সাধারণ মানুষের কাছে বনরুই প্রায় অজানা এক প্রাণী। গভীর বনাঞ্চলের বাসিন্দা বিরল বনরুই মূলত রাতে বিচরণ করে। ফলে এই প্রাণী নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে আছে ভ্রান্ত ধারণা, বিশ্বাস এবং নানা আজগুবি গল্প। নিভৃতচারী হওয়ায় বিজ্ঞানীরাও বনরুই সম্পর্কে এখন পর্যন্ত খুব বেশি জানতে পারেননি। কয়েক দশক ধরে গোটা দুনিয়া থেকে এদের সংখ্যা কমছে আশঙ্কাজনক হারে।

বনরুইয়ের ইংরেজি নাম প্যাঙ্গোলিন; শব্দটি মালয় ভাষা থেকে ইংরেজিতে প্রবেশ করেছে। এর অর্থ গড়িয়ে দেওয়া বা গড়াগড়ি দেওয়া। মানুষ, শিকারি প্রাণী বা অন্য কোনো বিপদ দেখলেই বনরুই তার মুখ, হাত-পা ও লেজ গুটিয়ে বলের মতো আকার ধারণ করে। এমনভাবে মাটিতে পড়ে থাকবে যেন কোনো জড় বস্তু, দেহে কোনো প্রাণ নেই। বিপদ থেকে বাঁচতে বনরুই এমন নিখুঁত অভিনয় করে। দেহ শক্ত বর্মসদৃশ আঁশে? ঢাকা থাকায় এই প্রক্রিয়ায় বনরুই শিকারি থেকে নিজেকে রক্ষা করে।

বাংলায় বনরুই নামটি কীভাবে এল, কেন রাখা হয়েছে—এর হদিস পাওয়া যায় না। সম্ভবত বনে বসবাস, মাছের মতো দৈহিক আকৃতি, সেই সঙ্গে দেহে রুই মাছের মতো আঁশ থাকায় বনরুই নাম দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। এর অন্য নাম পিপীলিকাভুক, ইংরেজিতে অ্যান্ট ইটার। বনের পিঁপড়া, উইপোকা এদের প্রধান খাদ্য। বনে-বাদাড়ে পিপীলিকা ও উইপোকার বাসায় আক্রমণ করে খাবার শিকার করে। এমন খাদ্যাভ্যাস থেকে হয়তো পিপীলিকাভুক নাম রাখা হয়েছে।

পৃথিবীতে প্রাণীর আগমনের ধারা বিবেচনা করলে বনরুইকে বেশ প্রাচীন প্রাণীর তালিকায় রাখা যায়। মাংসাশী প্রাণী থেকে এদের উৎপত্তি হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। একদল প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক জার্মানির প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি পিট থেকে মধ্য ইওসিন সময়ের বনরুইয়ের একটি ফসিল খুঁজে পান। এই ফসিল থেকে বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, বনরুই আজ থেকে প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে এসেছে।

বনরুইয়ের দেহে সরীসৃপের মতো আঁশ থাকলেও এরা সরীসৃপ নয়, বিশেষ ধরনের বিরল স্তন্যপায়ী প্রাণী। এদের দেহের আঁশের ফাঁকে ফাঁকে হালকা লোম থাকে। বনরুই বাচ্চা প্রসব করে, জন্মের পর বাচ্চাকে দুধ পান করিয়ে বড় করে তোলে মা বনরুই। এসব বৈশিষ্ট্য বনরুইকে স্তন্যপায়ীর দলভুক্ত করেছে।

পৃথিবীতে আট প্রজাতির বনরুই দেখা যায়। এর মধ্যে চার প্রজাতির বনরুই আছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশে আছে দুই প্রজাতির বনরুই—ইন্ডিয়ান ও চায়নিজ। তবে বাংলাদেশে ইন্ডিয়ান বনরুইয়ের উপস্থিতির নির্ভরযোগ্য তথ্য আমাদের হাতে নেই। চায়নিজ বনরুই দেশের বেশ কিছু বনাঞ্চলে দেখা যায়। তবে খুবই বিরল। এরা একদিকে নিভৃতচারী, অন্যদিকে নিশাচর। দৈনন্দিন কাজ সবই সম্পন্ন হয় গভীর রাতের অন্ধকারে। ফলে মানুষের সঙ্গে এদের সাধারণত দেখা হয় না।

বুক ও পায়ের ভেতরের দিক ছাড়া বনরুইয়ের পুরো দেহ শক্ত আঁশে ঢাকা থাকে। লেজ ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার লম্বা হতে পারে। লম্বা লেজ দিয়ে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরতে পারে সহজেই। ফলে গাছে বিচরণ করতে বেশ পারদর্শী বনরুই। এদের ওজন হয় পাঁচ থেকে সাত কেজি। আঁশের ফাঁকে ফাঁকে পাতলা শক্ত লোম দেখা যায়। মাথা খাটো ও কোণাকৃতির। চোখও বেশ ছোট। কেঁচোর মতো সরু জিব ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পাগুলো খাটো। পায়ের আঙুল পাঁচটি, প্রতিটিতে ধারালো নখর থাকে। পিঁপড়ার গর্ত খুঁড়তে বেশ কাজে লাগে নখরগুলো।

