যেসব কারণে একজন মানুষের কর্মক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার মধ্যে অন্যতম একটি মাথাব্যথা। স্নায়ুরোগের মধ্যেও মাথাব্যথার হার সবচেয়ে বেশি। মাথাব্যথার রোগীদের শতকরা প্রায় ৭০ জনের হয় ‘টেনশন টাইপ হেডেক’। এ ছাড়া ১১ শতাংশের ‘মাইগ্রেন’ বা আধকপালি মাথাব্যথা এবং প্রায় ৩ শতাংশের ‘ক্রনিক ডেইলি হেডেক’ বা দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা হয়।
মাথাব্যথা প্রধানত দুই প্রকার। প্রথমত, প্রাইমারি হেডেক, যেমন মাইগ্রেন, টেনশন টাইপ হেডেক, ক্লাস্টার হেডেক ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, সেকেন্ডারি হেডেক, যেমন সাইনুসাইটিস, মাসটয়ডাইটিস, গ্লুকোমা, স্ট্রোক, আঘাতজনিত, মস্তিষ্কের টিউমার ইত্যাদি।
মাইগ্রেন
পুরুষের তুলনায় নারীদের মাইগ্রেন হয় বেশি। কৈশোর থেকে মাইগ্রেনের লক্ষণ দেখা দেয় এবং ৪০-৫০ বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এতে মাথার যেকোনো এক পাশে ব্যথা হয়। একবার এক পাশে হলে পরবর্তীবার অন্য পাশে ব্যথা হতে পারে। ব্যথা ৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। রক্তনালি বা শিরা টনটন করছে বলে মনে হয়। ব্যথা অত্যন্ত তীব্র হয় এবং এ সময় কোনো কাজ করা যায় না। আলো বা শব্দে ব্যথার তীব্রতা বাড়ে। বমিভাব বা বমি হতে পারে। ব্যথা শুরুর আগে চোখের সামনে আলোর নাচানাচি, আঁকাবাঁকা লাইন ইত্যাদি দেখে রোগী মাইগ্রেন যে শুরু হয়েছে তা বুঝতে পারে। অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকলে ব্যথার তীব্রতা কমে।
টেনশন টাইপ হেডেক
এটিও মাইগ্রেনের মতো কৈশোরে শুরু হয় এবং বেশি হয় নারীদের। মাথার মাংসপেশির সংকোচনের কারণে এই মাথাব্যথা হয়। এর লক্ষণ হলো মাথাজুড়ে চাপ-চাপ বা ব্যান্ডের মতো ব্যথা অনুভূত হওয়া। মাইগ্রেনের মতো ব্যথা ততটা তীব্র নয়। রোগী ব্যথা নিয়ে সব ধরনের কাজ করতে পারেন; বরং কাজের সময় ব্যথা কম অনুভূত হয়। কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত থাকতে পারে এই ব্যথা। দুশ্চিন্তা, পারিবারিক বা পেশাগত মানসিক চাপের সঙ্গে এ ধরনের মাথাব্যথার সম্পর্ক আছে।
আরও পড়ুনডায়েট করতে গিয়ে কি মাথাব্যথা হচ্ছে? জেনে নিন সমাধান০১ জানুয়ারি ২০২৪ক্লাস্টার হেডেক
এ ধরনের মাথাব্যথা হয় কম। পুরুষদের এটি বেশি হয়। এটি ক্ষণস্থায়ী কিন্তু বারবার হয়। অত্যন্ত তীব্র ব্যথা, চোখের চারপাশে বা পেছনে ব্যথা হয়। চোখ লাল হয়ে যায় এবং পানি পড়ে। চোখের ওপরের পাতা পড়ে যেতে পারে। প্রতিদিন একই সময়ে বা দিনে কয়েকবার ব্যথা হয় এবং কয়েক সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী হয়। এরপর ব্যথা চলে যায় এবং কয়েক মাস পর আবার ব্যথা শুরু হয়।
সেকেন্ডারি হেডেক
বিভিন্ন রোগের কারণে আমাদের মাথাব্যথা হতে পারে। যেমন সংক্রমণ (টাইফয়েড, ভাইরাস জ্বর) মস্তিষ্কের আবরণী প্রদাহ (মেনিনজাইটিস), সাইনুসাইটিস, মাসটয়েডাইটিস, মস্তিষ্কের টিউমার, রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক ইত্যাদি।
রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা
মাথাব্যথার কারণ নির্ণয় করতে পারলে চিকিৎসা সহজ। প্রাইমারি হেডেকের চিকিৎসা দুই স্তরের। প্রথমত, অ্যাবরটিভ চিকিৎসা বা মাথাব্যথার তাৎক্ষণিক নিরাময়। এ জন্য বিভিন্ন বেদনানাশক ওষুধ সেবন করা যায়। আবার অতিরিক্ত বেদনানাশক ওষুধ সেবনও মাথাব্যথার কারণ হতে পারে, যাকে মেডিসিন ওভার ইউজ হেডেক বলা হয়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। দ্বিতীয়ত, প্রোফাইলেকটিক চিকিৎসা। বারবার যেন মাথাব্যথা না হয় এবং ব্যথার তীব্রতা যেন কম থাকে—এ জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেতে হবে।
ডা.
জহিরুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল, ঢাকা
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে প্রথমবারের মতো ২৫টি ‘বেশি বিপদজনক’ বালাইনাশক চিহ্নিত
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে কৃষিতে হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসলের ব্যবহার বাড়ছে। এর ফলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রোগ ও পোকা। আবার এসব রোগ ও পোকা দমনে বেড়েছে অনিয়ন্ত্রিত বালাইনাশকের ব্যবহার। মাত্রাতিরিক্ত এসব বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার সরাসরি প্রভাব ফেলছে কৃষক, ভোক্তা ও পরিবেশের ওপর। ক্যান্সারসহ নানা দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কৃষকরা।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জরিপ (২০১৫–১৭) অনুযায়ী, তাদের হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশ কৃষির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এ তথ্যই প্রমাণ করছে—বিষ কীভাবে খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মানুষ ও পরিবেশে বিপর্যয় ডেকে আনছে।
এ নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোপাল দাসের নেতৃত্বে গবেষণা করে দেশে প্রথমবারের মতো বেশি বিপদজনক বালাইনাশক চিহ্নিত করেছেন একদল গবেষক।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) নির্ধারিত আটটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে দেশে নিবন্ধিত ৩৪৩টি সক্রিয় উপাদান বিশ্লেষণ করে মোট ২৫টি বেশি বিপদজনক বালাইনাশক চিহ্নিত করেন তারা। এই ২৫টি বালাইনাশকের মধ্যে ১১টি কীটনাশক, সাতটি ছত্রাকনাশক, পাঁচটি আগাছানাশক এবং দুইটি ইঁদুরনাশক। প্রায় ৮ হাজার বাণিজ্যিক পণ্যে এসব উপাদান ব্যবহৃত হয়।
বুধবার (৩০ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকায় অবস্থিত তুলা ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে অধিক বিপদজনক বালাইনাশক ও রাসায়নিকের উন্নত ব্যবস্থাপনার জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক কর্মশালায় গবেষণায় প্রাপ্ত এসব তথ্য তুলে ধরেন প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. গোপাল দাস।
গবেষণায় দেখা গেছে, মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত নয়টি বেশি বিপদজনক বালাইনাশক হলো- এবামেকটিন, ক্লোরপাইরিফস, প্যারাকুয়াট, গ্লাইফোসেট, গ্লুফোসিনেট অ্যামোনিয়াম, কার্বেন্ডাজিম, প্রোপিকোনাজোল, জিঙ্ক ফসফাইড ও ব্রোমাডিওলন। এছাড়া আরও কিছু বালাইনাশকের মধ্যম বা সীমিত ব্যবহার দেখা গেছে।
অন্যদিকে, সাইফ্লুথ্রিন, বিটা-সাইফ্লুথ্রিন, ট্রায়াজোফস, এডিফেনফস, ফ্লুলসিলাজোল নামক বালাইনাশকের তেমন কোনো মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার পাওয়া যায়নি, যা এখনই নিষিদ্ধ করা সম্ভব বলে মত দেন গবেষকগণ।
এসব বালাইনাশকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ড. গোপাল বলেন, “এগুলো মানবদেহে ক্যান্সার, কিডনি বিকলতা, হৃদরোগ, ফুসফুসের জটিলতা এমনকি প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শুধু মানুষ নয়, প্রাণীকূল এবং পরিবেশেও দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়া তৈরি করে। এসব বালাইনাশকের একটি বড় অংশ স্থায়ী জৈব দূষক হিসেবে পরিবেশে জমে থাকে বছরের পর বছর।”
গবেষণা শেষে ড. গোপাল দাসের নেতৃত্বে দেশব্যাপী ১৪টি অঞ্চলে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ, র্যালি, মাঠ প্রদর্শনী ও ১০টি আঞ্চলিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। কৃষক, বালাইনাশক ডিলার ও কৃষি কর্মকর্তাদের সচেতন করতে নেওয়া হয় কার্যকর উদ্যোগ।
এ নিয়ে গবেষক ড. গোপাল দাস বলেন, “সরকারের উচিত, বেশি বিপদজনক বালাইনাশকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল বা নবায়ন বন্ধ করতে হবে এবং বিকল্প নিরাপদ বালাইনাশক ব্যবহারে প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডিলারদের লাইসেন্স কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এছাড়াও কৃষি কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। মাঠপর্যায়ে বর্তমান আইন বাস্তবায়ন করতে পারলে এই ক্ষতির হাত থেকে দেশের কৃষক ও কৃষি খাতকে রক্ষা করা সম্ভব।”
বেশি বিপদজনক বালাইনাশকের এই চিহ্নিতকরণ ও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে টেকসই কৃষি, নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের দিকেই এগিয়ে যাবে বলে আশাবাদী বাকৃবির এই গবেষক।
বাকৃবির কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাইফুল আলম।
সম্মানিত অতিথি ছিলেন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাংলাদেশ অঞ্চলের জ্যোষ্ঠ কারিগরি ও নীতি উপদেষ্টা মারটিজিন ভন দে গ্রোয়েপ। বিশেষ অতিথি ছিলেন, ডিএই এর প্লান্ট কোয়ারেন্টাইন উইংয়ের পরিচালক মো. আব্দুর রহিম, বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) পরিচালক অধ্যাপক ড. এম. হাম্মাদুর রহমান।
কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাকৃবির কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষকদলের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. রমিজ উদ্দিন।
এ সময় দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞানীগণ, ডিএই কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, কৃষক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো. সাইফুল আলম বলেন, “আমরা বর্তমান প্রচলিত বালাইনাশক আইনের সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করছি, যাতে জনগণকে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে পারি। তবে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা আমরা অকপটে স্বীকার করি। এ সমস্যা সমাধানে শিক্ষক, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “ক্ষতিকর কীটনাশকের অতি ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্যের উপর গুরুতর প্রভাব পড়ছে। এগুলো ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তাই এসব বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা ২০২৫ সালে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছি। আমরা অবশ্যই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চাই। তবে তা যেন পরিবেশের ক্ষতি করে না হয়, সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য জৈব কীটনাশক ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করছি।”
ঢাকা/লিখন/মেহেদী