বিভক্ত ইউরোপীয় শক্তিগুলো কি যুদ্ধ আটকাতে পারবে?
Published: 21st, June 2025 GMT
জনসংখ্যার দিক থেকে ইউরোপের তিনটি বৃহত্তম দেশ- জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এড়াতে শুক্রবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে আলোচনা করেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তেহরানের বিরুদ্ধে হামলায় যুক্ত হবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন, ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে এই আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে বলে নিন্দা করেছেন।
তিনি (ট্রাম্প) সাংবাদিকদের বলেন, “ইরান ইউরোপের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। এই বিষয়ে ইউরোপ কোনো সাহায্য করতে পারবে না।”
আরো পড়ুন:
ইরান নিয়ে নিজ দেশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনও মানছেন না ট্রাম্প
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ
আরাগচি বলেছিলেন, ইরান জেনেভায় আলোচনার জন্য আলোচনায় অংশ নিচ্ছে না, বরং কেবল শোনার জন্য।
তবে তিনি যোগ করেন, “ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও কোনো আলোচনা সম্ভব নয়।” এই সময় ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চলছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান মিত্র এবং সব যুদ্ধেই তার প্রধান সমর্থক। এটি এমন একমাত্র দেশ যার উল্লেখযোগ্য সামরিক উপস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে এবং যারা যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে দিতে পারে।
জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ইরান আলোচনার প্রেক্ষাপটে ‘ই-৩’ নামে পরিচিত। এই তিন দেশ ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে জেসিপিওএ নামে একটি চুক্তি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
এই চুক্তির মাধ্যমে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করতে সম্মত হয়, বিনিময়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়। এখন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার চলমান সংঘাত এবং পারমাণবিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয়রা আবার কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে সক্রিয় হয়েছে, যাতে বৃহত্তর যুদ্ধ এড়ানো যায় এবং ২০১৫ সালের চুক্তির মতো আলোচনার পথ আবার খোলা যায়।
২০১৫ সালের চুক্তি যৌথতার ভিত্তিকে বৃহত্তর কর্মপরিকল্পনা (জেসিপিওএ)
এই চুক্তির আওতায় ইরান সম্মত হয়েছিল শুধু শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি চালাতে এবং আন্তর্জাতিক তদারকির অধীনে থাকতে। রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘও এই চুক্তি আলোচনায় ভূমিকা রেখেছিল।
তবে ২০১৮ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে জেসিপিওএ থেকে প্রত্যাহার করে নেন। এরপর ই-৩ (জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য) চুক্তিটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। এক বছর পর ইরানও আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি থেকে সরে আসে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
শনিবার (২১ জুন) ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র কার্যক্রমবিষয়ক হাইকমিশনার কায়া ক্যালাস এক বিবৃতিতে বলেন, “ইইউ ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি প্রসারের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কারণ তারা জেসিপিওএর প্রায় সব শর্ত লঙ্ঘন করছে এবং এর কোনো বিশ্বাসযোগ্য বেসামরিক ব্যাখ্যা নেই।”
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে শুক্রবারের আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন কায়া ক্যালাস।
তবে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ ই-৩ দেশগুলোর মধ্যে ইসরায়েল প্রশ্নে মতপার্থক্য সৃষ্টি করেছে, যার ফলে ইউরোপের পররাষ্ট্রনীতির ঐক্য আরো দুর্বল হয়েছে; যদিও তারা সবাই ইউরোপের দোরগোড়ায় আরেকটি যুদ্ধ এড়াতে চায়।
ইসরায়েলের প্রতি ই-৩ দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য
ইসরায়েলের গাজার যুদ্ধে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ই-৩ (জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য) দেশগুলোর অবস্থান স্পষ্টভাবে আলাদা দেখা গেছে।
সবচেয়ে প্রবলভাবে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে জার্মানি। গাজায় বেসামরিক লোকজনের ওপর নির্বিচার বোমাবর্ষণের জন্য ইসরায়েলকে সমালোচনা করতে অস্বীকার করেছে জার্মানি এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সহায়তাকারী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-তে তহবিল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তারা। এই তহবিল থেকে হামাসকে সহায়তা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করে আসছে ইসরায়েল।
শুরুতে ইসরায়েলপন্থি ছিল, তবে গত বছর নির্বাচনে লেবার পার্টির জয়ের পর কিছুটা অবস্থান পরিবর্তন ঘটেছে। চলতি মাসে যুক্তরাজ্য চারটি দেশের সঙ্গে মিলে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থি জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির এবং অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচকে ‘পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দেওয়ার’ জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ইসরায়েল এই সিদ্ধান্তকে ‘অপমানজনক’ এবং ‘গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
ফ্রান্সই ইসরায়েলের ব্যাপারে সবচেয়ে সন্দেহজনক মনোভাব পোষণ করেছে। গত বছর এপ্রিল মাসে গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য আহ্বান জানানো চারটি ইইউ সদস্য দেশের মধ্যে অন্যতম ছিল এমানুয়েল মাখোঁর দেশ। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ঘোষণা দেন যে, তিনি কয়েক মাসের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবেন। তাদের এই স্বীকৃতি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আংশিক হলেও মাখোঁর বিশ্বাস একসময় এটা সঠিক হবে। ফ্রান্স অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোকে এই পথে চালিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়, যার পরবর্তী মাসে স্পেন, নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।
ই-থ্রি (জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য) ইরান ও ইসরায়েলের ওপর কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারে?
