পদ্মায় ভেসে গেল তীর রক্ষা বাঁধের ৩৫ কোটি টাকার জিও ব্যাগ
Published: 2nd, October 2025 GMT
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলায় পদ্মা নদীর তীর রক্ষা বাঁধের দুই কিলোমিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়েছে। ওই প্রকল্প রক্ষা বাঁধের ৩৫ কোটি টাকার বালু ভর্তি জিও ব্যাগ নদীতে ভেসে গেছে। গত এক মাসের ভাঙনে ওই এলাকার ১৫০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে।
উপজেলার পূর্ব নাওডোব ইউনিয়নের জিরোপয়েন্ট এলাকা থেকে জাজিরা ইউনিয়নের পাথালিয়াকান্দি এলাকা পর্যন্ত ৮ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। নির্মাণাধীন সেই বাঁধের জিরোপয়েন্ট এলাকা থেকে কাথারিয়াকান্দি এলাকা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার অংশ ভাঙনের মুখে পড়েছে। ওই স্থান দিয়ে নদী ভেঙে ১০ মিটার থেকে ১১০ মিটার পর্যন্ত ভেতরে প্রবেশ করেছে। ধীরগতিতে ও দেরিতে কাজ শুরু করায় ভাঙনের কবলে পড়েছে বলে দাবি স্থানীয় লোকজন ও পাউবোর কর্মকর্তাদের।
পাউবো সূত্র জানায়, পদ্মা নদী জাজিরার নাওডোবা এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে। জাজিরার নাওডোবায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়। তার ভাটিতে পূর্ব নাওডোবার জিরোপয়েন্ট এলাকা থেকে বিলাশপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত পদ্মার ভাঙন রয়েছে। ভাঙনের কবল থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য ২০২৩ সালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ৮৬০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়। ওই ৮ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে পূর্ব নাওডোবা, পালেরচর, বড়কান্দি, জাজিরা ও বিলাশপুর ইউনিয়নে। প্রকল্পের আওতায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ও পাথরের ব্লক দিয়ে নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করার কাজ চলছে।
নদীর তীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের কিছু অংশ ভাঙনের কবলে পড়েছে। ওই এলাকা দিয়ে সার্ভে করছি। খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান, নির্বাহী প্রকৌশলী, পাউবো, শরীয়তপুরওই ৮ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার এলাকার নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ৩১টি গুচ্ছ প্রকল্পের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। গত বছর ১৭ মে প্রকল্পের কাজ মাঠপর্যায়ে শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
বর্ষা মৌসুম শুরু হলে জাজিরায় পদ্মার ভাঙন শুরু হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষা বাঁধের এক কিলোমিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এক মাস ধরে পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের জিরোপয়েন্ট এলাকা থেকে পালেরচরের কাথারিয়াকান্দি এলাকা পর্যন্ত ভাঙন দেখা দিয়েছে। নির্মাণাধীন নদীর তীর রক্ষা বাঁধটির দুই কিলোমিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়েছে। ওই এলাকায় ১০টি গুচ্ছ প্রকল্পের আওতায় ১০টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছিল। প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকল্পে থাকা ৫ লাখ ২৪ হাজার বালু ভর্তি জিও ব্যাগ নদীতে ফেলেছে। ভাঙনে ওই জিও ব্যাগগুলো ভেসে গেছে। ওই জিও ব্যাগের মূল্য বাবদ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে পাউবো থেকে ৩৫ কোটি টাকা বিল উত্তোলন করে নিয়েছে। আর পুরো প্রকল্প থেকে এখন পর্যন্ত ৩১০ কোটি টাকা বিল উত্তোলন করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