বনরুই একা বা জোড়ায় বাস করে। বছরে সাধারণত একটি বাচ্চা প্রসব করে। তবে দুই থেকে তিনটি পর্যন্ত বাচ্চা হতে পারে। বাচ্চারা মায়ের পিঠের ওপর চড়ে বিচরণ করে। জন্মের সময় বাচ্চার আঁশগুলো খুব নরম থাকে। ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে ওঠে। বুনো পরিবেশে বনরুই ঠিক কত বছর বাঁচে, এটি বিজ্ঞানীরা এখনো জানতে পারেননি। চিড়িয়াখানায় ২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার রেকর্ড আছে।

অন্যান্য বুনো প্রাণীর মতো বনরুই নানা ধরনের জীবাণু ধারণ ও বহন করে। গবেষণা বলছে, বনরুই কয়েক ধরনের করোনাভাইরাস ও সার্স ভাইরাস বহন করে। ফলে বনরুইয়ের সংস্পর্শে এলে মানবদেহে এসব ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। তাই বনরুই ধরা বা মারা থেকে বিরত থাকতে হবে।

বর্তমানে যেসব প্রাণীর চোরাকারবার চলে, তার মধ্যে এই বনরুই সবার ওপরে। চোরা শিকারিরা বনরুই হত্যা করে এর মাংস, আঁশ ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার করে। প্রথাগত চীনা ওষুধ তৈরিতে এই বনরুইয়ের ব্যবহার বেশ পুরোনো। চীন, লাওস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে বনরুইয়ের প্রথাগত ব্যবহার বেশ।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বনরুই পাচার হয় বেশি। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নামও আছে। ২০১৬ সালে সাউথ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত সাইটিস (কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেনজার্ড স্পিসিজ) সভায় বনরুই–সম্পর্কিত সব ধরনের ব্যবসার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তদুপরি এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। ২০১৯ সালে বৈশ্বিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন চায়নিজ বনরুইকে মহাবিপন্ন প্রাণী ঘোষণা করে। চোরা শিকার ও বনাঞ্চল ধ্বংস বনরুইয়ের প্রধান হুমকি। আমাদের বনাঞ্চলগুলো থেকেও দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে বনরুই।

সম্প্রতি আইইউসিএন প্রকাশিত বনরুইয়ের পাচার ও অবৈধ চোরা শিকারের ওপর একটি গবেষণায় রোমহর্ষ তথ্য উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনমতে, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ বনরুই চোরা শিকারিরা হত্যা করেছে। এর মধ্যে সাড়ে আট হাজারের মতো এশিয়ান চার প্রজাতির বনরুই। বাকিগুলো আফ্রিকান প্রজাতির। এ তথ্য থেকে বোঝা যায়, বনরুই বিলুপ্তির ঝুঁকির তালিকায় কেন ওপরের দিকে।

পুরোপুরি জানার আগেই হয়তো বিরল এই প্রাণী হারিয়ে যাবে মানুষের এই পৃথিবী থেকে। অপরাপর প্রাণী ও বনাঞ্চল ধ্বংস করে আমরাই আমাদের ভবিষ্যৎকে ধীরে ধীরে বিপন্ন করে তুলছি।

এম এ আজিজ, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য় বনর ই ই বনর ই র ওপর ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

জামিনের পর মামলা নিয়ে মেহজাবীনের বিবৃতি

ব্যবসায় অংশীদার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২৭ লাখ টাকা ‘আত্মসাৎ করা ও হত্যার হুমকি দেওয়ার’ অভিযোগের মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী ও তার ভাই আলিসান চৌধুরী। 

রবিবার (১৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩ এর বিচারক আফরোজা তানিয়া শুনানি শেষে তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। গণমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন মেহজাবীন চৌধুরীর আইনজীবী তুহিন হাওলাদার। 

আরো পড়ুন:

আত্মসমর্পণ করে জামিন পেলেন মেহজাবীন চৌধুরী

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রসঙ্গে যা বললেন মেহজাবীন

সোমবার (১৭ নভেম্বর) সকালে মেহজাবীন চৌধুরী তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন। তাতে এ মামলার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন এই অভিনেত্রী।    

মেহজাবীন চৌধুরী বলেন, “একজন অজানা ব্যক্তি ২০২৫ সালের মার্চ মাসে আমার ও আমার ১৯ বছর বয়সি ছোট ভাইয়ের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন। গত নয় মাসে আমি এই মামলার কোনো তথ্য পাইনি, কারণ অভিযোগকারী পুলিশকে আমার সঠিক ফোন নম্বর, সঠিক ঠিকানা বা কোনো যাচাইকৃত তথ্য দিতে পারেননি। তিনি দাবি করেন যে, ২০১৬ সাল থেকে তিনি আমার সাথে ‘ব্যবসা’ করছিলেন।”  

