জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে ‘মৌলিক সংস্কারের’ রূপরেখা তুলে ধরেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি বলেছে, মৌলিক সংস্কারের মূল লক্ষ্য তিনটি—ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহি ও বিকেন্দ্রীকরণ।

মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বর্ধিত আলোচনায় এনসিপি তাদের রূপরেখা তুলে ধরে। এনসিপি মনে করে, নির্বাচন যেকোনো সময় অনুষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু তার আগে অবশ্যই মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার দৃশ্যমান পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।

সংস্কার প্রশ্নের ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা করছে কমিশন। এর অংশ হিসেবে এনসিপির সঙ্গে এদিন আবার আলোচনা করেছে কমিশন। এর আগে গত ১৯ এপ্রিলও দলটির সঙ্গে কমিশনের আলোচনা হয়েছিল। মঙ্গলবার এনসিপির সঙ্গে কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়েছে।

মৌলিক সংস্কার বলতে এনসিপি বুঝিয়েছে, স্বৈরতান্ত্রিক ঝুঁকি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন। তারা রূপরেখায় বলেছে, গণ–অভ্যুত্থানের লক্ষ্য শুধু একটি নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া নয়, অবশ্যই নির্বাচন ক্ষমতার রূপান্তর নিশ্চিত করার মূল উপাদান। কিন্তু ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক অনুশীলন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে কি না, তা কখনোই শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় না।

সংস্কারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা হচ্ছে।—আখতার হোসেন, সদস্যসচিব, এনসিপি

১৯৯১ সালে সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ ও এর পরের পরিস্থিতি তুলে ধরে রূপরেখায় বলা হয়, ‘যদি আমরা নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করি, অর্থাৎ মৌলিক সংস্কার আমলে না নিয়ে নির্বাচনমুখী ন্যূনতম সংস্কারের ওপর মনোনিবেশ করি (যা কেবল একটি অস্থায়ী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে) তাহলে বাংলাদেশ আবারও স্বৈরশাসনের ঝুঁকিতে পড়বে।’

এনসিপির রূপরেখায় মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো সাংবিধানিক ব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সাংবিধানিক পদে নিয়োগ, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার, স্থানীয় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার ও জনপ্রশাসন সংস্কার।

এনসিপি যেসব মৌলিক সংস্কারের কথা বলছে, তার অনেকগুলো সংবিধান–সম্পর্কিত। সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখন পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছে দলটি। তারা বলেছে, সামনে এ বিষয়ে আলোচনা হবে।

আলোচনা শেষে বিকেলে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, কতটুকু সংস্কার অবশ্যই করতে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিচ্ছে, সংস্কারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা হচ্ছে। এনসিপির পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা তাঁরা কমিশনে জমা দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো থেকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে।

আখতার হোসেন বলেন, তাঁরা যে রূপরেখা তুলে ধরেছেন, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে এবং সেগুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়।

আখতারের বক্তব্যের আগে এনসিপির রূপরেখার সারসংক্ষেপ সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন দলটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম।

সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও ক্ষমতার ভারসাম্য

এনসিপি তাদের রূপরেখায় বলেছে, নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহির মধ্যে রাখতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন করতে হবে। সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ দেবে এই কাউন্সিল। আইনসভা হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। নিম্নকক্ষ বিদ্যমান পদ্ধতিতে এবং উচ্চকক্ষ গঠিত হবে ভোটের আনুপাতিক হারে। সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবেন। তবে সরকারের স্থিতিশীলতাও যেন ঠিক থাকে, সে ধরনের সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকতে হবে।

এনসিপির রূপরেখায় বলা হয়েছে, ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স হবে ১৬ বছর এবং সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স হবে ২৩। তথ্য প্রাপ্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন ও প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে। মৌলিক অধিকারবিরোধী দমনমূলক আইন ও সংবিধানে এ–সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ সংস্কার করতে হবে।

নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে রূপরেখায় কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে, কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। একই ব্যক্তি একসঙ্গে দলনেতা, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না। বিরোধী দল ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারবে। জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব কমিটি; পরিকল্পনা, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট দেওয়া যাবে (তবে সরকারের প্রতি অনাস্থা ভোট দেওয়া যাবে না)।

স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন

নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে রূপরেখায়। এর মধ্যে আছে সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ, ইসির নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো ও বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা; ইসির মেয়াদে বা মেয়াদ–পরবর্তী সময়ে ইসির বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে তদন্তের ব্যবস্থা; সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন; ফলাফলের গেজেট প্রকাশের পরও জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেলে ফলাফল বাতিল ইত্যাদি।

বিচার বিভাগ ও অন্যান্য

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নিজস্ব প্রশাসনিক সচিবালয় গঠন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, বিচারপতি নিয়োগে জুডিশিয়াল কমিশন ও মেধাভিত্তিক পরীক্ষা, আপিল বিভাগে বিচারপতি পদোন্নতিতে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং বিভাগীয় শহরগুলোয় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, সরকারি ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলার ক্ষেত্রে দুদককে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা বাতিল করা, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার ও নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে জনপ্রশাসনে বেশ কিছু সংস্কার আনার প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা শেষে বিকেলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, সংস্কার কার্যক্রমগুলোর বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে এখনো কমিশনের সঙ্গে তাঁদের আলোচনা হয়নি। তাঁরা বলে আসছেন, বর্তমান সংবিধান স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী কাঠামোতে ভরপুর। এর বাইরে নতুন একটি সংবিধানের কথা বলেছেন তাঁরা। নতুন সংবিধান বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই গণপরিষদ প্রয়োজন। সে জন্য ঐকমত্যের প্রয়োজন আছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সামনের দিনে আলোচনা করবেন। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়েও তাঁরা একটি লিখিত প্রস্তাব কমিশনকে দেবেন।

আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে এনসিপির প্রস্তাবিত রূপরেখা অনুযায়ী সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কি না—এমন প্রশ্নে আখতার হোসেন বলেন, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অনেক ধরনের বক্তব্য আসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এ বছরের ডিসেম্বর থেকে সামনের বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। এনসিপি মনে করে, সরকারের তরফ থেকে বিচার ও সংস্কারকাজ যদি দৃশ্যমান হয় এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা থাকে, তাহলে এ সময়কালের মধ্যে সেটাকে সামনে নিয়ে আসা সম্ভব এবং নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।

এর আগে দুপুরে আলোচনার বিরতিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষ ও উচ্চ কক্ষ—দুই কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং গণভোটে বিধান থাকতে হবে। প্রশ্ন উঠেছে, ছোটখাটো সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটে যেতে হবে কি না। পাওয়ার স্ট্রাকচার (ক্ষমতাকাঠামো), প্রস্তাবনা ও মূলনীতির মতো সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় সংশোধনের জন্য অবশ্যই গণভোটে যেতে হবে বলে তাঁরা মনে করেন। তবে ছোট সংশোধনীর ক্ষেত্রে গণভোটের বাধ্যবাধ্যকতা রাখার প্রয়োজন নেই।

আরও পড়ুনভোটারের বয়স ১৬, এমপি প্রার্থীর বয়স ২৩ বছর চায় এনসিপি৩ ঘণ্টা আগেজবাবদিহিমূলক বাংলাদেশের পথরেখা

এনসিপির সঙ্গে আলোচনার শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এনসিপির পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের যে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, তা তাঁরা গ্রহণ করেছেন। পর্যালোচনা সাপেক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় এ রূপরেখার একটি প্রতিফলন পাওয়া যাবে।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকসহ বিভিন্নভাবে কমিশনের আলোচনা অগ্রসর হচ্ছে। এ অব্যাহত আলোচনার লক্ষ্য হচ্ছে, এমন একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা, যা গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক বাংলাদেশের পথরেখা নির্দেশ করবে।

আলোচনায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো.

এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।

অন্যদিকে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেনের নেতৃত্বে দলের মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার ও জাবেদ রাসিন এবং সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) আরমান হোসাইন আলোচনায় অংশ নেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এনস প র র পর খ আখত র হ স ন সদস যসচ ব র প রস ত ব ন শ চ ত কর র লক ষ য ব যবস থ সরক র র র সদস য ব চ রপত মন ত র ন করত গণভ ট

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ ঘোষণায় শুরু হচ্ছে নতুন অধ্যায়

দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন আর আস্থাহীনতার পথ পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে এক সম্ভাবনাময় সন্ধিক্ষণে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর কয়েক মাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল একসঙ্গে চূড়ান্ত করেছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’। এর ওপর ভিত্তি করেই ৫ আগস্ট ঘোষিত হবে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি কেবল একটি রাজনৈতিক দলিল নয়, বরং তা হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার ও সংলাপভিত্তিক ভবিষ্যতের নতুন সূচনা।

আলোচনা ও ঐকমত্যের কাঠামো

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মার্চ ২০২৫ থেকে দুই দফায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসে। প্রথম পর্যায় (২০ মার্চ–১৯ মে): ৩৩টি দলের সঙ্গে পৃথক আলোচনা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায় (২ জুন–৩১ জুলাই): ৩০টি দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন ২৩ দিনব্যাপী ধারাবাহিক বৈঠকে। এ প্রক্রিয়ায় মোট ১৯টি সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কার ইস্যুতে সম্মতির ভিত্তিতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ খসড়া প্রস্তুত হয়।

সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ দফা
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতামতের সুযোগ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর নির্ধারণ, 
নির্বাচনকালীন সরকারে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব, উচ্চকক্ষ গঠন ও ইলেক্টোরাল কলেজ চালু, দুদক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও পিএসসির নিয়োগে স্বচ্ছতা,  বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ

আংশিক মতভেদ:

সব দল একযোগে সনদের সব দফা মানছে না। দলভেদে মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপি বলেছে, তারা ১৯টির মধ্যে ১৫টি সংস্কারে একমত, তবে চারটি দফায় তারা সই দেবে না:
১. প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর বা
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) :উচ্চকক্ষে ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিকে অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর বলে মনে করছে।
২. প্রধানমন্ত্রীর দ্বৈত পদ বিলুপ্তি: একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান ও সরকারপ্রধান না থাকার প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করেছে।
৩. দুদক ও পিএসসি নিয়োগে কমিটি গঠন: এটি ক্ষমতার ভারসাম্য ভাঙবে বলে তাদের মত।
৪. তত্ত্বাবধায়ক প্রধান নির্বাচনে র‌্যাঙ্কড চয়েস: বিএনপি ‘সহজ গঠনমূলক নির্বাচন’ চায়, এই পদ্ধতিকে অকার্যকর বলে মনে করছে।
তবে তারা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনে আংশিক সমর্থন দিয়েছে, বিশেষ করে ‘আস্থা ভোট, নিরাপত্তা ও সংবিধান সংশোধন’ এ দলীয় অবস্থান বজায় রাখার শর্তে।

বাস্তবায়ন ছাড়া সই নয়

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সম্মত হয়েছে বেশিরভাগ সংস্কারে, তবে আইনি ভিত্তি না থাকলে তারা ঘোষণাপত্রে সই দেবে না। 

জামায়াত চায় নারী সরাসরি মনোনয়ন বাতিল করে সংসদে ১০০টি নারী আসন বাড়িয়ে প্রোপোরশনাল নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করা হোক। 
এনসিপি নারী প্রতিনিধিত্ব ৭% থেকে বাড়িয়ে ১৫% করার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা চায় গণপরিষদ ভিত্তিক সাংবিধানিক সংশোধন কাঠামো। দুই দলই জোর দিয়েছে আইনি রূপ ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ছাড়া সনদ কোনো অর্থ বহন করবে না।