এই তিনটি দেশ ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি, যাদের সম্মিলিত মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ১১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এদের মধ্যে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের রয়েছে বিমানবাহী রণতরী এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় মোতায়েনযোগ্য অভিযান বাহিনী। এরা পারমাণবিক শক্তিধর দেশও।
তবু এসব সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি ইরান বা ইসরায়েলকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত অবস্থান থেকে সরাতে যথেষ্ট নয়।
ই-থ্রি এর প্রকৃত মূল্য হলো, তারা ইরান ও ইসরায়েল উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার সক্ষমতা রাখে।
নিস-এর ইউরোপীয় ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক জর্জ টজোগোপুলোস বলেছেন, “জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক মৃদু।”
“এখন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তারাই কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে যাতে সংঘাত থামে এবং আলোচনা আবার শুরু হয়,” বলেন তিনি।
ই-থ্রি কি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি চুক্তির মধ্যস্থতা করতে পারবে?
এটি খুব কঠিন হবে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া জেসিপিওএ (২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি) পুনরুজ্জীবিত করতে তাদের ব্যর্থতা বিবেচনা করলে।
“জেসিপিওএ ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ হলো ট্রাম্প প্রশাসন, ট্রাম্প নিজে এবং ইসরায়েলি সরকারের এই বিশ্বাস যে, ইরানের ক্ষেত্রে কূটনীতি কাজ করবে না। তাই তিন ইউরোপীয় দেশের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা হয়েছে,” বলেন টজোগোপুলোস।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করাও ই-থ্রির জন্য কঠিন। ট্রাম্প বর্তমানে নিজের গোয়েন্দা সংস্থার মত উপেক্ষা করে ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে বলছেন, ইরান বোমা বানাচ্ছে।
শুক্রবার (২১ জুন) ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ‘ভুল’ বলেছেন। তিনি বলেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে না এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিকে পুনরায় অনুমোদন দেননি।
আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের পরমাণু বিস্তার রোধ নীতির পরিচালক কেলসি ডেভেনপোর্ট বলেন, “যদি ইসরায়েলের কাছে প্রমাণ থাকে যে, ইরান বোমা তৈরিতে দৌড়াচ্ছে, তাহলে সেটা আরো প্রকাশ্যে শেয়ার করা দরকার, কারণ কেউই এই মূল্যায়ন নিশ্চিত করছে না।”
“যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ই-থ্রি একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে আমরা আশাবাদী হতে পারি কিন্তু ইউরোপ যদি স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে, তাহলে আমি তাদের সফলতার ওপর বাজি ধরতাম না,” বলেন তিনি।
ইউরোপীয়দের সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই কম- কেলসি ডেভেনপোর্টের সঙ্গে একমত অ্যাথেন্সের প্যানটিওন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক অ্যাঞ্জেলোস সিরিগোস।
তিনি বলেন, “গুরুত্বপূর্ণভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে একমাত্র আমেরিকাই। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই ইরানিরা সেটা চায় কি না। স্থায়ী শান্তির জন্য সাধারণত একপক্ষকে বুঝতে হয় যে সামরিক সমাধান নেই।”
তিনি ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন, যা পরে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিতে রূপ নেয় এবং যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধ থেকে ডেটন অ্যাকর্ডে পরিণত হয়; যেখানে যুক্তরাষ্ট্র মূল ভূমিকা রেখেছিল।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কি কূটনৈতিক সমাধান খুঁজে পেতে পারবে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, না। কারণ চীন, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও ইরানের বিষয় নিয়ে একমত নয়।
“নিরাপত্তা পরিষদ এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না,” বলেন সিরিগোস।
“যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা চীনের মধ্যে কেউ একজন এটা ভেটো দেবে। মূল পার্থক্য হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে। চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। তারা সেখানে থেকে তাদের অধিকাংশ তেল কেনে; তারা ইরানে পারমাণবিক কার্যক্রমের উপকরণ পাঠায়। মূলত ইরানের সঙ্গে চীনই সবচেয়ে বেশি যুক্ত।”
রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানে আক্রমণ না করার আহ্বান জানিয়েছে, কারণ এতে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি রয়েছে।
কিন্তু রাশিয়ার কাছে ইরানের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই, বলেন সিরিগোস।
“বর্তমানে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলেমিশে চলছে। তারা জড়িত হতে চায় না। ক্ষমতাও নেই। তাই এটি বাধ্যতামূলক কিছুকে স্বেচ্ছায় করা কাজ বানিয়ে ফেলছে,” বলেন তিনি।
“এই মুহূর্তে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে যুদ্ধের যুক্তিই নিয়ন্ত্রণ করবে এবং আমরা জানি না যুদ্ধ কেমন হবে, কিংবা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কতটা ক্ষতি হবে,” বলেন টজোগোপুলোস।
[লেখক পরিচিত ও নোট: জন টি.
