মৌলিক সংস্কারে এনসিপির রূপরেখা, মূল লক্ষ্য তিনটি
Published: 6th, May 2025 GMT
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে ‘মৌলিক সংস্কারের’ রূপরেখা তুলে ধরেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি বলেছে, মৌলিক সংস্কারের মূল লক্ষ্য তিনটি—ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহি ও বিকেন্দ্রীকরণ।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বর্ধিত আলোচনায় এনসিপি তাদের রূপরেখা তুলে ধরে। এনসিপি মনে করে, নির্বাচন যেকোনো সময় অনুষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু তার আগে অবশ্যই মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার দৃশ্যমান পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।
সংস্কার প্রশ্নের ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা করছে কমিশন। এর অংশ হিসেবে এনসিপির সঙ্গে এদিন আবার আলোচনা করেছে কমিশন। এর আগে গত ১৯ এপ্রিলও দলটির সঙ্গে কমিশনের আলোচনা হয়েছিল। মঙ্গলবার এনসিপির সঙ্গে কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়েছে।
মৌলিক সংস্কার বলতে এনসিপি বুঝিয়েছে, স্বৈরতান্ত্রিক ঝুঁকি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন। তারা রূপরেখায় বলেছে, গণ–অভ্যুত্থানের লক্ষ্য শুধু একটি নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া নয়, অবশ্যই নির্বাচন ক্ষমতার রূপান্তর নিশ্চিত করার মূল উপাদান। কিন্তু ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক অনুশীলন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে কি না, তা কখনোই শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় না।
সংস্কারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা হচ্ছে।—আখতার হোসেন, সদস্যসচিব, এনসিপি১৯৯১ সালে সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ ও এর পরের পরিস্থিতি তুলে ধরে রূপরেখায় বলা হয়, ‘যদি আমরা নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করি, অর্থাৎ মৌলিক সংস্কার আমলে না নিয়ে নির্বাচনমুখী ন্যূনতম সংস্কারের ওপর মনোনিবেশ করি (যা কেবল একটি অস্থায়ী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে) তাহলে বাংলাদেশ আবারও স্বৈরশাসনের ঝুঁকিতে পড়বে।’
এনসিপির রূপরেখায় মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো সাংবিধানিক ব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সাংবিধানিক পদে নিয়োগ, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার, স্থানীয় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার ও জনপ্রশাসন সংস্কার।
এনসিপি যেসব মৌলিক সংস্কারের কথা বলছে, তার অনেকগুলো সংবিধান–সম্পর্কিত। সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখন পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছে দলটি। তারা বলেছে, সামনে এ বিষয়ে আলোচনা হবে।
আলোচনা শেষে বিকেলে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, কতটুকু সংস্কার অবশ্যই করতে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিচ্ছে, সংস্কারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা হচ্ছে। এনসিপির পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা তাঁরা কমিশনে জমা দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো থেকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে।
আখতার হোসেন বলেন, তাঁরা যে রূপরেখা তুলে ধরেছেন, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে এবং সেগুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়।
আখতারের বক্তব্যের আগে এনসিপির রূপরেখার সারসংক্ষেপ সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন দলটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম।
সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও ক্ষমতার ভারসাম্যএনসিপি তাদের রূপরেখায় বলেছে, নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহির মধ্যে রাখতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন করতে হবে। সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ দেবে এই কাউন্সিল। আইনসভা হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। নিম্নকক্ষ বিদ্যমান পদ্ধতিতে এবং উচ্চকক্ষ গঠিত হবে ভোটের আনুপাতিক হারে। সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবেন। তবে সরকারের স্থিতিশীলতাও যেন ঠিক থাকে, সে ধরনের সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকতে হবে।
এনসিপির রূপরেখায় বলা হয়েছে, ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স হবে ১৬ বছর এবং সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স হবে ২৩। তথ্য প্রাপ্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন ও প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে। মৌলিক অধিকারবিরোধী দমনমূলক আইন ও সংবিধানে এ–সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ সংস্কার করতে হবে।
নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে রূপরেখায় কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে, কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। একই ব্যক্তি একসঙ্গে দলনেতা, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না। বিরোধী দল ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারবে। জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব কমিটি; পরিকল্পনা, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট দেওয়া যাবে (তবে সরকারের প্রতি অনাস্থা ভোট দেওয়া যাবে না)।
স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশননির্বাচন কমিশনকে (ইসি) স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে রূপরেখায়। এর মধ্যে আছে সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ, ইসির নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো ও বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা; ইসির মেয়াদে বা মেয়াদ–পরবর্তী সময়ে ইসির বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে তদন্তের ব্যবস্থা; সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন; ফলাফলের গেজেট প্রকাশের পরও জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেলে ফলাফল বাতিল ইত্যাদি।
বিচার বিভাগ ও অন্যান্যবিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নিজস্ব প্রশাসনিক সচিবালয় গঠন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, বিচারপতি নিয়োগে জুডিশিয়াল কমিশন ও মেধাভিত্তিক পরীক্ষা, আপিল বিভাগে বিচারপতি পদোন্নতিতে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং বিভাগীয় শহরগুলোয় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, সরকারি ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলার ক্ষেত্রে দুদককে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা বাতিল করা, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার ও নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে জনপ্রশাসনে বেশ কিছু সংস্কার আনার প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা শেষে বিকেলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, সংস্কার কার্যক্রমগুলোর বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে এখনো কমিশনের সঙ্গে তাঁদের আলোচনা হয়নি। তাঁরা বলে আসছেন, বর্তমান সংবিধান স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী কাঠামোতে ভরপুর। এর বাইরে নতুন একটি সংবিধানের কথা বলেছেন তাঁরা। নতুন সংবিধান বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই গণপরিষদ প্রয়োজন। সে জন্য ঐকমত্যের প্রয়োজন আছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সামনের দিনে আলোচনা করবেন। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়েও তাঁরা একটি লিখিত প্রস্তাব কমিশনকে দেবেন।
আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে এনসিপির প্রস্তাবিত রূপরেখা অনুযায়ী সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কি না—এমন প্রশ্নে আখতার হোসেন বলেন, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অনেক ধরনের বক্তব্য আসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এ বছরের ডিসেম্বর থেকে সামনের বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। এনসিপি মনে করে, সরকারের তরফ থেকে বিচার ও সংস্কারকাজ যদি দৃশ্যমান হয় এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা থাকে, তাহলে এ সময়কালের মধ্যে সেটাকে সামনে নিয়ে আসা সম্ভব এবং নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।
এর আগে দুপুরে আলোচনার বিরতিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষ ও উচ্চ কক্ষ—দুই কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং গণভোটে বিধান থাকতে হবে। প্রশ্ন উঠেছে, ছোটখাটো সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটে যেতে হবে কি না। পাওয়ার স্ট্রাকচার (ক্ষমতাকাঠামো), প্রস্তাবনা ও মূলনীতির মতো সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় সংশোধনের জন্য অবশ্যই গণভোটে যেতে হবে বলে তাঁরা মনে করেন। তবে ছোট সংশোধনীর ক্ষেত্রে গণভোটের বাধ্যবাধ্যকতা রাখার প্রয়োজন নেই।
আরও পড়ুনভোটারের বয়স ১৬, এমপি প্রার্থীর বয়স ২৩ বছর চায় এনসিপি৩ ঘণ্টা আগেজবাবদিহিমূলক বাংলাদেশের পথরেখাএনসিপির সঙ্গে আলোচনার শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এনসিপির পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের যে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, তা তাঁরা গ্রহণ করেছেন। পর্যালোচনা সাপেক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় এ রূপরেখার একটি প্রতিফলন পাওয়া যাবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকসহ বিভিন্নভাবে কমিশনের আলোচনা অগ্রসর হচ্ছে। এ অব্যাহত আলোচনার লক্ষ্য হচ্ছে, এমন একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা, যা গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক বাংলাদেশের পথরেখা নির্দেশ করবে।
আলোচনায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো.
