জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে দ্রুত মতামত দেবে বিএনপি
Published: 10th, July 2025 GMT
জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া বিষয়ে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করছে বিএনপি। বাকি প্রক্রিয়া শেষে আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে চূড়ান্ত মতামত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পৌঁছে দেবে দলটি। গত মঙ্গল ও গতকাল বুধবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা খসড়া নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে এ সিদ্ধান্ত নেন।
রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের এ বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বৈঠক সূত্র জানায়, জুলাই আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের মতো বিএনপিও দ্রুত জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে ঘোষণার পক্ষে। বৈঠকে স্থায়ী কমিটির নেতারা জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ ও নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।
এ ছাড়া বৈঠকে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ, সংসদের নারী আসন, পিআর পদ্ধতিসহ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন নেতারা। একই সঙ্গে এ শুল্কনীতি পুনর্বিবেচনার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
জানা যায়, বৈঠকে সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। এর পর সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে মতামত দেন নেতারা। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সংসদে নারী আসন ৫০ থেকে ১০০ করার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। তবে নারীরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, সে বিষয়ে এখনও ঐকমত্য হয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মত দেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত করার পক্ষে তারা অবস্থান নেবেন। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিপক্ষে বর্তমান অনড় অবস্থান ধরে রাখার ব্যাপারেও মত দেন নেতারা।
বৈঠকে স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে সংস্কারের অনেক বিষয় নিয়ে এরই মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সরকারের উচিত দ্রুত সেগুলো বাস্তবায়ন করা।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সমকালকে বলেন, ‘আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের বিষয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করছি। দ্রুত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমকে জানানো হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরির দায়িত্বে আছেন। এ প্রক্রিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে ধীরগতির অভিযোগ এনে গত ৩০ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড.
ছাত্র নেতৃত্বের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) সম্প্রতি সরকারের কাছে আগামী ৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এমনকি সরকার এটি ঘোষণায় ব্যর্থ হলে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে এনসিপি জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটে। অভ্যুত্থানের সূত্রপাত করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষণাপত্রের দাবিতে প্রথম সোচ্চার হয়। পরে এনসিপিও একই দাবি তোলে। অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা গত ২৮ ডিসেম্বর একযোগে ঘোষণা দেন, বছরের শেষ দিনে শহীদ মিনারে সমাবেশ থেকে ঘোষণাপত্র প্রকাশের। বিষয়টি তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা তৈরি হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে জানায়। অবশ্য পরে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে ওই রাতে বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এনসিপি। ওই কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়।
এর পরই সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো খসড়ার ওপর তাদের প্রাথমিক মতামত দেয়। পরে গত ১৬ জানুয়ারি জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ সরক র র প র জন ত ক কম ট র ব এনপ এনস প মত মত
এছাড়াও পড়ুন:
শক্তিশালী নির্বাচিত নির্বাহী বিভাগ কেন জরুরি
‘জুলাই সনদ’-এর তাগাদায় রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছালেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার বৈঠকে অমীমাংসিত ও মতানৈক্যর বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চলমান। দর-কষাকষিতে উত্থান-পতন থাকে, থাকে ক্লাইমেক্স।