মেহজাবীন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি অভিযোগকারী। এ বিষয়ে মেহজাবীন চৌধুরী বলেন, “তবে যোগাযোগের কোনো প্রমাণ নেই। তিনি বলেন, ‘তিনি ২০১৬ সাল থেকে আমাকে ফেসবুকে মেসেজ দিতেন। কিন্তু তিনি যা দেখাতে পারেননি।’ একটি মেসেজ যেটা তিনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন মেসেজের, হোয়াটসঅ্যাপ বা আমার নম্বরে, কিংবা আমার পক্ষ থেকে একটি উত্তর, এমনকি একটি স্ক্রিনশটও না।” 

অভিযোগকারীর পরিচয় অসম্পূর্ণ। এ তথ্য উল্লেখ করে মেহজাবীন চৌধুরী বলেন, “তার পরিচয় অসম্পূর্ণ। তার সম্পূর্ণ পরিচয়পত্র এখনো জমা দেয়া হয়নি। তার এনআইডি পর্যন্ত অনুপস্থিত। অভিযোগকারী ও তার আইনজীবী ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। গতকাল খবর প্রকাশ হওয়ার পর থেকে অভিযোগকারী তার ফোন বন্ধ করে রেখেছেন, এমনকি তার আইনজীবীর নম্বরও বন্ধ।” 

আর্থিক লেনদেনের কোনো নেই। মেহাজাবীনের ভাষায়, “আর্থিক লেনদেনের কোনো প্রমাণ নেই। তিনি দাবি করেন যে, তিনি আমাকে ২৭ লক্ষ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি দেখাতে পারেননি—কোনো ব্যাংক লেনদেন, কোনো চেক, বিকাশ লেনদেন, কোনো লিখিত চুক্তি, কোনো রশিদ, কোনো সাক্ষী, কিছুই না। একটি কাগজপত্রও নেই।” 

অপহরণের অভিযোগের বিষয়ে মেহজাবীন চৌধুরী বলেন, “১১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাটি সম্পূর্ণ প্রমাণহীন। তিনি দাবি করেন ১১ ফেব্রুয়ারি আমি তাকে চোখ বেঁধে হাতিরঝিলের একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিলাম, আমার ছোট ভাইসহ আরো ৪–৫ জনকে নিয়ে। গত নয় মাসে তিনি দেখাতে পারেননি রেস্টুরেন্ট বা আশেপাশের রাস্তার এক সেকেন্ডেরও সিসিটিভি ফুটেজ, কোনো সাক্ষী, কোনো প্রমাণ, কিছুই না। হাতিরঝিল ঢাকার সবচেয়ে বেশি সিসিটিভি-নিয়ন্ত্রিত এলাকা, তবু তিনি একটি ছবি বা ভিডিও ফুটেজ দেখাতে পারেননি।” 

মামলা হওয়ার পর ৯ মাস কেটে গেলেও কোনো নোটিশ পাননি মেহজাবীন চৌধুরী। এ তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, “গত নয় মাসে আমি কোনো নোটিশ পাইনি। এই নয় মাসে আমি কোনো পুলিশ স্টেশনের ফোন কল, কোনো কোর্টের নোটিশ বা ডকুমেন্ট। একটি নোটিশ পেলেও আমি অনেক আগে থেকেই আইনি ব্যবস্থা নিতাম।” 

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিয়েছেন মেহজাবীন। তার ভাষায়, “আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই মামলার কোনো ভিত্তি না থাকলেও, যখন জানতে পারলাম যে একটি অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে, তখন আমি আইনি প্রক্রিয়া মেনে জামিন নিয়েছি। কারণ আমি আমাদের আইন ও নিয়ম মানি। প্রমাণ ছাড়া দায়ের করা মামলা কখনো সত্য হয়ে যায় না। সত্য খুব দ্রুতই আদালতে পরিষ্কার হয়ে যাবে। এখনকার দিনে কাউকে অপমান করা, মানহানি করা বা ভাইরাল হওয়ার জন্য অন্যকে ব্যবহার করা খুবই সহজ হয়ে গেছে। এই ব্যক্তির যে উদ্দেশ্যই থাকুক, আমার বা আমার পরিবারের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করে, সে যা-ই করতে চায়—আমি বিশ্বাস করি সবকিছু খুব দ্রুতই পরিষ্কার হয়ে যাবে।” 

অনুরোধ জানিয়ে মেহজাবীন চৌধুরী বলেন, “এর আগ পর্যন্ত আমি সবাইকে অনুরোধ করব—দয়া করে সহানুভূতিশীল হোন, দয়া করে মানবিক হোন এবং কাউকে না জেনে কোনো মিডিয়া ট্রায়াল শুরু করবেন না। গত ১৫ বছর ধরে আমি আমার কাজ, আমার পেশা এবং আমার দর্শকদের জন্য যে পরিমাণ পরিশ্রম এবং নিষ্ঠা দিয়ে এসেছি, সেই পরিশ্রমের পরেও আজ আমাকে এসব ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে—এটাই সবচেয়ে দুঃখজনক।”

ঢাকা/শান্ত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জামিনের পর মামলা নিয়ে মেহজাবীনের বিবৃতি