অন্যদিকে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেনের নেতৃত্বে দলের মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার ও জাবেদ রাসিন এবং সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) আরমান হোসাইন আলোচনায় অংশ নেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এনস প র র পর খ আখত র হ স ন সদস যসচ ব র প রস ত ব ন শ চ ত কর র লক ষ য ব যবস থ সরক র র র সদস য ব চ রপত মন ত র ন করত গণভ ট
এছাড়াও পড়ুন:
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মান–অভিমান ও সহমত–দ্বিমত
‘লন্ডন বৈঠকের’ পর মনে হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় গতি এসেছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে যে কালো মেঘ ঘনীভূত হয়েছিল, তা অনেকটা কেটে গেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
সার্বিকভাবে নির্বাচনী রাজনীতিতে কতটা সুবাতাস এসেছে, সেই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে কিছু না বললেও তলেতলে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার প্রথম তিন দিনের বৈঠকে বেশ কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। দেশবাসী কোনো কোনো দলের মান–অভিমানও প্রত্যক্ষ করল। লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে যে ‘সমঝোতা’ হলো, জামায়াত ও এনসিপি তা ভালোভাবে নেয়নি। তারা বলেছে, এর মাধ্যমে সরকার একটি দলের প্রতি ঝুঁকে গেছে। প্রতিবাদস্বরূপ জামায়াত অভিমান করে প্রথম দিনের বৈঠকে যোগ দেয়নি।
প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে অনুরোধ পাওয়ার পর দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে তারা অংশ নেয় এবং নজিরবিহীনভাবে তিন নেতা বক্তব্য দেন। জামায়াত নেতাদের বেশি সময় দেওয়া ও গণফোরাম নেতার বক্তৃতায় বাধাদানের প্রতিবাদে সম্মেলনকক্ষ থেকে বেরিয়ে যান সিপিবি, ১২–দলীয় জোট ও গণফোরামের নেতারা। কিছুক্ষণ পর অবশ্য তাঁরা ফিরে যান।
এসব মান–অভিমান সত্ত্বেও ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে, যা রাজনৈতিক সমঝোতার পূর্বাভাস বলে ধারণা করি। সংবিধানে জগদ্দল পাথরের মতো যে ৭০ অনুচ্ছেদ চেপে বসেছিল, সেটা সরানো গেছে। সব দল একমত হয়েছে যে অর্থবিল, সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব ও যুদ্ধাবস্থা ছাড়া সব বিষয়ে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে ও ভোট দিতে পারবেন।
৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে সংসদ সদস্যদের হাত–পা ও মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন তাঁরা যেকোনো আইনকে জনস্বার্থবিরোধী মনে করলে বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। এই স্বাধীনতাটুকু অর্জন করতে আমাদের ৫৩ বছর লেগেছে।
তাত্ত্বিকভাবে এই সিদ্ধান্ত ভালো হলেও দলীয় মনোনয়নের বর্তমান ধারা অক্ষুণ্ন থাকলে এর সুফল তেমন পাওয়া যাবে না। এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় কমিটি থেকে আসা তালিকাকে বাধ্যতামূলক করেছিল। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার সেটা তুলে নেয়। তবে স্থানীয় কমিটিও যে সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়, তা–ও নয়। একটি উদাহরণ দিই। বিগত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সেলিনা হায়াৎ আইভীর নাম পাঠায়নি। ওই কমিটি ছিল শামীম ওসমানের নিয়ন্ত্রণে।
প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদ নিয়ে আপত্তি তুলেছে বিএনপি। এটা যদি ভূতাপেক্ষ না হয়, তাদের এই আপত্তির পক্ষে যুক্তি আছে বলে মনে করি না। একজন দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ক্ষমতা ধরে না রেখে সব দলেরই উচিত নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী পদে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করা উচিত ক্ষমতাপ্রত্যাশী সব দলেরই। নেতৃত্ব চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়।এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শামসুল হুদা কমিশনের বিধান ফিরিয়ে আনা গেলে মনোনয়ন–বাণিজ্য কমবে আশা করা যায়। দল না করেও কেউ টাকার জোরে মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে পারবেন না। এ ছাড়া স্থানীয় কমিটির সিদ্ধান্তে মনোনয়ন পেলে সংসদ সদস্যরা নিজ এলাকার জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন। ওপর থেকে মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ওপরের দিকেই তাকিয়ে থাকতেন। এলাকার মানুষের কথা ভাবতেন না।
প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় হলো, তিনি ওই এলাকার বাসিন্দা কি না। আমাদের জনপ্রতিনিধিদের বেশির ভাগই ‘অনাবাসী’। মনোনয়ন পাওয়ার পর অনেকে এলাকায় যান। তার আগে বা পরে এলাকাসীর সঙ্গে বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধির যোগাযোগ ক্ষীণ।
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ বাড়ানোর বিষয়ে দু–একটি ধর্মভিত্তিক দল ছাড়া সবাই একমত হয়েছে; কিন্তু নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বিমত আছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বর্তমান পদ্ধতিতেই নির্বাচন করার পক্ষপাতী। অন্যদিকে জামায়াত, এনসিপি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি সরাসরি ভোটের পক্ষে। উচ্চকক্ষের বিষয়েও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সহমত প্রকাশ করেছে কিন্তু নির্বাচনটি কোন পদ্ধতিতে হবে, তা নিয়ে দ্বিমত আছে।
বিএনপি ও এর সমমনারা চাইছে নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন। এনসিপি, জামায়াত ও বাম দলগুলো মনে করে, ভোটের আনুপাতিক হারে এটা হওয়া উচিত। একসময় বিজয়ী দলই সংরক্ষিত সব নারী আসন পেত। বিএনপি সেই আইন বদলে নারী আসনে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে। সেখান থেকে এখন পিছু হটার যুক্তি কী?
