প্রকৃতিতে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করে। কারণ, প্রকৃতির সবকিছুই নিয়ম মেনে চলে এবং সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে। সব গ্রহ-উপগ্রহ নিজ নিজ কক্ষপথে চলে, তাই কোনো অঘটন ঘটে না। অনেক বিশৃঙ্খল আচরণের অন্তরালেও প্রাণিকুলের মধ্যে শৃঙ্খলা বিরাজ করে।

প্রাণী হিসেবে মানুষের কথাই ধরা যাক। আমাদের অনেকগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে—নাক, কান, মুখ, হাত, পা ইত্যাদি। প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আলাদা কাজ রয়েছে। আমরা নাক দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নিই, মুখ দিয়ে খাই। কিন্তু নাক দিয়ে খেতে গেলে গুরুতর সমস্যায় পড়তে হয়। হাত দিয়ে হাঁটা সম্ভব নয়।

তেমনিভাবে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ রয়েছেন—যেমন ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, রাজনীতিবিদ প্রমুখ। তাঁদের প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা আছে। ছাত্ররা লেখাপড়া করবে জ্ঞানার্জনের জন্য। শিক্ষকেরা পাঠদান করবেন এবং গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের পরিধি বাড়াবেন। রাজনীতিবিদেরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হবেন, রাজনৈতিক দল গঠন করবেন, নির্বাচনে অংশ নেবেন, সরকার গঠন করবেন এবং জনস্বার্থে সরকার পরিচালনা করবেন। এভাবে সবাই যদি তাঁদের কাজ যথাযথভাবে সম্পাদন করেন, তাহলে সমাজ সুশৃঙ্খলভাবে চলবে এবং সামনে এগিয়ে যাবে।

আরও পড়ুনছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মুক্তি’ দেবে কে২৭ আগস্ট ২০২৩

কিন্তু আমাদের সমাজে শিক্ষকেরা, বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক—কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দলীয় রাজনীতিতেই ব্যস্ত। জ্ঞান অন্বেষণ ও বিতরণের পরিবর্তে দলবাজিতেই তাঁদের অনেক সময় কাটে। গত কয়েক দশকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দল ভারী করার লক্ষ্যে শিক্ষকের পরিবর্তে ভোটারই নিয়োগ করা হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ফলে নামকরা আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেও দলবাজির কারণে অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে পারেন না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসকেরা সাদা-নীল দলের ভোটার নিয়োগেই বহুলাংশে ব্যস্ত।

অন্যদিকে ছাত্রদের অনেকেই ব্যস্ত লেখাপড়া বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্ররাজনীতিতে। দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নই তাদের মূল লক্ষ্য। তাই এটিকে ছাত্ররাজনীতি বলা যায় না; বরং এটি রাজনৈতিক দল কর্তৃক ছাত্রদের ব্যবহার—মূলত লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহারের রাজনীতি।

এ লাঠিয়াল তৈরির রাজনীতির কারণেই গত জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দর্পভরে বলতে পেরেছিলেন, আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করতে তাঁদের ছাত্রলীগই যথেষ্ট! এবারই প্রথম নয়, অতীতেও আমরা এমন কথা শুনেছি। আর এসব লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যদের এমন কোনো জঘন্য কাজ নেই, যা তারা অতীতে করেনি। এর একটি নিকৃষ্টতম উদাহরণ হলো শেখ হাসিনার প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সেঞ্চুরিয়ন’ মানিকের সৃষ্টি, যে গর্ব করে তার শততম ধর্ষণ উদ্‌যাপন করেছিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই এই দানব শাস্তির আওতায় না এসে নিরাপদে বিদেশে পালিয়ে যেতে পেরেছিল।

ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির আরেকটি পরিণতি হলো শিক্ষার মানে চরম ধস নামা। প্রতিবেশী ভারতের আইআইটির মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। অথচ ভারতের আইআইটির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাই এখন গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো প্রযুক্তি খাতের বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। পরিতাপের বিষয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে, আমরা তখন ব্যস্ত অহেতুক রাজনৈতিক কলহে!

