শ্রমিকদের স্বার্থে আইএলওর তিন কনভেনশনে সই করছে সরকার
Published: 2nd, October 2025 GMT
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তিনটি কনভেনশন একসঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসমর্থন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এর ফলে শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হবে এবং কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি কমবে বলে মনে করছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তবে কারখানার মালিকদের এ বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
কনভেনশনগুলো হচ্ছে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক কনভেনশন ১৫৫, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার মান উন্নয়নে প্রচারণামূলক কাঠামো কনভেনশন ১৮৭ এবং কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধবিষয়ক কনভেনশন ১৯০। এ তিনটির মধ্যে ১৮৭ ও ১৫৫ আইএলওর মৌলিক কনভেনশন। ২০২২ সালে এ দুটিকে মৌলিক কনভেনশন হিসেবে গ্রহণ করে আইএলও।
অন্তর্বর্তী সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। এ বিষয়ে ব্লাস্টের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটির অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেছেন, অনেক দিন ধরে অধিকারভিত্তিক সংগঠনগুলো এই তিন কনভেনশন অনুসমর্থনের দাবি জানিয়ে আসছিল। অনুসমর্থনের পর শ্রমিকের নিরাপত্তা অধিকারের পরিধি নিয়ে আরও স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে এবং অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের প্রতিকার পাওয়া সহজ হবে। তবে এগুলো বাস্তবায়নে সরকারকে আইন প্রণয়ন বা সংশোধনে মনোযোগী হতে হবে।
কবে হবে অনুসমর্থনপ্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে গত ২৪ জুলাই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তিন কনভেনশনে অনুসমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ মাসেই কনভেনশনগুলো স্বাক্ষরের কথা রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্প্রতি আইএলও কনভেনশন স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আয়োজনের তারিখ ও সময় জানতে চেয়ে ইতিমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।
শ্রমসচিব মো. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই আইএলওর তিন কনভেনশন অনুসমর্থন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এটি হলে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে।
এখন পর্যন্ত কতটি অনুসমর্থন হয়েছে১৯১৯ সালের ১৯ এপ্রিল ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী গঠিত হয় আইএলও, যার বর্তমান সদস্য ১৮৭। ১৯৪৬ সালে এটি জাতিসংঘের সহায়ক সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৬৯ সালে সংস্থাটি উন্নয়নশীল দেশে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কারণে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পায়। আইএলওর মৌলিক ৮টিসহ এ পর্যন্ত ৩৬টি কনভেনশন ও একটি প্রটোকলে অনুস্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। তবে কনভেনশনগুলোর মধ্যে ৩১টি বর্তমানে কার্যকর রয়েছে।
গত বছরের ৭ জুন ২০২৪-২৭ মেয়াদের জন্য বাংলাদেশ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আইএলওর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ ১৯৯৬-৯৯ ও ২০০৮-১১ মেয়াদে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল।
বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্থির সময়ে সরকার কেন স্বপ্রণোদিত হয়ে আইএলওর তিন কনভেনশন অনুসমর্থন করতে যাচ্ছে, আমরা তা বুঝতে পারছি না, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো দেশ আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থন করেনি। জাতীয় স্বার্থে আলোচ্য তিন কনভেনশনের অনুসমর্থন থেকে সরকারের সরে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যআইএলও ১৯৮১ সালে পেশাগত নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য কনভেনশন গ্রহণ করে। এটি আইএলও কনভেনশন ১৫৫, যা অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ (ওএসএইচ) হিসেবে পরিচিত। এখন পর্যন্ত মোট ৮৩টি সদস্যরাষ্ট্র এ কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ এ কনভেনশন অনুসমর্থন করেনি।
কর্মক্ষেত্রে ওএসএইচ সংস্কৃতি গড়ে উঠলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলোর আস্থা অর্জনে ভূমিকা রাখবে। এটি অনুসমর্থন করলে প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়। শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য নিয়োগকর্তাদের দায়িত্ব নিতে হয়।
তিন কনভেনশনকে অনুসমর্থনের পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে আসার জন্য এক বছরের বেশি সময় ধরে শ্রম উপদেষ্টার পাশাপাশি কাজ করেছেন সদ্যবিদায়ী শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিন কনভেনশন অনুসমর্থন করলে চূড়ান্ত অর্থে লাভবান হবেন শিল্পকারখানার মালিকেরা। ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব কারখানার মালিকেরই এতে সম্মতি রয়েছে।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার মান উন্নয়নআইএলও কনভেনশন ১৮৭ গৃহীত হয় ২০০৬ সালে। এটিও ওএসএইচ নামে পরিচিত। ১৫৫ ও ১৮৭ মোটামুটি কাছাকাছি ধরনের। কনভেনশন ১৮৭ অনুসমর্থন করেছে এ পর্যন্ত ৬৯টি সদস্যদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ এটি অনুসমর্থন করেনি।
