রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার শান্ত থাকলেও কোনো কোনো পণ্যে দাম বৃদ্ধির প্রবণতায় ছিল অস্বস্তি। এ ক্ষেত্রে চালের কথা বলা যায়। রমজানে চাহিদা বৃদ্ধিজনিত কারণে এর দাম বাড়ার কথা নয়। তবু দাম বেড়েছে। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকা কিংবা কমে আসায় চালের দাম বৃদ্ধিটা হয়তো পুষিয়ে গেছে তখন। তবে ঈদ চলে যাওয়ার পরও চালের দাম নিয়ে চলছে আলোচনা। 
চাল আমাদের প্রধান খাদ্যপণ্য। এর বাজারে অস্থিরতা চলতে থাকলে জনমনে তো বটেই; সরকারেও স্বস্তি থাকে না। সে অস্বস্তি চেপে রেখে হালে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, বোরো ধান-চাল এসে গেলে এর বাজারে অস্থিরতা কাটবে। হাওরাঞ্চলের কোথাও কোথাও ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। ফলন নিয়ে চাষিরা খুশি। সারাদেশে বোরোর ফলন কেমন হবে, সে বিষয়ে অবশ্য স্পষ্ট ধারণা এখনও মেলেনি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হবে বলেই আশা। কৃষি বিভাগের সার্বিক সহায়তাও এ ক্ষেত্রে জরুরি। 

আগের একাধিক মৌসুমের ধান উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি ছিল। এর সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই সম্পর্ক রয়েছে চালের বাজারে চলমান অস্থিরতার। সেটা কাটাতে সরকার চাল আমদানিতে গেছে দীর্ঘদিন পর। নিজেও আমদানি করছে ক্ষয়ে আসা মজুত বাড়াতে। বেসরকারি খাত অবশ্য তেমন উৎসাহিত হয়নি আমদানিতে। কর-শুল্ক প্রায় শূন্য করে দেওয়াও তাদের উৎসাহিত করতে পারেনি কেন, সেটা বোঝা দরকার। আমদানিকারকদের মনে লোকসানের শঙ্কা। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম চড়া বলেই জানা যাচ্ছে। 
এ কারণেও বোরো উৎপাদন ভালো হওয়া দরকার, যাতে বেশি আমদানি করতে না হয়। মজুত সন্তোষজনক রাখতে সরকারের উচিত হবে দেশের ভেতর থেকেই চাল সংগ্রহ করা। তাতে ধান-চালের বাজার চাষির অনুকূলে থাকার সম্ভাবনা। তাদের দিকে খেয়াল করতে হবে বলেই কিন্তু চালের দাম বেশি কমতে দেওয়া যাবে না। ভোক্তার স্বার্থও রক্ষা করতে হবে। চালের দাম বেশি বেড়ে গেলে আবার বাড়বে মূল্যস্ফীতি। চালের দাম এটাকে বেশি প্রভাবিত করে থাকে। 

আলুর দাম নিয়ে অবশ্য স্বস্তি আছে ভোক্তাদের মধ্যে। এটা এখনও পানির দরে বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় আলু উৎপাদকরা পড়েছেন বিপাকে। আগের মৌসুমের অভিজ্ঞতায় উৎসাহের সঙ্গে আলু ফলিয়ে তারা উৎপাদন ব্যয়ও তুলতে পারছেন না এখন। আলু গরুকে খাইয়ে দেওয়ার খবর মিলছে। গোখাদ্যের দাম বেশি বলেও এটি ঘটে থাকতে পারে। সামনে কোরবানির ঈদ। গরু পালনে চাষির উৎসাহ বাড়ার কথা। সে প্রেক্ষাপটেও ভালো হতো চাষি আলুসহ তার ফসলের লাভজনক দাম পেলে। টাকাটা অন্য খাতে খাটাতে পারতেন। 
চাষি এবার পেঁয়াজের দামও পাননি। শুরুর দিকে পেলেও ভরা মৌসুমে আর পাননি লাভজনক দাম। টমেটোর দামও পাননি। এ সুবাদে ভোক্তারা অবশ্য কম দামে পেয়েছেন এসব পণ্য। রমজানে সব রকম সবজির দামই ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে কম। শীত ও গ্রীষ্মের সবজি একযোগে বাজারে থাকাতেও এমনটি ঘটেছে। তারপরও বলতে হয়, প্রধান দুই ফসল আলু ও পেঁয়াজের বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের অমনোযোগিতা ছিল। 