ছাত্র-শিক্ষকের এসব ভূমিকার পরিণতি কি আমরা লক্ষ করেছি? সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পর প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর একজনও বিশ্বমানের বিজ্ঞানী বের হননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর তার লেখাপড়া ও গবেষণার জন্য বিশ্বে পরিচিত নয়; বরং পরিচিত ছাত্ররাজনীতির নামে গণরুম, মারামারি আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ যেন সন্ত্রাসের আখড়ায় পরিণত হয়েছে এবং ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হওয়ার যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলেছে।

লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষকরাজনীতির একটি নগ্ন পরিণতি দৃশ্যমান হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক চরম অব্যবস্থাপূর্ণ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময়ে। কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো এবং কয়েকজন শিক্ষকের নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার নাটক—সবই লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষকরাজনীতির প্রতিফলন বলেই অনেকের ধারণা। আমি নিজেও ষাটের দশকে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছি, কিন্তু কারও লেজুড় হওয়ার মতো অমর্যাদাকর সম্পর্কে জড়িত হওয়ার কথা আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল।

ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির আরেকটি পরিণতি হলো শিক্ষার মানে চরম ধস নামা। প্রতিবেশী ভারতের আইআইটির মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। অথচ ভারতের আইআইটির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাই এখন গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো প্রযুক্তি খাতের বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। পরিতাপের বিষয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে, আমরা তখন ব্যস্ত অহেতুক রাজনৈতিক কলহে!

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র-তরুণদের একটি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে, যার সামান্য কৃতিত্ব উনসত্তরের আইয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলনে আমার নিজের ভূমিকার জন্য আমিও দাবি করতে পারি। আমাদের জাতির প্রতিটি যুগসন্ধিক্ষণে ছাত্রদের আত্মত্যাগ ও অবদানের কারণে গর্ব করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনার দায়িত্ব তো ছিল আমাদের রাজনীতিবিদদের, ছাত্রদের নয়। জাতির ক্রান্তিকালে আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদেরা কি তাহলে তাঁদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি?

কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন—ছাত্ররাজনীতি না থাকলে আমরা কি শেখ হাসিনাকে তাড়াতে পারতাম? আমার ধারণা, লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি না থাকলে শেখ হাসিনা আরও অনেক আগেই বিতাড়িত হতেন। আমরা কি ভুলে গিয়েছি, ছাত্রলীগ যেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, সেদিন থেকেই হেলমেট বাহিনীও উধাও হয়ে গিয়েছিল এবং আওয়ামী লীগের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল? তেমনিভাবে আইয়ুব-মোনায়েম সমর্থনপুষ্ট এনএসএফ উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল বলেই আইয়ুব শাহির পতন সম্ভব হয়েছিল।

অনেকেই আরও প্রশ্ন করবেন—ছাত্ররাজনীতি না থাকলে কি নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ছেদ পড়বে? গত কয়েক দশকে লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে যে ‘নেতৃত্ব’ সৃষ্টি হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই ছাত্রজীবনে ছিলেন অনেকটা পেশাদার রাজনীতিবিদ। তাঁদের অনেকেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে, কিন্তু লেখাপড়া নেই। একটি আধুনিক রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হয়, সে সম্পর্কে তাঁদের অনেকের কোনো ধারণাই নেই। লেজুড়বৃত্তির লাঠিয়ালি ছাত্ররাজনীতিতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা আর সম্পৃক্ত হন না।

এটি হয়তো অনেকেরই অজানা যে লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির নামে এখন যা চলছে, তা আইনসিদ্ধ নয়। ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে দলের গঠনতন্ত্রে লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক সংগঠন এবং বিদেশি শাখা না থাকার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)-এ সন্নিবেশিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে নবম জাতীয় সংসদ তার প্রথম অধিবেশনে রেটিফাই বা অনুমোদন করে [আরপিওর ৯০ খ (১) (খ) (ই)]। এ বিধানের উদ্দেশ্য ছিল এসব সংগঠনের অপকর্ম রোধ করে বিলুপ্তি ঘটানো। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো পরবর্তী সময়ে এ বিধান তাদের গঠনতন্ত্র থেকে বাদ দিলেও ‘ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন’ বলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাস ও অন্যান্য অপকর্মমুক্ত এবং জ্ঞানার্জনে নিবিষ্ট রাখার স্বার্থে তাই রাজনীতিবিদদের প্রতি আজকে আমাদের আহ্বান, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন, লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করুন, দয়া করে আমাদের ছাত্রদের ছাত্র থাকতে দিন। আপনারা আপনাদের রাজনীতি করুন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বিদেশি শাখা বিলুপ্ত করুন। প্রসঙ্গত, লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের বিদেশি শাখা বিলুপ্ত করার পক্ষে জনমত বিরাজ করছে—অধিকাংশ অভিভাবকই এর বিপক্ষে।

ড.

বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ব শ বব দ য ব শ বব দ য ল র জন ত ব দ র র জন ত দ র অন ক ক র জন ত র জন ত র ন করব ন আম দ র পর চ ল র জন য অন ক র স গঠন

এছাড়াও পড়ুন:

দয়া করে ছাত্রদের ছাত্র থাকতে দিন

প্রকৃতিতে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করে। কারণ, প্রকৃতির সবকিছুই নিয়ম মেনে চলে এবং সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে। সব গ্রহ-উপগ্রহ নিজ নিজ কক্ষপথে চলে, তাই কোনো অঘটন ঘটে না। অনেক বিশৃঙ্খল আচরণের অন্তরালেও প্রাণিকুলের মধ্যে শৃঙ্খলা বিরাজ করে।

প্রাণী হিসেবে মানুষের কথাই ধরা যাক। আমাদের অনেকগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে—নাক, কান, মুখ, হাত, পা ইত্যাদি। প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আলাদা কাজ রয়েছে। আমরা নাক দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নিই, মুখ দিয়ে খাই। কিন্তু নাক দিয়ে খেতে গেলে গুরুতর সমস্যায় পড়তে হয়। হাত দিয়ে হাঁটা সম্ভব নয়।

তেমনিভাবে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ রয়েছেন—যেমন ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, রাজনীতিবিদ প্রমুখ। তাঁদের প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা আছে। ছাত্ররা লেখাপড়া করবে জ্ঞানার্জনের জন্য। শিক্ষকেরা পাঠদান করবেন এবং গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের পরিধি বাড়াবেন। রাজনীতিবিদেরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হবেন, রাজনৈতিক দল গঠন করবেন, নির্বাচনে অংশ নেবেন, সরকার গঠন করবেন এবং জনস্বার্থে সরকার পরিচালনা করবেন। এভাবে সবাই যদি তাঁদের কাজ যথাযথভাবে সম্পাদন করেন, তাহলে সমাজ সুশৃঙ্খলভাবে চলবে এবং সামনে এগিয়ে যাবে।

আরও পড়ুনছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মুক্তি’ দেবে কে২৭ আগস্ট ২০২৩

কিন্তু আমাদের সমাজে শিক্ষকেরা, বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক—কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দলীয় রাজনীতিতেই ব্যস্ত। জ্ঞান অন্বেষণ ও বিতরণের পরিবর্তে দলবাজিতেই তাঁদের অনেক সময় কাটে। গত কয়েক দশকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দল ভারী করার লক্ষ্যে শিক্ষকের পরিবর্তে ভোটারই নিয়োগ করা হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ফলে নামকরা আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেও দলবাজির কারণে অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে পারেন না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসকেরা সাদা-নীল দলের ভোটার নিয়োগেই বহুলাংশে ব্যস্ত।

অন্যদিকে ছাত্রদের অনেকেই ব্যস্ত লেখাপড়া বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্ররাজনীতিতে। দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নই তাদের মূল লক্ষ্য। তাই এটিকে ছাত্ররাজনীতি বলা যায় না; বরং এটি রাজনৈতিক দল কর্তৃক ছাত্রদের ব্যবহার—মূলত লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহারের রাজনীতি।

এ লাঠিয়াল তৈরির রাজনীতির কারণেই গত জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দর্পভরে বলতে পেরেছিলেন, আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করতে তাঁদের ছাত্রলীগই যথেষ্ট! এবারই প্রথম নয়, অতীতেও আমরা এমন কথা শুনেছি। আর এসব লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যদের এমন কোনো জঘন্য কাজ নেই, যা তারা অতীতে করেনি। এর একটি নিকৃষ্টতম উদাহরণ হলো শেখ হাসিনার প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সেঞ্চুরিয়ন’ মানিকের সৃষ্টি, যে গর্ব করে তার শততম ধর্ষণ উদ্‌যাপন করেছিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই এই দানব শাস্তির আওতায় না এসে নিরাপদে বিদেশে পালিয়ে যেতে পেরেছিল।

ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির আরেকটি পরিণতি হলো শিক্ষার মানে চরম ধস নামা। প্রতিবেশী ভারতের আইআইটির মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। অথচ ভারতের আইআইটির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাই এখন গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো প্রযুক্তি খাতের বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। পরিতাপের বিষয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে, আমরা তখন ব্যস্ত অহেতুক রাজনৈতিক কলহে!