এ কনভেনশনের মূল উদ্দেশ্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নয়ন ও ক্রমাগত উন্নতিতে সহায়তা করা। এটি অনুসমর্থন করার পর নিয়োগকর্তারা শ্রমিকদের পেশাগত আঘাত, রোগ এবং মৃত্যু প্রতিরোধে অধিকতর মনোযোগী হবেন।
কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধআইএলও কনভেনশন ১৯০ গৃহীত হয় ২০১৯ সালে। এটি অনুসমর্থন করেছে ৪৯টি সদস্যদেশ। এটি অনুসমর্থনের ফলে পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে ও কর্মক্ষেত্রে কর্মরত নারী কর্মী ও শ্রমিকদের অপ্রত্যাশিত আচরণ ও হয়রানি থেকে মুক্ত রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। মালিকপক্ষও হয়রানি থকে সুরক্ষা পাবে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের এক নির্দেশনার সঙ্গে কনভেনশন ১৯০ সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে জানা গেছে।
সূত্রগুলো জানায়, কনভেনশন ১৯০–এর সঙ্গে সংগতি রেখে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কিছু আইনকানুন তৈরি করছে।
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তিন কনভেনশন অনুসমর্থনের পর একদিকে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, অন্যদিকে মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষেরই দায়বদ্ধতা বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত এখনো কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থন করেনি। বাংলাদেশ কেন করছে, এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, তাদের দেশে তো রানা প্লাজা বা তাজরীন ফ্যাশনস ট্র্যাজেডি ঘটেনি। তাদের দেশে তো ৪৮ হাজার অজ্ঞাতনামা শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা হয় না, পরে আবার সেগুলো তুলে নিতে হয় না। তাদের দেশে বেতন-মজুরির দাবিতে আন্দোলন করতে হয় না, সে আন্দোলন থামাতে জলকামানও ব্যবহার করতে হয় না। একটি গেঞ্জি চুরির জন্য শ্রমিককে পিটিয়ে মেরে ফেলার উদাহরণও নেই। তিনি মনে করেন, ১৯০সহ তিন কনভেনশন অনুসমর্থন করলে শুধু শ্রমিক নন, মালিকপক্ষের জন্যও ভালো হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক ক কনভ নশন ন উপদ ষ ট ও হয়র ন র জন য সদস য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সাত বছর আগে সাংবাদিক খাসোগি হত্যার পর প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন সৌদি যুবরাজ
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। আগামীকাল মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে তিনি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করবেন। বৈঠকের লক্ষ্য তেল ও নিরাপত্তা খাতে দুদেশের বহু দশকের সহযোগিতার সম্পর্ক আরও গভীর করা। একই সঙ্গে বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং সম্ভাব্য পারমাণবিক জ্বালানি খাতে সম্পর্ক আরও বিস্তৃত করা।
২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সাংবাদিক এবং সৌদি রাজপরিবারের কট্টর সমালোচক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর এটাই যুবরাজ সালমানের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর।
আরও পড়ুনসৌদি আরবের যুবরাজের সঙ্গে বৈঠক করলেন ট্রাম্প১৩ মে ২০২৫সৌদি আরবের গোয়েন্দারা ইস্তাম্বুলে সৌদি দূতাবাসের ভেতর খাসোগিকে হত্যা করেছিলেন বলে অভিযোগ। এ হত্যাকাণ্ড বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। অনেকে অভিযোগ করেছিলেন, খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পেছনে যুবরাজ সালমানের হাত রয়েছে।
পরে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল, যুবরাজই খাসোগিকে অপহরণ বা হত্যার অনুমোদন দিয়েছিলেন।
যুবরাজ সালমান খাসোগিকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে তিনি সৌদি আরব সরকারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে এ হত্যার দায় স্বীকার করেছিলেন।
খাসোগি হত্যার পর সাত বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং সবচেয়ে বেশি তেল উত্তোলনকারী দেশ সৌদি আরব নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক নতুন করে এগিয়ে নিতে চাইছে।
আরও পড়ুনসৌদি আরবের সঙ্গে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রির চুক্তি’ যুক্তরাষ্ট্রের১৩ মে ২০২৫ট্রাম্প গত মে মাসে সৌদি আরবে তাঁর সফরের সময় দেওয়া ৬০ হাজার কোটি ডলারের সৌদি বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছেন।
মে মাসের ওই সফরে ট্রাম্প সৌদি আরবে মানবাধিকার–সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা স্পষ্টভাবে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এবারও তিনি একই পথে হাঁটবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে যুবরাজ মোহাম্মদ আঞ্চলিক অস্থিরতার মধ্যে নিজ দেশের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাইছেন। একই সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি (এআই) এবং বেসামরিক খাতে একটি পারমাণবিক প্রকল্প চুক্তির পথে অগ্রসর হতে চাইছেন।
আরও পড়ুনখাসোগি হত্যা সবচেয়ে জঘন্য ধামাচাপার ঘটনা: ট্রাম্প২৪ অক্টোবর ২০১৮যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরেই এমন একটি সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যেখানে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাদের পছন্দমতো দামে তেল বিক্রি করবে এবং যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে নিরাপত্তা দেবে।
আরও পড়ুনখাসোগিকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে: সৌদি আরব২৬ অক্টোবর ২০১৮