গত সোমবার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের পৈলান মোল্যাকান্দি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর তীরের বাসিন্দারা তাঁদের বসতঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। জিরোপয়েন্ট থেকে পালেরচর বাজারে যাওয়ার যে সড়কটি ছিল, তার দেড় কিলোমিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ওই এলাকায় নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে যে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল, তা নদীতে ভেসে গেছে। ভাঙনে নদী স্থানভেদে ১০ থেকে ১১০ মিটার ভেতরে প্রবেশ করছে। নদীর তীরজুড়ে পাথরের ব্লক জড়ো করে রাখা হয়েছে। কিছু স্থানে পাথরের ব্লকও নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
প্রকল্পের যে ১০টি প্যাকেজের অংশ নদীতে বিলীন হয়েছে, তার মধ্যে ৫টির (১২৫০ মিটার) ঠিকাদার নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান খুলনা শিপইয়ার্ড। সাব ঠিকাদারদের দিয়ে তারা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে। প্রতিষ্ঠানটি কার্যাদেশ পাওয়ার অন্তত সাত মাস পর প্রকল্পের প্রথম প্যাকেজের কাজ শুরু করেছে। এ বছর জুলাই মাসের দিকে ওই অংশ দিয়েই প্রকল্প এলাকার ভাঙন শুরু হয়। এতে ভাঙনে প্রকল্প এলাকার মানুষের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যায়।
খুলনা শিপইয়ার্ডের প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তিনজন সাব ঠিকাদার নিয়ে কাজটি বাস্তবায়ন করছি। আমাদের চারটি প্যাকেজের কাজ গত বছর শুরু করেছি। প্রকল্প এলাকার শুরুর দিকের প্রথম প্যাকেজের সাব ঠিকাদার নিতে দেরি হওয়ায় কাজ শুরু করতে সময় লেগেছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাউবোর এক প্রকৌশলী বলেন, প্রকল্প এলাকার কাজটি দেরিতে শুরু করেছে খুলনা শিপইয়ার্ড। তারা ভাঙন শুরু হওয়ার তিন-চার দিন পর জিও ব্যাগ ফেলতে শুরু করেছে। তাতে কোনো কাজ হয়নি।
পৈলান মোল্যাকান্দি গ্রামের কৃষক খলিল তালুকদারের বসতবাড়িটি বিলীন হয়েছে। খলিল বলেন, ‘বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়টুকু হারালাম। মা–বাবার কবরটাও নদীতে চলে যাবে।’
আবু বকর আকনের বসতবাড়ি ও চার বিঘা ফসলি জমি পদ্মায় বিলীন হয়েছে। তিনি বলেন, কাজের ধীরগতিতে সর্বনাশ হয়ে গেল।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, নদীর তীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের কিছু অংশ ভাঙনের কবলে পড়েছে। ওই এলাকা দিয়ে সার্ভে করছি। সার্ভের প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে ডিজাইন সংশোধন করে বাঁধ নির্মাণ করা হবে। তখন কিছু ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রকল প র ক ব ল ন হয় ছ র অ শ নদ ত ন র ম ণ কর নদ র ত র র প রক শ
এছাড়াও পড়ুন:
‘ওরা আমার নতুন বইও পুড়িয়ে দিল’
‘একনিমেষেই সব শেষ হয়ে গেল। এত দিন ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা ঘর পুড়িয়ে দিল, দোকানটাও জ্বালিয়ে দিল। তারা তো শুধু আমার ঘর ও দোকান পোড়ায়নি, আমার ভাত খাওয়ার অবলম্বনও নিয়ে গেছে। এখন আমি কীভাবে চলব? আমার দুই মেয়ের পড়াশোনার খরচ কীভাবে দেব?’
কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন লা সা প্রু মারমা। স্বামীহারা লা সা প্রু সংসার চালাতেন স্থানীয় বাজারে থাকা ছোট্ট কাপড়ের দোকানের আয়ে। এখন সেই দোকানটিও নেই, নেই বসতবাড়ি। জীবনের অবলম্বন হারিয়ে হতাশায় ডুবে আছেন তিনি।
গত সোমবার বিকেলে খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজার এলাকায় কথা হয় লা সা প্রু মারমার সঙ্গে। পোড়া বাড়ির সামনের টিলায় ছোট মেয়ে ও স্বজনদের নিয়ে বসেছিলেন তিনি। পাশে ছিলেন দুই জা (স্বামীর ভাইয়ের স্ত্রী)। তাঁদেরও ঘর পুড়েছে, পুড়েছে দোকান।
খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাছে কাপড় কেনাবেচার জন্য প্রসিদ্ধ। গত রোববার বাজারটি হয়ে ওঠে রণক্ষেত্র। সহিংসতার আগুনে পুড়ে যায় প্রায় অর্ধশত বসতবাড়ি ও ৪০টির মতো দোকান।
ভয়ে প্রথমে বাথরুমে (শৌচাগার) লুকিয়ে পড়েছিলাম। পরে বের হয়ে আসি। অসুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে কোনোরকমে জান নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। কী ঘটেছে, কী হয়েছে, তার কিছুই আমরা জানি না; কিন্তু আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিল। দোকানটাও পুড়িয়ে দিল।শিনু চিং চৌধুরী, রামেসু বাজার এলাকার বাসিন্দাখাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর এর প্রতিবাদে গত শনিবার খাগড়াছড়িতে অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেয় ‘জুম্ম-ছাত্র জনতা’। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গত রোববার গুইমারার রামেসু বাজারে বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ছিল স্থানীয় একটি পক্ষ। এ সময় গুলিতে তিন পাহাড়ির মৃত্যু হয়।
নারীদের জীবনে হাহাকার
একদিকে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছেন, আরেক দিকে জীবিকা আয়ের অবলম্বন দোকানও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে—এখন সর্বস্ব হারানো রামেসু বাজার এলাকার বাসিন্দারা পড়েছেন অকূলপাথারে। আগুনের লেলিহান শিখা শুধু তাঁদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়নি, বেঁচে থাকার অবলম্বনও শেষ করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামীর দিনগুলো শুধুই অন্ধকার দেখছেন লা সা প্রু মারমার মতো এই বাজারের পাহাড়ি নারীরা।
ঘর-দোকান হারানোর শোকে ক্ষোভ জন্মেছে লা সা প্রু মারমার মনে। ক্ষুব্ধ এই পাহাড়ি নারী বলতে থাকেন, ‘সবাই শুধু আগুনের তালে থাকে। কিছু হলেই আগুন ধরিয়ে দেয়। আমাদের ঘরবাড়ি কেন পুড়িয়ে দেবে? কেন দোকান জ্বালিয়ে দেবে? তার চেয়ে আমাদের মেরে ফেলুক।’
লা সা প্রু মারমার দুই জা-শিনু চিং চৌধুরী ও হ্লা পাই মারমাও হারিয়েছেন সবকিছু। শিনু চিং চৌধুরী, স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষিকা। ঋণ নিয়ে বাজারে দোতলা ভবন করে দোকান দিয়েছিলেন তিনি। দোকানের আয় ও বেতনে চলত সংসার, সন্তানের পড়াশোনার খরচও। তাঁর বড় মেয়ে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছোট ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে ঢাকায় কোচিং করছে। এখন শিনু চিংয়ের দোকানটির সঙ্গে ঘরও পুড়ে ছাই।
গত রোববারের দুপুর বেলা জীবনের বেদনাদায়ক মুহূর্ত হয়ে থাকবে শিনু চিং চৌধুরীর। দুঃসহ সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন এই নারী। চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। বলতে থাকেন, ‘ভয়ে প্রথমে বাথরুমে লুকিয়ে পড়েছিলাম। পরে বের হয়ে আসি। অসুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে কোনোরকম জান নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। কী ঘটেছে, কী হয়েছে, তার কিছুই আমরা জানি না; কিন্তু আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিল। দোকানটাও পুড়িয়ে দিল।’
পোড়া বাড়ির সামনে বসে আছেন লা সা প্রু মারমা (বামে) ও তাঁর দুই জা শিনু চিং চৌধুরী ও হ্লা পাই মারমা। আজ সকালে তোলা