আলু ও পেঁয়াজের অতি উৎপাদন হলে পরিস্থিতিটা যে চাষির জন্য বেদনাদায়ক হতে পারে, সে দুশ্চিন্তা সম্ভবত ছিল না। তবে হালে পেঁয়াজের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। মুশকিল হলো, পণ্যটি এখন আর চাষির হাতে নেই। সেটি যাদের হাতে গেছে, তারাই চড়তে থাকা বাজার থেকে ফায়দা তুলবে। বাজারে আমদানি করা পেঁয়াজও রয়েছে। এ অবস্থায় পেঁয়াজ আমদানি অব্যাহত রাখা হবে হয়তো। তবে আলু আমদানির পরামর্শ কেউ দেবে না। আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। হিমাগারে নাকি রাখার জায়গা নেই। 

চাষির ঘরে আর উঠানে স্তূপীকৃত আলু। তাদের দেশীয় পদ্ধতিতে এটা সংরক্ষণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। শেখানো হচ্ছে পেঁয়াজ সংরক্ষণে উদ্ভাবিত নতুন পদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে কিছু আর্থিক সহায়তা জোগানোর কথাও জানানো হচ্ছে। কিন্তু এ মুহূর্তে চাষি আছেন বিশেষ করে আলু নিয়ে দিশেহারা অবস্থায়। হিমাগারে সংরক্ষণ ব্যয় আবার বাড়ানো হয়েছে নানা যুক্তিতে। সরকার সেটা খানিকটা কমালেও সাধারণ চাষি আর আগ্রহী নন হিমাগারে আলু সংরক্ষণে। তারা সম্ভবত আলু চাষে নিরুৎসাহিত হবেন। 
সরকার এখন আলু রপ্তানিতে জোর দিতে পারে। আমরা অবশ্য খুব বেশি কৃষিপণ্য রপ্তানি করি না। গমসহ প্রধান কিছু কৃষিপণ্য বরং আমদানি করি বিপুলভাবে। সময়ে সময়ে পেঁয়াজ আমদানিতেও ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। পেঁয়াজের দামে রেকর্ড সৃষ্টির ঘটনা রয়েছে নিকট অতীতেই। আলুর দামও বাড়তে বাড়তে চিকন চালের সমান হয়ে গিয়েছিল মাত্র কিছুদিন আগে। এসব পণ্যের দাম কমে এলে সেসব দিনের কথা অবশ্য ভুলে যাই। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের তো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। 

দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার রয়েছে বলে এ ক্ষেত্রে তাদের তেমন কিছু করার নেই, তাও নয়। তারা কার্যত নিয়মিত সরকারের মতোই কাজ করে যাচ্ছে। তা ছাড়া মোটামুটি লম্বা সময় ধরেই সরকারটি থাকবে বলে ধারণা। কৃষিসহ গোটা অর্থনীতি যথাযথভাবে পরিচালনার দায়িত্ব রয়েছে তাদের। ঝুঁকি বিবেচনা করে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণও তাদের কর্তব্য। রমজানে বাজার অশান্ত হওয়ার আশঙ্কায় যেমন কিছু পদক্ষেপ তারা আগেই নিয়েছিলেন। ভোক্তার পাশাপাশি চাষির স্বার্থ রক্ষা করে সব সময়ের পণ্যবাজার ব্যবস্থাপনাও তাদের কাজের মধ্যে পড়ে। 
আমদানিকৃত পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনায় সফল হলে দেশে উৎপাদিত পণ্যের বাজারেও চাইলে সাফল্য দেখাতে পারবে সরকার। মাঠে যে বোরো ফসল রয়েছে, তার সফল উত্তোলন নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এটা হাতে আসার আগ পর্যন্ত চালের বাজার শান্ত রাখতেও উদ্যোগী হতে হবে। শহর-বন্দরে সর্বস্তরের মানুষ চাল কিনে খায়। গ্রামেও বিপুলসংখ্যক মানুষ এ জন্য বাজারের ওপর নির্ভরশীল। চাষিরাও অনেক ক্ষেত্রে ধান বেচে দিয়ে বর্ধিত দামে চাল কেনেন। সরকারকে এ অবস্থায় তার খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এর প্রভাবেও চালের বাজার যেন কিছুটা শান্ত হয়ে আসে। 

