ভারত–পাকিস্তানের যুদ্ধ বাধলে কার কী ক্ষতি হবে
Published: 3rd, May 2025 GMT
পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় যুদ্ধ বেধে যাওয়া ও হতাহতের তাৎক্ষণিক হুমকি তৈরি হয়েছে। এর বাইরে আরও বড় বিপদ রয়েছে। অর্থনীতি, বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশের যে বিপর্যয় ডেকে আনবে, তাতে যে দেশই নিজেদের বিজয়ী বলে দাবি করুক না কেন, স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হবে। এখন সময় হয়েছে, দুই দেশের যুদ্ধংদেহী কথাবার্তা বন্ধ করে উত্তেজনা প্রশমন ও সংকট সমাধানের পথ বের করা।
সিন্ধু উপত্যকা—মানবসভ্যতার অন্যতম প্রাচীন আঁতুড়ঘর আবারও একটা প্রলয়ংকরী দুর্যোগের ঝুঁকিতে। পারমাণবিক সংঘাতের বাইরেও যদি একটা প্রচলিত যুদ্ধ এখানে হয়, তাহলে যে অকল্পনীয় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাবে, সেটা এ অঞ্চলের কয়েক দশকের উন্নয়নের ধারাকে চুরমার করে দেবে, কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকা পড়বে এবং জলবায়ু ব্যবস্থাপনা নাজুক অবস্থায় চলে যাবে।
ইতিহাসের শিক্ষা
ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতে যে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, সেই ইতিহাস সংযত হওয়ার শিক্ষা দেয়। ১৯৯৯ সালে খুব সীমিত পরিসরে মাত্র কয়েক দিন স্থায়ী কারগিল যুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তানের পুঁজিবাজারে ধস নেমেছিল। বাজার পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হলেও বৈরিতা দীর্ঘদিন ধরে চলায় অর্থনৈতিক প্রভাব পড়েছিল মারাত্মক। পরবর্তী অর্থবছরে পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ৩ দশমিক ১ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছিল। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা সংঘাতের সময় আমরা দেখেছি, মাত্র এক সপ্তাহের উত্তেজনায় দুই দেশের পুঁজিবাজারে ক্ষতির পরিমাণ ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল।
এখন যদি সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে যায়, তাহলে ধ্বংসযজ্ঞ আরও অনেক বেশি হবে। ফরেন অ্যাফেয়ার্স ফোরামের ‘ভারত-পাকিস্তানের পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ভারতকে সামরিক অভিযানের জন্য প্রতিদিন ৬৭০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ হবে ১৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। চার সপ্তাহের একটা যুদ্ধে ভারতকে যে ব্যয় করতে হবে, সেটা দেশটির জিডিপির ২০ শতাংশের সমান।
পাকিস্তানের অবস্থা আরও নাজুক। পাকিস্তান এরই মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ–সংকটে ভুগছে, আইএমএফের ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। একটা যুদ্ধ বাধলে অতি-উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অত্যাবশ্যক পণ্যের ঘাটতিতে পাকিস্তানকে ভুগতে হবে।
অপেক্ষাকৃত বড় অর্থনীতি হওয়ার পরও ভারতকে তীব্র সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। ভারতের বাজার থেকে পুঁজি অন্য দেশে স্থানান্তর হতে পারে। অর্থনীতিবিদদের ধারণা হচ্ছে, প্রথম মাসের সংঘাতেই ভারত থেকে ১০-১৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ অন্য দেশে চলে যেতে পারে। দুই দেশের রুপির মান অবমূল্যায়ন করতে হতে পারে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এই সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও মন্থর করে দিতে পারে।
সিন্ধু উপত্যকার নদীগুলো নিয়ে করা পানি চুক্তি স্থগিতের মানে হচ্ছে পাকিস্তানে কৃষি অর্থনীতির ওপর হুমকি তৈরি হওয়া। পাকিস্তানের কৃষি খাত থেকে এর জিডিপির ২২ দশমিক ৭ শতাংশ আসে, নদীর পানির ওপর ৯৫ শতাংশ সেচ নির্ভরশীল। চুক্তি স্থগিতের ফলে বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে আমাদের খালগুলোতে পানির ঘাটতি দেখা দেবে। খাদ্যনিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ঝুঁকিতে পড়বে। এখনই ২০ কোটি ভারতীয় ও ৪ কোটি পাকিস্তানি পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে ভুগছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের দিকে অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের যাত্রা অত্যন্ত ধীরগতির। যুদ্ধ বাধলে তাতে মারাত্মক ধাক্কা খাবে। মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক সংকোচন ও চাকরি হারানোর কারণে কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দেওয়া হবে।
পরিবেশগত বিপর্যয়
ইউক্রেন ও গাজার সাম্প্রতিক সংঘাত আমাদের হতাশাজনক তথ্য দেয়। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির পর ইউক্রেনে ৭০ লাখ একর বন ও সংরক্ষিত এলাকা ধ্বংস হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ৯৯০টি শিল্পকারখানা থেকে দূষণের ঘটনা ঘটেছে। নোভা কাখোভকা কাঁধ ধ্বংস হওয়ায় বিশাল এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এখানে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে।
ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের কৃষি উৎপাদনের কেন্দ্রগুলো দীর্ঘমেয়াদি দূষণের শিকার হবে। ফলে কোটি কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। জলবায়ুর প্রতি দুই দেশের প্রতিশ্রুতি মাঝপথেই পথ হারাবে। যুদ্ধ ও পুনরুদ্ধারের কাজে যদি অর্থ ও সম্পদ নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে পাকিস্তান ৬০ শতাংশ মিশ্র জ্বালানি (নবায়নযোগ্য ও জীবাশ্ম জ্বালানি) ব্যবহারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং ভারত কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে লক্ষ্য ঠিক করেছে, সেখান থেকে তাদের সরে আসতে হবে।
আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ জরুরি
এসব সম্ভাব্য বিপর্যয় ও পরিণতির কথা বিবেচনা করে বিশ্ব সম্প্রদায়কে তাদের নিষ্ক্রিয় উদ্বেগ দেখানোর জায়গা থেকে সরে এসে ইসলামাবাদ ও দিল্লির ওপর সক্রিয় হস্তক্ষেপ ও কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগাতে হবে। দুই দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অনন্য সক্ষমতাও রয়েছে।
দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধংদেহী কথাবার্তা থামাতে চীনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। কেননা চীন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র আবার ভারতের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক সম্পর্কও দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের অন্যান্য বড় শক্তিরও ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ-উন্মাদনা বন্ধে কূটনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহার করতে হবে।
আলী তৌকির শেখ, জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ
দ্য ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
আমিরাতকে হারিয়ে সুপার ফোরে পাকিস্তান
এশিয়া কাপ-২০২৫ এর সুপার ফোরে জায়গা করে নিলো আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তান। বুধবার দিবাগত রাতে ‘এ’ গ্রুপে নিজেদের শেষ ম্যাচে স্বাগতিক আরব আমিরাতকে ৪১ রানের ব্যবধানে হারিয়ে ভারতের সঙ্গী হলো সালমান-শাহীনরা।
দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আলো-ঝলমলে রাতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে পাকিস্তান সংগ্রহ করে ৯ উইকেটে ১৪৯ রান। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ১৭.৪ ওভার পর্যন্ত টিকেছিল আমিরাত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১০৫ রানেই গুটিয়ে যায় তাদের ইনিংস। সেই সুবাদে সহজ জয় নিয়ে শেষ চারে জায়গা নিশ্চিত করে পাকিস্তান।
আরো পড়ুন:
আরব আমিরাতকে ১৪৭ রানের টার্গেট দিল পাকিস্তান
বেথেলের ইতিহাস গড়া দিনে ইংল্যান্ডের দাপুটে জয়
এই জয়ের নায়ক নিঃসন্দেহে শাহীন শাহ আফ্রিদি। বিপদের মুহূর্তে নামতে হয় তাকে ব্যাট হাতে। সেখানে ১৪ বলে ৩টি চার ও ২টি ছক্কার ঝড়ে অপরাজিত ২৯ রানের ইনিংস খেলেন তিনি, যা পাকিস্তানের সংগ্রহকে দাঁড় করায় লড়াইযোগ্য অবস্থানে। শুধু ব্যাটেই নয়, বল হাতেও ছিলেন সমান কার্যকর। ৩ ওভারে মাত্র ১৬ রান খরচ করে তুলে নেন ২টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট। এমন সর্বাঙ্গীন পারফরম্যান্সে স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠে যায় তার ঝুলিতে।
তবু শুরুটা বেশ আশাব্যঞ্জক ছিল আমিরাতের। ১৩.৫ ওভার পর্যন্ত তারা প্রতিযোগিতায় টিকে ছিল দারুণভাবে। তিন উইকেট হারিয়ে সংগ্রহ করেছিল ৮৫ রান। কিন্তু এরপর যেন ধস নামে। মাত্র ২০ রানের ব্যবধানে বাকি সাত উইকেট হারিয়ে পুরো দল অলআউট হয়ে যায় ১০৫ রানে। দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৩৫ রান করেন রাহুল চোপড়া, যার ইনিংসে ছিল ১টি চার ও ১টি ছক্কা। ধ্রুব পারাশার যোগ করেন ২০, মুহাম্মদ ওয়াসিম ১৪ এবং আলিশান শারাফু করেন ১২ রান।
পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণে শাহীনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুটি করে উইকেট নেন হারিস রউফ ও আবরার আহমেদ।
এর আগে ব্যাট হাতে পাকিস্তানও ভুগেছে। চারজন ছাড়া কেউ দুই অঙ্কে পৌঁছাতে পারেননি। ফখর জামান খেলেন ৩৬ বলে ৫০ রানের দৃষ্টিনন্দন ইনিংস, যেখানে ছিল ২টি চার ও ৩টি ছক্কা। শাহীন আফ্রিদির অপরাজিত ২৯ রান ছাড়া অধিনায়ক সালমান আলি আগা ২০ এবং মোহাম্মদ হারিস যোগ করেন ১৮ রান।
আমিরাতের হয়ে দুর্দান্ত বোলিং করেন জুনায়েদ সিদ্দিকী। তিনি ৪ ওভারে মাত্র ১৮ রান দিয়ে তুলে নেন ৪টি উইকেট। সিমরানজিত সিংয়ের বোলিং ফিগারও কম চমকপ্রদ নয়, ৪ ওভারে ২৬ রান খরচ করে শিকার করেন ৩ উইকেট।
এই জয়ে পাকিস্তান-ভারত দ্বৈরথের আরেকটি অধ্যায় লেখার সুযোগ তৈরি হলো। শুধু তাই নয়, ভাগ্য যদি সহায় হয়, তবে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ফাইনাল লড়াইও দেখা যেতে পারে এবারের এশিয়া কাপে।
ঢাকা/আমিনুল