সব দলের আকার-ভর সমান নয়। সরকার গঠন–আকাঙ্ক্ষী দল বা দলগুলোর আর অন্য দলের সমীকরণও এক নয়। মানতে হবে, সরকার গঠন-আকাঙ্ক্ষীর পরিসরের ব্যাপ্তি বড়, তাদের গুরুত্বও অধিক। তাদেরই নেতৃত্ব দিয়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। সংগত কারণেই তাদের দায়িত্ববোধও বেশি। বাস্তবতা ভুলে যাওয়া বা অস্বীকার করার চেষ্টা কালক্ষেপণ মাত্র।
নির্বাহী বিভাগ নিয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে তর্কবিতর্ক প্রাসঙ্গিক। পতিত সরকারের জনগণের কাছে জবাবদিহির দায় না থাকায় রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তিপ্রয়োগের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ‘মানি মেকার’ ও ‘রুল মেকারের’ যোগসাজশে একচেটিয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হয়। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের তিন বিভাগের (সংসদ, নির্বাহী ও বিচার) মধ্যে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ না থাকায় ক্ষমতার পৃথক্করণ অনুপস্থিত ছিল। সব ক্ষমতা এক ব্যক্তিতে কেন্দ্রীভূত হয়। রাষ্ট্র জনগণের ইচ্ছাধীন থাকেনি। জনগণের সার্বভৌমত্ব না থাকায় নাগরিক অধিকার নিশ্চিতও দুরূহই থাকল। ‘জনগণের উইল’ অথবা রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সামাজিক চুক্তি (সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট) থাকেনি।
আরও পড়ুনজনপ্রশাসন ঠিক হোক, তা ভেতরের লোকজনই চায় কি২৬ ডিসেম্বর ২০২৪অপসারিত অলিগার্কিক শাসনব্যবস্থার বাস্তবতাকে অনুধাবন করে নির্বাচিত শক্তিশালী নির্বাহী বিভাগের প্রয়োজনীয়তা অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রের অপরিহার্য দৃশ্যমান হাত’ বিষয়ক আলোচনা প্রয়োজনীয়। একই সঙ্গে হাল আমলে আলোচিত ‘ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি’, ‘ডেলিবারেটিভ ডেমোক্রেসি’, ‘কাউন্টারভ্যালিং সিটিজেন পাওয়ার’ ইত্যাদি ধারণা উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রেক্ষাপটে যাচাই-বাছাইয়ের দাবি রাখে। এসব ধারণা গুরুত্বপূর্ণ হলেও যদি শুধু ব্যবস্থাপনাগত পরিবর্তন হয়, তাহলে ‘ক্ষমতার উৎস হিসেবে জনগণের ভূমিকা’ খর্ব হবে। সর্বাংশে ক্ষমতার উৎস হিসেবে জনগণের ভূমিকাই মৌলিক মাপকাঠি।
তৃতীয় বিশ্ব বা বৈশ্বিক দক্ষিণের অধিকাংশ দেশ উত্তরাধিকারসূত্রে ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র পেয়েছে। এই আমলাতন্ত্র বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়। এই আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শক্তি উপনিবেশের ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই গোষ্ঠীর মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনের নিয়মকানুন চাপিয়ে দিয়ে ঔপনিবেশিক শক্তি নিজেদের স্বার্থে সম্পদ শোষণ করেছে। এই আমলাতন্ত্র ‘নাগরিক রাষ্ট্রের’ আমলাতন্ত্র নয়।
খাতা-কলমে (ডি জুরে) এই সব দেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাহী বিভাগ হলেও কার্যত (ডি–ফ্যাক্টো) নির্বাহী বিভাগ হিসেবে ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রই বলবৎ আছে। অন্তর্বর্তী সরকারও উত্তর-উপনিবেশ দেশগুলোর আমলাতন্ত্রের ‘বিপ্লবী রূপান্তর’ বা ‘সংস্কার’ নিয়ে কমিশন বা কমিটি গঠনের ধারাবাহিকতায় বেশি কমিশন গঠন করেছে। বাংলাদেশে অতীতেও কয়েকটি কমিটি বা কমিশন গঠন করা হয়েছিল।
আমলাতন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত অন্তত তিনটি—জনপ্রশাসন, পুলিশ, স্থানীয় সরকারবিষয়ক কমিশন গঠন করা হলেও ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এ বিষয়ে নীরবতা লক্ষণীয়। দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। যেমন বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না এমন আলোচনা তথা প্রদেশবিষয়ক সুপারিশ একটি কমিশন প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে।আমলাতন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত অন্তত তিনটি—জনপ্রশাসন, পুলিশ, স্থানীয় সরকারবিষয়ক কমিশন গঠন করা হলেও ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এ বিষয়ে নীরবতা লক্ষণীয়। দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। যেমন বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না এমন আলোচনা তথা প্রদেশবিষয়ক সুপারিশ একটি কমিশন প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে।
আলোচনা হয়নি স্থানীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো তথা আমলাতন্ত্র রহিত করে ‘স্থানীয় সরকার’ কীভাবে গঠিত হবে, ঢাকাকেন্দ্রিক আমলানির্ভর অলিগার্কি থেকে মুক্তি পেয়ে গণদ্রব্যসহ (পাবলিক গুডস) সব রাষ্ট্রীয় পরিষেবা কী প্রক্রিয়ায় জননির্বাচিত স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে দেওয়া হবে, পৃথিবীর অনেক দেশের মতো পুলিশ স্থানীয় সরকারের অংশ হিসেবে কী কাজ করবে?