জুলাই ঘোষণাপত্র

সরকার জানিয়েছে, ৫ আগস্ট বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনের মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ চত্বরে এক বিশেষ আয়োজনে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
 
একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা বলেছেন, ঘোষণাপত্র রাজনৈতিক দলিল হবে, নাকি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসম্পন্ন সাংবিধানিক রেফারেন্স হিসেবে গণ্য হবে।

বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “এ ঘোষণাপত্রটি যদি কেবল রাজনৈতিক অনুচ্চার প্রতিশ্রুতি হয়, তবে এর সাংবিধানিক গুরুত্ব থাকবে না। আমরা চাই, এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হোক।”


ঘোষণাপত্রে কী আছে

খসড়া ঘোষণাপত্রে মোট ২৬টি দফা রয়েছে। 
প্রথম ২১টি দফা: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান, গণআন্দোলনের ঐতিহাসিকতা ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিবরণ

শেষ ৫টি দফা: গুম-খুনের বিচারের অঙ্গীকার, মানবাধিকার রক্ষা, আইনের শাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি

এতে ২০২১–২০২৪ সালের রাজনৈতিক সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বিরোধীদলের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের স্বীকৃতি রাখা হয়েছে।


বিকল্প পথে বাস্তবায়ন: আইন, অধ্যাদেশ, গণভোট?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘোষণাপত্র কার্যকর করতে হলে থাকতে হবে একটি আইনি ভিত্তি। সম্ভাব্য ৩টি পথ:

১. রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ: জরুরি ভিত্তিতে এটি রূপান্তর করা যায়
২. সংসদীয় বিল: আলোচনা শেষে সংসদে প্রস্তাব পাশের মাধ্যমে স্বীকৃতি
৩. গণভোট: জনগণের প্রত্যক্ষ রায়ের মাধ্যমে সাংবিধানিক অনুমোদন
তবে এর কোনটি হবে, এখনো পরিষ্কার নয়। সরকার বা কমিশন এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট ঘোষণা দেয়নি।


এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতা কাটাতে জুলাই সনদ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে তা বাস্তবায়নে একটি স্পষ্ট রূপরেখা দরকার।” 

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “সবার জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্র উন্মুক্ত করতে হবে। যারা বর্তমানে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ, তাদের বিষয়েও ভাবতে হবে। তাহলেই গণতন্ত্র প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী হবে।”

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “এটি ইতিহাসের এক মোড়লগ্ন মুহূর্ত। আমরা ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে যে সনদ চূড়ান্ত করেছি, তা ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর বাস্তবায়ন কাঠামো নির্ধারণ।”

৫ আগস্টের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তেজনা। এতে থাকবেন ছাত্র আন্দোলনের নেতা, নিহতদের পরিবার, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে এই ঘোষণা কি কেবল অতীত স্মরণে একটি আয়োজিত মুহূর্ত, নাকি বাস্তব রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রথম ধাপ। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র রাশিদুল হক বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ ও তার ভিত্তিতে প্রস্তুত ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হতে পারে। যতি এটি আইনি কাঠামোতে প্রণীত হয়। সব রাজনৈতিক দল সম্মত হয়ে স্বাক্ষর করে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাস্তব বাস্তবায়ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। অন্যথায়, এই সনদ কেবল ঐতিহাসিক একটি প্রতীক, কিন্তু বাস্তব রাজনৈতিক পরিবর্তনের বাহক হয়ে উঠবে না।” 

ঢাকা/এএএম/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য হয়েছে: জহির উদ্দিন স্বপন
  • বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের পথে সরকার কতটা এগুলো?
  • ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ও ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ কী
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে আবার আলোচনা
  • ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ: সো ফার সো গুড
  • জুলাই সনদ ঘোষণায় শুরু হচ্ছে নতুন অধ্যায়
  • সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন
  • ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে গতি আনতে চায় কমিশন
  • রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র আর বেশিদিন টিকবে না
  • ঐকমত্য হয়েছে বেশ কিছু মৌলিক সংস্কারে