চালের বাজার অশান্ত থাকলে কিন্তু আটার দাম বাড়বে। এরই মধ্যে সে প্রবণতা কিছুটা পরিলক্ষিতও বটে। এদিকে সয়াবিনসহ ভোজ্যতেলের বড় মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব মেনে নিতে হয়েছে সরকারকে। রমজানের পর তার পক্ষে কর-শুল্কে ছাড় অব্যাহত রাখা নাকি সম্ভব নয়। সরকারের রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি অবশ্য খারাপ। এটা বাড়ানোর আবার চাপ রয়েছে বিশেষ ঋণ-সহায়তা কর্মসূচিতে থাকা আইএমএফের। 
সামনে একটা গ্রহণযোগ্য বাজেট দিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কাজটা মোটেও সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে তাকে বিশেষত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। এটা এখনও উচ্চ পর্যায়ে। এ ক্ষেত্রে ভোক্তার সঙ্গে উৎপাদকের স্বার্থের সমন্বয় ঘটানো যে কোনো সরকারের পক্ষেই কঠিন। বিভিন্ন স্তরের উৎপাদকদের স্বার্থেও রয়েছে সংঘাত। ডিম ও মুরগির দাম অনেক কমে যাওয়ায় এ খাতের প্রান্তিক খামারিরা যেমন এরই মধ্যে আওয়াজ তুলেছেন মে থেকে ব্যবসা বন্ধের। তাদের অনেক অভিযোগ বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ ব যবস থ সরক র র সহ য ত অবস থ অবশ য উৎপ দ উৎস হ আমদ ন রমজ ন

এছাড়াও পড়ুন:

নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়–ট্রাম্প বিরোধ শেষ, ফেরত পাবে ৭৯০ মিলিয়ন ডলার

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ও নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ অবশেষে সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, স্থগিতকৃত প্রায় ৭৯০ মিলিয়ন ডলারের ফেডারেল গবেষণা তহবিল বিশ্ববিদ্যালয়কে ফিরিয়ে দেবে ট্রাম্প প্রশাসন। এর বিনিময়ে নর্থওয়েস্টার্ন আগামী তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগকে ৭৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ যৌথভাবে এই তথ্য নিশ্চিত করে।

বিরোধের পটভূমি

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি নীতি, ট্রান্সজেন্ডার অ্যাথলেটদের অংশগ্রহণ ও ক্যাম্পাসে ইহুদিবিরোধী ঘটনা মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। গত এপ্রিল মাসে ফেডারেল অনুদান স্থগিত করে ট্রাম্প প্রশাসন। এই অভিযোগগুলোর তদন্তও শুরু করেছিল বিচার বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হেনরি বিয়েনেন জানান, ৭৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা কোনো ভুল স্বীকার নয়; বরং সমঝোতার অংশ হিসেবেই এই অর্থ প্রদান করা হবে।

আরও পড়ুনকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে ব্রিটেনে কারিগরি শিক্ষার উত্থান০৬ ডিসেম্বর ২০২৫

সমঝোতার শর্ত

সমঝোতা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বিশেষ বোর্ড কমিটি গঠন করতে হবে, যা চুক্তির বাস্তবায়ন তদারক করবে। এ ছাড়া প্রতি তিন মাসে ফেডারেল কর্তৃপক্ষকে সম্মতিসংক্রান্ত প্রতিবেদন দিতে হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় স্পষ্ট জানিয়েছে, তাদের একাডেমিক স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনে কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না—যেমন শিক্ষক নিয়োগ, ভর্তি ব্যবস্থা, পাঠ্যক্রম ও গবেষণার বিষয়বস্তু।

স্থগিত তহবিল পুনর্বহাল

বিয়েনেন জানান, স্থগিত থাকা অর্থ ‘কয়েক দিনের মধ্যেই’ আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পৌঁছাতে শুরু করবে এবং এক মাসের মধ্যে পুরোপুরি পুনর্বহাল হবে। অ্যান্টিসেমিটিজম মোকাবিলা ও নীতি মেনে চলা ইহুদিবিরোধী ঘটনার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেওয়া উদ্যোগগুলো—
– নতুন বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ
– অভিযোগ রিপোর্টিং ব্যবস্থা সম্প্রসারণ
– ইহুদি শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত সহায়তা

আরও পড়ুনকানাডার নতুন ঘোষণা: শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন স্টাডি পারমিট সংখ্যা জানাল০৬ ডিসেম্বর ২০২৫

তবে ক্যাম্পাসের ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থী ও কর্মীদের পরিচয়, সর্বনাম নির্বাচন বা স্ব-পরিচয় দেওয়ার ওপর কোনো নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান স্থগিত বা কমিয়ে তাদের নীতি নিজের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে চাপ দিচ্ছিল। সম্প্রতি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ও ২৫০ মিলিয়ন ডলার গবেষণা অনুদান ফিরে পেতে ৩০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দেয় এবং সমপরিমাণ অর্থ কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগে সম্মত হয়। তবে নর্থওয়েস্টার্ন জানায়, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া ট্রাম্প প্রশাসনের বিশেষ নীতি-সম্মত চুক্তিতে তারা সই করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

আরও পড়ুনএমবিবিএস–বিডিএসে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হতে পারে আজ, যেভাবে পাবেন শিক্ষার্থীরা২ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