে শান্ত করার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ।
গতকাল রাত একটায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছিল। এ রাতেও তেহরানের নিয়াভারান, ভালিয়াসর ও হাফতে তির স্কয়ার এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ইরানের পূর্বাঞ্চলে মাশহাদ বিমানবন্দরে একটি ‘রিফুয়েলিং’ উড়োজাহাজে আঘাত হানার কথা জানায় ইসরায়েলি বাহিনী। এই উড়োজাহাজগুলো আকাশে থাকা অবস্থায় অন্য উড়োজাহাজে জ্বালানি সরবরাহ করতে সক্ষম। ইরান থেকেও ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার খবর পাওয়া গেছে।
ইসরায়েলে ব্যাপক হামলা ইরানেরইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ঠেকানোর কথা বলে গত বৃহস্পতিবার রাতে দেশটিতে প্রথমে হামলা চালায় ইসরায়েল। ওই রাতে ইসরায়েলের দুই শতাধিক যুদ্ধবিমান ইরানের ‘পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র’ স্থাপনায় আঘাত হানে। শুক্র ও শনিবারও ইরানে হামলা চলে। পাল্টা জবাব দিচ্ছে তেহরানও। তবে ইসরায়েলে শনিবার রাতভর ইরান যে হামলা চালিয়েছে, তা ছিল সবচেয়ে ব্যাপক।
ইসরায়েলে শনিবার প্রথম দফায় ইরানের হামলা শুরু হয় রাত ১১টার পরপর। এ সময় ইসরায়েলের জেরুজালেম ও হাইফা শহরে বেজে ওঠে সাইরেন। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাইফায় অবস্থিত তেল শোধনাগার। পরে রাত আড়াইটার দিকে দ্বিতীয় দফায় হামলা শুরু করে ইরান। তখন তেল আবিব ও জেরুজালেমে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, শনিবার রাতে দুই দফায় ৭৫টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। প্রথম দফায় ছোড়া হয় ৪০টি। এতে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের তামরা শহরে চারজন নিহত হন। দ্বিতীয় দফায় ছোড়া হয় ৩৫টি ক্ষেপণাস্ত্র। এর একটি আঘাত হানে তেল আবিবের কাছে বাত ইয়াম এলাকায়। এতে অন্তত ছয়জন নিহত ও প্রায় ২০০ জন আহত হন। এ ছাড়া রেহভোত শহরে আহত হয়েছেন ৪০ জন।
ইসরায়েলি হামলায় জ্বলছে ইরানের শাহরান তেলের ডিপো। গতকাল দেশটির রাজধানী তেহরানের কাছে।