জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া বিষয়ে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করছে বিএনপি। বাকি প্রক্রিয়া শেষে আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে চূড়ান্ত মতামত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পৌঁছে দেবে দলটি। গত মঙ্গল ও গতকাল বুধবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা খসড়া নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে এ সিদ্ধান্ত নেন।

রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের এ বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বৈঠক সূত্র জানায়, জুলাই আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের মতো বিএনপিও দ্রুত জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে ঘোষণার পক্ষে। বৈঠকে স্থায়ী কমিটির নেতারা জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ ও নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।

এ ছাড়া বৈঠকে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ, সংসদের নারী আসন, পিআর পদ্ধতিসহ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন নেতারা। একই সঙ্গে এ শুল্কনীতি পুনর্বিবেচনার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তারা।

জানা যায়, বৈঠকে সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। এর পর সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে মতামত দেন নেতারা। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সংসদে নারী আসন ৫০ থেকে ১০০ করার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। তবে নারীরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, সে বিষয়ে এখনও ঐকমত্য হয়নি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মত দেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত করার পক্ষে তারা অবস্থান নেবেন। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিপক্ষে বর্তমান অনড় অবস্থান ধরে রাখার ব্যাপারেও মত দেন নেতারা। 

বৈঠকে স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে সংস্কারের অনেক বিষয় নিয়ে এরই মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সরকারের উচিত দ্রুত সেগুলো বাস্তবায়ন করা।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সমকালকে বলেন, ‘আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের বিষয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করছি। দ্রুত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমকে জানানো হবে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরির দায়িত্বে আছেন। এ প্রক্রিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে ধীরগতির অভিযোগ এনে গত ৩০ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন জুলাই যোদ্ধারা।

ছাত্র নেতৃত্বের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) সম্প্রতি সরকারের কাছে আগামী ৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এমনকি সরকার এটি ঘোষণায় ব্যর্থ হলে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে এনসিপি জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটে। অভ্যুত্থানের সূত্রপাত করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষণাপত্রের দাবিতে প্রথম সোচ্চার হয়। পরে এনসিপিও একই দাবি তোলে। অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা গত ২৮ ডিসেম্বর একযোগে ঘোষণা দেন, বছরের শেষ দিনে শহীদ মিনারে সমাবেশ থেকে ঘোষণাপত্র প্রকাশের। বিষয়টি তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা তৈরি হয়।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে জানায়। অবশ্য পরে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে ওই রাতে বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এনসিপি। ওই কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়।

এর পরই সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো খসড়ার ওপর তাদের প্রাথমিক মতামত দেয়। পরে গত ১৬ জানুয়ারি জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব এনপ সরক র র প র জন ত ক কম ট র ব এনপ এনস প মত মত

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ: নতুন গণতান্ত্রিক পথযাত্রা

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও গণআন্দোলনের ঢেউ এখন রূপ নিতে যাচ্ছে একটি ঐতিহাসিক রাষ্ট্রিক চুক্তি ‘জুলাই সনদ’। কয়েক মাসব্যাপী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নেতৃত্বে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের যে সংলাপ ও আলোচনার প্রক্রিয়া চলে এসেছে, তারই ফসল এই সনদ। রাজনৈতিক বিভক্তির দীর্ঘ ইতিহাসে এ এক বিরল মুহূর্ত, যেখানে রাষ্ট্রীয় সংস্কার নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ১৬৬টি প্রস্তাবে অভূতপূর্ব ঐকমত্য গড়ে তুলেছে।

সনদের লক্ষ্য ও দর্শন

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাষায়, ‘জুলাই সনদ’ কেবল রাজনৈতিক দলিল নয়, এটি একটি ভবিষ্যতপ্রতিশ্রুত সামাজিক চুক্তি যার উদ্দেশ্য- রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক, বিকেন্দ্রীভূত ও জবাবদিহিমূলক কাঠামোয় পুনর্গঠন করা।

জাতীয় ঐক্যমত

কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ  বলেন, এই প্রক্রিয়া ভবিষ্যতের জন্য এক নৈতিক ভিত্তির নির্মাণ। সনদ বাস্তবায়িত হলে, নতুন প্রজন্ম আমাদের সাহসিকতা মনে রাখবে।

যেসব ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য

কমিশনের তথ্যমতে, নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে প্রায় সকল দলের ঐক্যমত রয়েছে:

* সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংস্কার: সংসদ সদস্যদের দলভিন্ন অবস্থান গ্রহণের স্বাধীনতা নিশ্চিত।

* রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হ্রাস, বিশেষত সাধারণ ক্ষমা প্রদানে।

* তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার নীতিগত সম্মতি।

* সংসদীয় আসনসীমা নির্ধারণে নতুন কাঠামো।

* স্থায়ী কমিটিতে বিরোধী দলের নেতৃত্ব।

* প্রধান বিচারপতির নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার।

* বিভাগীয় উচ্চ আদালতের বেঞ্চ স্থাপন।

তবে প্রধানমন্ত্রী পদের দুই মেয়াদ বা ১০ বছর সীমাবদ্ধতা প্রস্তাবটি এখনো পূর্ণ রাজনৈতিক সমর্থন পায়নি।

বিভাজন রয়ে গেছে যেসব বিষয়ে

সংলাপে একাধিক স্পর্শকাতর ইস্যুতে এখনো মতানৈক্য বিদ্যমান:

* সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন।

* রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য।

* নারী সংসদ সদস্যদের সরাসরি ভোটে নির্বাচন।

* সংবিধানিক নিয়োগে স্বাধীন বোর্ড গঠন।

জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শতভাগ ঐকমত্য কখনোই বাস্তবসম্মত নয়। তবে আমরা একটি সর্বজনগ্রাহ্য সনদ উপস্থাপন করতে পারব বলেই আশাবাদী।

সনদ বনাম ঘোষণাপত্র

বর্তমানে আলোচনায় রয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল:

১. ‘জুলাই সনদ’  সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে তৈরি একটি আইনি দলিল।

২. ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’  একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক দিকনির্দেশনা।

লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, ঘোষণাপত্রকে প্রতীক হিসেবে না রেখে, এটিকে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র নির্মাণের রূপরেখা হিসেবে দেখতে হবে। না হলে এটি তিন জোটের ব্যর্থ রূপরেখার পুনরাবৃত্তি হয়ে যাবে।

রাজপথের বাস্তবতা

জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জুলাই সনদকে ঘিরে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আমরা যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা এখনো চোখে পড়ছে না। ঘোষণাপত্র ও সনদের বিষয়েও তালবাহানা চলছে। ফ্যাসিবাদী ভয়ের সংস্কৃতি ভেঙে যারা রাজপথে নেমেছে, তারা কাউকে ভয় পায় না।

জুলাই: এক নতুন অভ্যুত্থানের প্রতীক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুর রহমান আকাশ বলেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান থেকেই শুরু হয়েছিল এই চেতনার বীজবপন। যদি এই সনদ সাংবিধানিক ভিত্তি পায়, তাহলে তা হতে পারে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের এক নতুন অধ্যায়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, জুলাই মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত সনদ প্রকাশ করা হবে। তখনই বোঝা যাবে এটি কেবল রাজনৈতিক কাগজপত্র, না বাস্তব প্রতিফলনের এক সাহসী উদ্যোগ।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আবুল খায়ের বলেন, জুলাই সনদ এখন শুধু একটি রাজনৈতিক দলিল নয়, এটি দেশের ইতিহাসে গণআকাঙ্ক্ষার দলিল হয়ে উঠার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এটির বাস্তবায়ন নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জনসম্পৃক্ততা এবং প্রজন্মের চাপ প্রয়োগের ওপর। জুলাই কি হবে গণতন্ত্রের নবজন্ম, নাকি আরেকটি ব্যর্থ আশার নাম? উত্তর দেবে সময়, আর সময়ের গতিপথ নির্ধারণ করবে আমাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও জনসচেতনতা।

ঢাকা/আসাদ/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অন্তর্ভুক্তির আগে বিচার: ঐকমত্যের নামে দায়মুক্তি নয়
  • রাষ্ট্রপতি ও বিচার বিভাগকে বাইরে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় গণসংহতি আন্দোলন
  • শক্তিশালী নির্বাচিত নির্বাহী বিভাগ কেন জরুরি
  • সবার উদ্দেশ্য এক, লক্ষ্যেও নেই মতভিন্নতা: আলী রীয়াজ
  • জুলাই সনদ: নতুন গণতান্ত্রিক পথযাত্রা
  • ইসির সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক
  • জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতির সঙ্গে কানাডীয় হাইকমিশনারের বৈঠক
  • অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া ছাড়া ঐকমত্য কি টেকসই হবে
  • সাংবিধানিক কাঠামো তৈরি করা কেন জরুরি