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর আস্থার ঘাটতিতে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ কিংবা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটির মতো টেকনোক্র্িক বডি প্রকারান্তরে আমলাতন্ত্রকেই শক্তিশালী করে।
রাষ্ট্র গঠন ও উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী নির্বাচিত নির্বাহী ব্যবস্থা অপরিহার্য। স্থিতিশীল ও কার্যকর সরকার ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন, চুক্তি সম্পাদন ও দেশের স্বার্থরক্ষায় শক্তিশালী ও সক্ষম নির্বাহী বিভাগ অপরিহার্য।
শক্তিশালী নির্বাহী ছাড়া চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের প্রতিষ্ঠানগুলোও সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। যদি নির্বাহী বিভাগ দুর্বল হয়, তাহলে সংসদ বা বিচার বিভাগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জটিলতা তৈরি হয়। ফলে রাষ্ট্রের কার্যকারিতা কমে যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, যখনই ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে, তখনই স্বৈরাচারী প্রবণতা বা রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। যেমন ২০০৬-০৮ সালে দুর্বল নির্বাহী ব্যবস্থা তত্ত্বাবধায়ক সংকট তৈরি করেছিল।
টেকসই রাষ্ট্র গঠনের জন্য শক্তিশালী নির্বাচিত নেতৃত্ব ও কার্যকর চেক অ্যান্ড ব্যালান্স—দুটিই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিশালী নির্বাহী ও চেক অ্যান্ড ব্যালান্স একে অপরের বিরোধী নয়, বরং সুশাসন, দ্রুত উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের জন্য দুইয়ের সমন্বয় অপরিহার্য।
ভারতের ‘লাইসেন্স রাজ’ অর্থনীতিকে স্থবির করেছিল। পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর দোর্দণ্ড প্রতাপ। ‘আমলাতান্ত্রিক ফাঁদ’ থেকে বোঝা যায়, অনির্বাচিত কর্মকর্তারা প্রকৃত শাসক হয়ে ওঠেন।
ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও শক্তিশালী নির্বাহীর উদাহরণে ভরপুর। সিঙ্গাপুরে শাসনব্যবস্থা দৃঢ়তার সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। নির্বাহী বিভাগের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং বিচার বিভাগ ও টেকনোক্র্যাট, আমলারা স্বাধীনভাবে কাজ করছেন।
আবার অনেক ‘গণতান্ত্রিক’ দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য কেবলই কাগজ-কলমে। মেক্সিকোতে পিআরআই শাসন করলেও আমলারাই সবকিছু চালাতেন। মিসরে আদালত ও সংসদ থাকলেও প্রকৃত ক্ষমতা জেনারেলদের হাতেই রয়ে গেছে। এটি সবচেয়ে খারাপ। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ বা নির্বাচিত নয়, অদৃশ্য ক্ষমতার সমষ্টি (স্টেলথ স্টেট) থেকে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশে নির্বাচিত নির্বাহীর হাতে ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ থাকতে হবে। আমলাতান্ত্রিক বাধা সরিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক অসারতা কাটিয়ে সংস্কার চালিয়ে নেওয়ার যৌক্তিক ক্ষমতা। একই সঙ্গে দরকার কার্যকর রক্ষাকবচ—স্বাধীন আদালত, সচল সংসদ ও মুক্ত গণমাধ্যম। শুধু একটি বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করলে ক্ষমতা অবাধ হয়ে পড়ে। দরকার ‘কমান্ড উইথ গার্ডরেইলস’ নীতি অনুসরণ অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগের হাতে কর্তৃত্ব থাকবে আবার এর একটি সীমাও থাকবে, অন্যরা দেখবে তারা ঠিক পথে আছে কি না।
নদীমাতৃক দেশে গালিবের সেই উক্তি ‘ধীরগতির নদীই গভীর হয়’—এটাই বাস্তবিক। সংস্কার কোনো ১০০ মিটারের দৌড় নয়, এটি একটি ম্যারাথন। বাংলাদেশের মতো জটিল প্রেক্ষাপটে ‘প্রাগম্যাটিক গ্র্যাজুয়ালিজমই’ বা ধাপে ধাপে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপই একমাত্র সমাধান। সংলাপকে জাতীয় স্বার্থের প্রতি নিবেদিত রাখতে অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ঐকান্তিক ভূমিকা জরুরি। ম্যাক্স-মিন পদ্ধতি তথা সর্বাধিক দলের ন্যূনতম জরুরি সংস্কারে একমত হওয়া একটি বাস্তবসম্মত পথ তৈরি করতে পারে।
নিজের সুবিধাভিত্তিক যুক্তি সময় ক্ষেপণ করে। যেমন রাজনৈতিক দলের সংস্কারের চাহিদা বাদ রেখে নারীদের ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচন আবার সংসদে সংখ্যা অনুপাতে নির্বাচনে জয়লাভের আশা বৈপরীত্যমূলক। এতে দলীয় প্রধানের ক্ষমতাই বাড়ে। তৃণমূল পর্যায়ে ‘লোকাল সেলফ গভর্নমেন্ট’ (স্থানীয় স্বনির্ভর সরকার) প্রতিষ্ঠায় বা বর্তমান সংসদের সক্ষমতা বৃদ্ধির সংস্কারে অগ্রাধিকার না দিয়ে তাড়াহুড়া করে দ্বিকক্ষ স্থাপন করলে ঢাকাকেন্দ্রিক অলিগার্কি সুসংহত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। উল্লম্বভাবে ক্ষমতা বণ্টন (ভার্টিক্যাল ডেমোক্রেসি) রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা স্থাপনের অন্যতম সোপান।
বাংলাদেশের জন্য পথ একটিই; জন-ইচ্ছা থেকে উৎসারিত নির্বাচিত শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত লেখকের নিজস্ব