২০০৭ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের কনভেনশন (সিআরপিডি) অনুমোদন করেছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ চোখে পড়ে না। বিশেষত নির্বাচনী ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে ‘প্রতিবন্ধিতা’ বিষয়টি উপেক্ষিতই বলা চলে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ভোটব্যবস্থায় সংস্কার আনার কোনো প্রস্তাব আছে কি না, বুঝতে নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার কমিশনের ২০২৫ সালের প্রতিবেদনটি যতটা সম্ভব উল্টেপাল্টে দেখলাম। 

এবার প্রবাসী বাংলাদেশিরা কীভাবে ভোট দেবেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের এবং সরকার-সংশ্লিষ্টদের একাগ্রতা বেশ প্রশংসনীয়। নারী ও প্রবাসী ভোটাধিকারে দীর্ঘ অধ্যায় আলোচনাও রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করার জন্য সমান চেষ্টা বা উদ্যোগের দেখা মেলেনি এই প্রতিবেদনে। 

২০১৮ সালের নির্বাচন-পরবর্তী ভোটার অংশগ্রহণ মূল্যায়ন বিষয়ে নির্বাচন কমিশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনটি জাল-জালিয়াতির হলেও প্রতিবেদনটিতে অন্তত ‘প্রতিবন্ধী ভোটার’ বিষয়ে কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ রয়েছে, দেশের ৩০ লাখের বেশি প্রতিবন্ধী ভোটার রেজিস্ট্রারে নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে ১০ শতাংশের কম প্রতিবন্ধী নাগরিক ভোট দিয়েছেন। তৎকালীন সরকার এ তথ্য সঠিক দাবি করলেও প্রশ্ন করা যেত, ৯০ ভাগ ভোটারই কেন ভোট দিল না বা দিতে পারল না? কী এবং কতটা প্রতিবন্ধীবান্ধব ভোট ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা ছিল? এবারও প্রশ্ন একই—আগামী নির্বাচনগুলোকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করার কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? 

গত দুটি নির্বাচনে জনগণই ভোট দিতে পারেনি, প্রতিবন্ধীদের জন্য সহজ ভোটদানপদ্ধতির চিন্তাভাবনা দূরকল্পনাই ছিল। ২০০৮-এর নির্বাচনেও প্রতিবন্ধীদের ভোট দিতে না যাওয়ার বিষয়ে অনেক আক্ষেপের কথা শুনেছিলাম। একটি তিনতলা স্কুল কেন্দ্রের ভোট ব্যবস্থাপনা নিয়ে শোনা প্রতিবন্ধী অভিজ্ঞতার বয়ান মনে পড়ছে। বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থতার কারণে চলনশক্তিহীন ও প্রতিবন্ধীরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে যাতে কষ্ট না পান, সে জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। স্কুলঘরের তৃতীয় তলাটি তাঁদের জন্য নির্ধারিত। কারণ, নিচের দোতলায় দারুণ ভিড়ভাট্টা ও হইহল্লা হতে পারে। কিন্তু তিনতলায় ওঠার জন্য লিফট নেই, সিঁড়ি সরু, খাড়া ও অপ্রশস্ত। দুজন মানুষ পাঁজাকোলা করে একজন বয়োবৃদ্ধকে ওপরে তুলতে পারবেন—এমন অবস্থাও একেবারেই অনুপস্থিত। ভাবুন তো, কতটা সংবেদনহীন হলে এ রকম ‘প্রতিবন্ধীবান্ধব’ নির্বাচন ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করা যায়! 

গত এক দশকে বাংলাদেশের নির্বাচনীব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু এসব আলোচনায়ও প্রতিবন্ধিতার মতো গুরুতর বিষয়টি মোটাদাগে প্রায় উপেক্ষিতই থেকেছে। অপ্রিয় সত্য হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নির্বাচন–ভাবনা ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে অনেকটা বিযুক্তই রাখা হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে ভোটাধিকার থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ভোট দিতে পারছেন না, কারণ কি শুধুই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, নাকি নির্বাচনপদ্ধতি, নীতিনির্ধারকদের অবহেলা বা উদাসীনতাও একটি বড় কারণ? 

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনটিকে দীর্ঘদিনের বৈষম্য দূর করার এক মোক্ষম সুযোগ ভাবা দরকার। শুধু মুখে ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচন’ বললেই তো হলো না! ‘ইনক্লুসিভ’ শব্দের ভুল ব্যাখ্যাও বিপজ্জনক রকম বাড়ছে। ‘ইনক্লুসিভ’ বা ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলতে শুধু যেন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া বোঝায়। কিন্তু শব্দটির মূল অর্থ, সব বাদ পড়া, বিপন্ন, প্রান্তিক বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা। যেমন শারীরিক চলাচলে অক্ষম, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ ও অসমলিঙ্গ জনগোষ্ঠী। তাঁদের ভোটের অধিকারও সমান। 

সারা দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো জরুরি। ভোটার, নির্বাচন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলসহ সবার মাঝে। এভাবে এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের মানসিক জড়তা বা সামাজিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব। সর্বশেষ এই কাজগুলো কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা পর্যালোচনার জন্য একটি স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কাঠামো থাকতে হবে। নির্বাচনের পর প্রতিবন্ধী ভোটারদের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে সমস্যাগুলো শনাক্ত করতে হবে। 