ছাত্র-শিক্ষকের এসব ভূমিকার পরিণতি কি আমরা লক্ষ করেছি? সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পর প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর একজনও বিশ্বমানের বিজ্ঞানী বের হননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর তার লেখাপড়া ও গবেষণার জন্য বিশ্বে পরিচিত নয়; বরং পরিচিত ছাত্ররাজনীতির নামে গণরুম, মারামারি আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ যেন সন্ত্রাসের আখড়ায় পরিণত হয়েছে এবং ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হওয়ার যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলেছে।

লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষকরাজনীতির একটি নগ্ন পরিণতি দৃশ্যমান হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক চরম অব্যবস্থাপূর্ণ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময়ে। কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো এবং কয়েকজন শিক্ষকের নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার নাটক—সবই লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষকরাজনীতির প্রতিফলন বলেই অনেকের ধারণা। আমি নিজেও ষাটের দশকে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছি, কিন্তু কারও লেজুড় হওয়ার মতো অমর্যাদাকর সম্পর্কে জড়িত হওয়ার কথা আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল।

ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির আরেকটি পরিণতি হলো শিক্ষার মানে চরম ধস নামা। প্রতিবেশী ভারতের আইআইটির মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। অথচ ভারতের আইআইটির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাই এখন গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো প্রযুক্তি খাতের বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। পরিতাপের বিষয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে, আমরা তখন ব্যস্ত অহেতুক রাজনৈতিক কলহে!

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র-তরুণদের একটি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে, যার সামান্য কৃতিত্ব উনসত্তরের আইয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলনে আমার নিজের ভূমিকার জন্য আমিও দাবি করতে পারি। আমাদের জাতির প্রতিটি যুগসন্ধিক্ষণে ছাত্রদের আত্মত্যাগ ও অবদানের কারণে গর্ব করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনার দায়িত্ব তো ছিল আমাদের রাজনীতিবিদদের, ছাত্রদের নয়। জাতির ক্রান্তিকালে আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদেরা কি তাহলে তাঁদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি?

কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন—ছাত্ররাজনীতি না থাকলে আমরা কি শেখ হাসিনাকে তাড়াতে পারতাম? আমার ধারণা, লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি না থাকলে শেখ হাসিনা আরও অনেক আগেই বিতাড়িত হতেন। আমরা কি ভুলে গিয়েছি, ছাত্রলীগ যেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, সেদিন থেকেই হেলমেট বাহিনীও উধাও হয়ে গিয়েছিল এবং আওয়ামী লীগের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল? তেমনিভাবে আইয়ুব-মোনায়েম সমর্থনপুষ্ট এনএসএফ উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল বলেই আইয়ুব শাহির পতন সম্ভব হয়েছিল।

অনেকেই আরও প্রশ্ন করবেন—ছাত্ররাজনীতি না থাকলে কি নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ছেদ পড়বে? গত কয়েক দশকে লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে যে ‘নেতৃত্ব’ সৃষ্টি হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই ছাত্রজীবনে ছিলেন অনেকটা পেশাদার রাজনীতিবিদ। তাঁদের অনেকেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে, কিন্তু লেখাপড়া নেই। একটি আধুনিক রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হয়, সে সম্পর্কে তাঁদের অনেকের কোনো ধারণাই নেই। লেজুড়বৃত্তির লাঠিয়ালি ছাত্ররাজনীতিতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা আর সম্পৃক্ত হন না।

এটি হয়তো অনেকেরই অজানা যে লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির নামে এখন যা চলছে, তা আইনসিদ্ধ নয়। ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে দলের গঠনতন্ত্রে লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক সংগঠন এবং বিদেশি শাখা না থাকার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)-এ সন্নিবেশিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে নবম জাতীয় সংসদ তার প্রথম অধিবেশনে রেটিফাই বা অনুমোদন করে [আরপিওর ৯০ খ (১) (খ) (ই)]। এ বিধানের উদ্দেশ্য ছিল এসব সংগঠনের অপকর্ম রোধ করে বিলুপ্তি ঘটানো। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো পরবর্তী সময়ে এ বিধান তাদের গঠনতন্ত্র থেকে বাদ দিলেও ‘ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন’ বলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাস ও অন্যান্য অপকর্মমুক্ত এবং জ্ঞানার্জনে নিবিষ্ট রাখার স্বার্থে তাই রাজনীতিবিদদের প্রতি আজকে আমাদের আহ্বান, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন, লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করুন, দয়া করে আমাদের ছাত্রদের ছাত্র থাকতে দিন। আপনারা আপনাদের রাজনীতি করুন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বিদেশি শাখা বিলুপ্ত করুন। প্রসঙ্গত, লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের বিদেশি শাখা বিলুপ্ত করার পক্ষে জনমত বিরাজ করছে—অধিকাংশ অভিভাবকই এর বিপক্ষে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