বিতর্ক আছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়েও। সংবিধান সংস্কার কমিশন যে ইলেকটোরাল কলেজের প্রস্তাব করেছে, সেটা কাদের নিয়ে হবে?
বিএনপি বলেছে, নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষের সদস্যদের ভোটে। বিরোধীরা বলেছে, যদি উচ্চকক্ষের নির্বাচন আনুপাতিক ভোটে না হয়, তাহলে সেখানে সংখ্যাগুরু দলেরই একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে। আবার একদিকে তারা স্থানীয় সরকার সংস্থাকে বিরাজনীতিকরণ করতে চাইছে, অন্যদিকে তাদের দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পদে নির্বাচনের কথা বলছে—এটা স্ববিরোধী।
প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদ নিয়ে আপত্তি তুলেছে বিএনপি। এটা যদি ভূতাপেক্ষ না হয়, তাদের এই আপত্তির পক্ষে যুক্তি আছে বলে মনে করি না। একজন দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ক্ষমতা ধরে না রেখে সব দলেরই উচিত নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী পদে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করা উচিত ক্ষমতাপ্রত্যাশী সব দলেরই। নেতৃত্ব চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বা হবে, সেসব ভিত্তি ধরেই এগোতে হবে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য বা সমঝোতা খুব জরুরি।
অনেক বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও তারা আগের অনড় অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের সঙ্গে আমরা আশাবাদী হতে চাই যে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা অবিলম্বে কেটে যাবে এবং জুলাইয়ের মধ্যেই জুলাই সনদ পাওয়া যাবে।
এদিকে লন্ডন বৈঠকের পর নির্বাচন কমিশনও নড়েচড়ে বসেছে। বৃহস্পতিবারের বৈঠকে তারা রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য আচরণবিধি সংশোধন করে খসড়া অনুমোদন করেছে। এতে নির্বাচনী প্রচারে প্রার্থীদের পোস্টার বাদ দেওয়া হলেও বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন সমস্যা তৈরি করল কি না, সেটাও দেখার বিষয়। দলীয় অঙ্গীকারনামা, এক প্ল্যাটফর্মে সব প্রার্থীর ইশতেহার ঘোষণার বিষয়টিও সমর্থনযোগ্য। নির্বাচনী প্রচারসভাও সব প্রার্থী মিলে একসঙ্গে করতে পারেন। এতে প্রার্থীদের খরচ ও পারস্পরিক কাদা–ছোড়াছুড়ি কিছুটা হলেও কমবে।
সংসদ নির্বাচনের আগে সীমানা নির্ধারণের বাধ্যবাধকতা থাকায় ৩০০ আসনের সীমানার খসড়া প্রকাশ করেছে ইসি। এ খসড়া প্রস্তাবের ওপর দাবি-আপত্তি শুনানি শেষে চূড়ান্ত সীমানার গেজেট প্রকাশ করা হয়। এখন পর্যন্ত সংসদের ৭৫টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য ৬০৭টি আবেদন পেয়েছে ইসি।
এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন একটি ভালো নির্বাচন করে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু তারা কিছু মন্দ নজিরও তৈরি করেছে। গ্রামাঞ্চলের আসন কমিয়ে শহরের আসন বাড়িয়ে দেওয়া হয় ২০০৮ সালের নির্বাচনে। কার পরামর্শে তারা এটি করেছিল, জানা নেই। এর ফলে অবহেলিত গ্রামাঞ্চল আরও অবহেলিত থেকে গেছে এবং শহুরে নাগরিকদের সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। রাষ্ট্রটি এখনো সংখ্যালঘু শহুরে নাগরিকদের থেকে গেল। গণমানুষের রাষ্ট্র হলো না।
আশা করি, বর্তমান নির্বাচন কমিশন আসন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলকে গুরুত্ব দেবে। গ্রামাঞ্চল থেকে যেসব আসন কর্তন করা হয়েছিল, সেগুলো ফিরিয়ে দেবে। বৈষম্যবিরোধী সফল আন্দোলনের পর যে নির্বাচন কমিশন এসেছে, তাদের কাছে এটুকু চাওয়া নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]
* মতামত লেখকের নিজস্ব