খাদ্যের সন্ধানে মৌলভীবাজারে শামুকখোলের দল
Published: 26th, March 2025 GMT
খাদ্যের সন্ধানে শামুকখোল পাখি দলবেঁধে এসেছে মৌলভীবাজারের ডোবা-নালা ও ক্ষেতের মাঠে। উপযুক্ত পরিবেশ পর্যাপ্ত খাবার ও প্রজনন সুবিধার কারণে জেলার আনাচে-কানাচে এখন শামুকখোলের দেখা মিলছে অহরহ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শামুকখোল এখন দেশের বিভিন্ন খাল-বিল এবং নদীর কাছাকাছি এলাকাগুলোতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। এরা প্রজনন শেষে আর দেশের বাইরে যাচ্ছে না। ফলে দেশের আনাচে-কানাচে সহজেই এ পাখির দেখা পাওয়া যাচ্ছে।
শামুকখোল এশিয়া মহাদেশের আদি প্রজাতির একটি পাখি। এর বৈজ্ঞানিক নাম-Anastomus oscitans.
বন্যপ্রাণি সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক স্বপন দেব সজল বলেন, ‘‘শামুকখোল পাখি মূলত আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালীন সময়ে আসত। এজন্য এদের পরিযায়ী পাখি বলা হতো। কিন্তু এখন এরা বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তাই এদের দেশীয় পাখি হিসেবে গণ্য করা হয়।”
মৌলভীবাজারের কাওয়াদীঘী হাওর পাড়ের বাসিন্দা মোস্তফা মিয়া বলেন, ‘‘বাংলাদেশের হাওড়-বিল ঝিল, নদী-নালায় শামুকখোল কলোনি স্থাপন করেছে। বিশেষ করে দেশের উত্তরের জেলাগুলোতে বাঁধাহীনভাবে শামুকখোল এখন উন্মুক্ত আকাশে উড়ছে।’
‘এছাড়াও সিলেটের টাংগুয়ার হাওর, হাকালুকি, কাওয়াদীঘি ও হাইলহাওর এলাকায় এখন শামুকখোল দলে দলে প্রজনন করছে। সৌখিন শিকারিরা মাঝে মাঝে বন্দুক দিয়ে শিকার করায় এরা এলাকা ছেড়ে চলে যায়।”
তিনি বলেন, “এ পাখির ঠোঁটের সঙ্গে অন্য কোনো পাখির ঠোঁটের মিল নেই। শামুকখোল পাখির ঠোঁটের নিচের অংশের সঙ্গে ওপরের অংশে বড় ফাঁক। এরা এ বিশেষ ঠোঁটে শামুক তুলে চাপ দিয়ে শামুকের ঢাকনা খুলে ভিতরের নরম অংশ খেয়ে নেয়। মূলত শামুকের ঢাকনা খোলার শৈল্পিক কৌশলের কারণেই এ পাখির নামকরণ করা হয়েছে শামুকখোল পাখি।”
পাখি বিশেষজ্ঞ ড. মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘‘দেশে শামুকখোল পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তীব্র খরার কারণে এ পাখির প্রজনন খুবই কম হচ্ছে। বিগত কয়েক দশকে কিছু কিছু দেশে আশঙ্কাজনক হারে শামুক খোলের সংখ্যাও কমেছে। ফলে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রকৃতি সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ আইইউসিএন এ পাখিটিকে ন্যুনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে।”
তিনি বলেন, ‘‘এদিকে খাল-বিল এবং আবাদি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে দেশেও শামুকখোল পাখিসহ অন্যান্য প্রাণিকূল হুমকির মধ্যে রয়েছে। কীটনাশকের ফলে দেশীয় অনেক প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির পথে।”
ঢাকা/আজিজ/এস
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের বড় গেছো প্যাঁচা
শরতের সুন্দরবন দেখার প্রত্যয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে খুলনা থেকে ছোট্ট লঞ্চ গাংচিলযোগে শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা হলাম। কিন্তু ঢাংমারীতে লঞ্চে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় শেখেরটেক পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। কটকা ও কচিখালীর তুলনায় এখানে পর্যটকদের আনাগোনা কম। শেখেরটেকে একটি কালীমন্দির রয়েছে। মন্দিরের আশপাশে বাঘের আনাগোনা বেশি। কিন্তু আমরা এবার ‘মামা’র খোঁজে আসিনি, এসেছি দুটি বিরল পাখির সন্ধানে। তবে লঞ্চ থেকে নেমেই মামার পায়ের তাজা ছাপ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। সম্ভবত গত রাতে সে এখান দিয়ে হেঁটে গেছে।