আসলে শারীরিকভাবে বিপন্নদের ভোটাধিকার কাজির গরুর মতো কাগজ-কলমে থাকলেও গোয়ালে নেই। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নানা বিতর্ক চলছে। ভোট কারচুপি, সহিংসতা, ভয়ভীতি—এসব বিষয় নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী ভোটারদের ভোটাধিকার নিয়ে পাবলিক ফোরামে কখনো কোনো আলোচনা কি শোনা গেছে? যায়নি।  

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি), ফ্রিডম হাউস এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেকটোরাল সিস্টেমসের (আইএফইএস) রিপোর্টগুলো দেখেছি। সেগুলোতে প্রতিবন্ধীদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার উল্লেখ আছে। গণতান্ত্রিক অধিকারের লঙ্ঘন উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ণনা আছে যে ভোটকেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই এমনভাবে তৈরি, যেখানে র‍্যাম্প নেই, দরজাগুলো সরু, ব্রেইল সামগ্রী অনুপস্থিত। ফলে হুইলচেয়ারে থাকা ব্যক্তিরা বা দৃষ্টিহীন ভোটাররা একেবারেই অংশ নিতে পারেন না। 

প্রতিবন্ধীদের ভোট থেকে বাদ পড়ার মূল কারণ দুটি। এক, ভোটকেন্দ্রগুলোর কাঠামোতেই তাঁরা প্রবেশ করতে পারেন না; দুই, যেসব আইন তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা, সেগুলোর কার্যকর প্রয়োগ নেই। 

২০১৩ সালের ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন’ এই জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকারের কথা বললেও, এটি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে আইনি স্বীকৃতি থাকলেও বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ নেই। আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে যত আলোচনা হয়, তার কোনোটাতেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধি বা সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করা হয় না। ২০১৪ সালের পর থেকে চলা প্রতিটি আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণ ছিল শূন্য। ফলে তাঁরা যেমন নীতিনির্ধারণে দাবি জানাতে পারছেন না, তেমনি তাঁদের সমস্যার কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধানও হচ্ছে না। 

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে উন্নত নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শেখার চেষ্টা এবং পরামর্শ এবারের সংস্কার প্রতিবেদনের একটি ইতিবাচক দিক। কয়েকটি দেশের অভিজ্ঞতার উল্লেখও রয়েছে। কিন্তু উল্লেখ নেই যে দেশগুলো দেখিয়েছে, কীভাবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যায়। ভারতের ‘অ্যাক্সেসিবল ইলেকশন’ উদ্যোগ, মেক্সিকোর ‘মোবাইল ভোটিং ইউনিট’, অস্ট্রেলিয়ার ব্রেইল, অডিও ও সহায়ক ভোটিং ব্যবস্থা—এসব উদাহরণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, কীভাবে সামান্য উদ্যোগেই প্রতিবন্ধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব। 

এখনই সময় পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়ার। যদি সত্যিকারের ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ চাই, তাহলে নিশ্চিত করতে হবে সব ভোটকেন্দ্র যেন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য সহজগম্য হয়। র‍্যাম্প, চওড়া দরজা, ব্রেইল ব্যালট, হুইলচেয়ার সহায়তা—এসব বাধ্যতামূলক করতে হবে। পরবর্তী ধাপে, নির্বাচনী আইনে স্পষ্টভাবে প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্তির বিধান যুক্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে প্রতিবন্ধী প্রতিনিধি রাখতে হবে। 

এ ছাড়া সারা দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো জরুরি। ভোটার, নির্বাচন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলসহ সবার মাঝে। এভাবে এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের মানসিক জড়তা বা সামাজিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব। সর্বশেষ এই কাজগুলো কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা পর্যালোচনার জন্য একটি স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কাঠামো থাকতে হবে। নির্বাচনের পর প্রতিবন্ধী ভোটারদের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে সমস্যাগুলো শনাক্ত করতে হবে। 

২০২৫ বা ২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আমরা এখনই যদি পরিকল্পনা না করি, তবে আবারও একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এই অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটা শুধু আইনি বাধ্যবাধকতার নয়। এটি ন্যায়বিচার, সম্মান এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রশ্ন। ভোট দিতে পারা কারও দয়ার বিষয় নয়। এটি নাগরিক অধিকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এখন থেকেই একটি সুস্পষ্ট, বাস্তবমুখী, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরি করুক। ভোট হোক সত্যিকার অর্থেই সবার জন্য ‘ইনক্লুসিভ’! 

হেলাল মহিউদ্দীন ভিজিটিং প্রফেসর, মন্টক্লেয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইনক ল স ভ দ র জন য জনগ ষ ঠ ত ম লক ক ত কর উল ল খ ত করত ব ষয়ট

এছাড়াও পড়ুন:

ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ

এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।

ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।

‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।

খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।

এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী

ডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।

প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।

পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।

ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।

নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউব

ইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।

ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।

ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।

২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।

মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