একটি ছোট্ট বিরল পাখির খোঁজে টাওয়ারে যাওয়ার রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে আছি। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। কিন্তু মুহূর্তেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মাথায় দু-তিনটি বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই পাখি খোঁজা রেখে ক্যামেরা বাঁচাতে টাওয়ারের দিকে দৌড় দিলাম। বৃষ্টি থামলে মন্দিরের দিকে গেলাম। কিন্তু বহুক্ষণ খুঁজেও দেখা পেলাম না। অথচ এর আগে অনেকেই এই দুটি স্থানে পাখিটির দেখা পেয়েছেন। কিন্তু বারবার রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরির খেলায় আমরা পাখিটি দেখতে ব্যর্থ হয়ে লঞ্চে ফিরে এলাম।
কিছুক্ষণ পর চারদিক অন্ধকার হয়ে সন্ধ্যা নামল। ক্যামেরা হাতে লঞ্চের সামনে যে যার মতো পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম নিশাচর এক বিরল পাখির খোঁজে। চারদিক সুনসান। ছোট্ট একটি ডিভাইসে পাখিটির কল (ডাক) বাজছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর শেখেরটেক খালের অন্য পাড় থেকে ডাকের প্রতি–উত্তর পাওয়া গেল। ডাকের উৎসের দিকে টর্চ ফেলে পাখিটিকে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু খুঁজে পেলাম না।
প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টার পর পাখিটির অবস্থান শনাক্ত করা গেল পন্টুনের পাশে একটি বড় গাছে। খুব সাবধানে লঞ্চ থেকে পন্টুনে নামলাম। কিন্তু পাখিটি টের পেয়ে উড়ে গিয়ে অন্য একটি গাছে বসল। বুঝতে পারলাম সে বারবার গাছ বদল করবে। কাজেই নৌকা ছাড়া ওর কাছাকাছি যাওয়া যাবে না। লঞ্চের সঙ্গে নিয়ে আসা নৌকায় উঠে পাখিটি যে গাছে বসেছে, সেদিকে গেলাম। রাত ৯টা ২৮ মিনিট ১২ সেকেন্ডে পাখিটির প্রথম ছবি তুললাম। কিন্তু মাত্র ২৯ সেকেন্ড সময় দিয়ে পাখিটি উড়াল দিল। দ্বিতীয়বার পাখিটির ছবি তুললাম রাতের খাবার সেরে আরও দুই ঘণ্টা পর ঠিক রাত ১২টায়।
সুন্দরবনের শেখেরটেকে দেখা প্যাঁচাটি এ দেশের বিরল আবাসিক পাখি বড় গেছো প্যাঁচা। ইংরেজি নাম ব্রাউন উড আউল। স্ট্রিজিডি গোত্রের প্যাঁচাটির বৈজ্ঞানিক নাম Strix leptogrammica। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, চীনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই পাওয়া যায়।
বড় গেছো প্যাঁচা বড় মাথা-চোখ, খাটো ঘাড় ও চওড়া ডানার পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক প্যাঁচার দৈর্ঘ্য ৩৯ থেকে ৫৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৮০০ থেকে ১ হাজার ১০০ গ্রাম। কাঁধে চিকন সাদা ডোরাসহ দেহের ওপরটা ঘন বাদামি বা খয়েরি। দেহের নিচটা হলদে-সাদা ও তাতে থাকে সরু বাদামি ডোরা। মুখমণ্ডলের গোলক ডাম্বেল আকারের। গোলকের প্রান্ত কালো। এ দেশে পাখিটির যে উপপ্রজাতিটি দেখা যায়, তার মুখমণ্ডল গাঢ় বাদামি বা খয়েরি, ভ্রু সুস্পষ্ট ও সাদা এবং ঘাড়ের সামনের অংশে সুস্পষ্ট সাদা বন্ধনী দেখা যায়। চোখ হলদে। চঞ্চু ফ্যাকাশে নীলচে ও পা ফ্যাকাশে বাদামি। প্যাঁচা ও পেঁচীর চেহারা একই রকম।
সুন্দরবন ছাড়াও ওরা সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং ঢাকা বিভাগের পত্রঝরা বনের বাসিন্দা। অত্যন্ত লাজুক ও নিশাচর পাখিগুলোকে একাকী বা জোড়ায় দেখা যায়। দিনে বনের উঁচু কোনো গাছের ঘন পাতার আড়ালে বসে বিশ্রাম করে। ভোর ও সন্ধ্যায় উঁচু গাছ বা জায়গা থেকে মাটিতে বা পানিতে শিকার খোঁজে ও পায়ের তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে ইঁদুর, ছোট পাখি, সরীসৃপ ইত্যাদি শিকার করে খায়। নিচু কণ্ঠে ও গভীরভাবে ‘টু...হুও...’ বা ‘উ...হুও...’ শব্দে ডাকে।
জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে প্রজনন করে। সচরাচর গাছের গর্তে কাঠিকুটি ও ঝরা পালক বিছিয়ে বাসা বানায়। পেঁচী তাতে দুটি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। প্রায় ৩০ দিন তা দিয়ে ছানা ফোটায়। সচরাচর পেঁচী ডিমে তা দেয় ও প্যাঁচা ডিমে তা–দানরত পেঁচী ও পরে ছানাদের খাওয়ায়। ছানারা প্রায় দেড় মাসে উড়তে শেখে। তবে এরপরও বেশ কয়েক মাস বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। আয়ুষ্কাল প্রায় ১০ বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়