ঢাকা/রাসেল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর য ক তর ষ ট র ইসর য় ল ফ র ন স ও য ক তর জ য র পরর ষ ট র ২০১৫ স ল ক টন ত ক র ষ ট রক ইসর য় ল ইউর প র ইউর প য ক জ কর র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
বিভক্ত ইউরোপীয় শক্তিগুলো কি যুদ্ধ আটকাতে পারবে?
জনসংখ্যার দিক থেকে ইউরোপের তিনটি বৃহত্তম দেশ- জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এড়াতে শুক্রবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে আলোচনা করেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তেহরানের বিরুদ্ধে হামলায় যুক্ত হবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন, ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে এই আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে বলে নিন্দা করেছেন।
তিনি (ট্রাম্প) সাংবাদিকদের বলেন, “ইরান ইউরোপের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। এই বিষয়ে ইউরোপ কোনো সাহায্য করতে পারবে না।”
আরো পড়ুন:
ইরান নিয়ে নিজ দেশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনও মানছেন না ট্রাম্প
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ
আরাগচি বলেছিলেন, ইরান জেনেভায় আলোচনার জন্য আলোচনায় অংশ নিচ্ছে না, বরং কেবল শোনার জন্য।
তবে তিনি যোগ করেন, “ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও কোনো আলোচনা সম্ভব নয়।” এই সময় ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চলছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান মিত্র এবং সব যুদ্ধেই তার প্রধান সমর্থক। এটি এমন একমাত্র দেশ যার উল্লেখযোগ্য সামরিক উপস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে এবং যারা যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে দিতে পারে।
জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ইরান আলোচনার প্রেক্ষাপটে ‘ই-৩’ নামে পরিচিত। এই তিন দেশ ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে জেসিপিওএ নামে একটি চুক্তি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
এই চুক্তির মাধ্যমে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করতে সম্মত হয়, বিনিময়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়। এখন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার চলমান সংঘাত এবং পারমাণবিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয়রা আবার কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে সক্রিয় হয়েছে, যাতে বৃহত্তর যুদ্ধ এড়ানো যায় এবং ২০১৫ সালের চুক্তির মতো আলোচনার পথ আবার খোলা যায়।
২০১৫ সালের চুক্তি যৌথতার ভিত্তিকে বৃহত্তর কর্মপরিকল্পনা (জেসিপিওএ)
এই চুক্তির আওতায় ইরান সম্মত হয়েছিল শুধু শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি চালাতে এবং আন্তর্জাতিক তদারকির অধীনে থাকতে। রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘও এই চুক্তি আলোচনায় ভূমিকা রেখেছিল।
তবে ২০১৮ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে জেসিপিওএ থেকে প্রত্যাহার করে নেন। এরপর ই-৩ (জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য) চুক্তিটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। এক বছর পর ইরানও আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি থেকে সরে আসে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
শনিবার (২১ জুন) ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র কার্যক্রমবিষয়ক হাইকমিশনার কায়া ক্যালাস এক বিবৃতিতে বলেন, “ইইউ ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি প্রসারের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কারণ তারা জেসিপিওএর প্রায় সব শর্ত লঙ্ঘন করছে এবং এর কোনো বিশ্বাসযোগ্য বেসামরিক ব্যাখ্যা নেই।”
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে শুক্রবারের আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন কায়া ক্যালাস।
তবে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ ই-৩ দেশগুলোর মধ্যে ইসরায়েল প্রশ্নে মতপার্থক্য সৃষ্টি করেছে, যার ফলে ইউরোপের পররাষ্ট্রনীতির ঐক্য আরো দুর্বল হয়েছে; যদিও তারা সবাই ইউরোপের দোরগোড়ায় আরেকটি যুদ্ধ এড়াতে চায়।
ইসরায়েলের প্রতি ই-৩ দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য
ইসরায়েলের গাজার যুদ্ধে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ই-৩ (জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য) দেশগুলোর অবস্থান স্পষ্টভাবে আলাদা দেখা গেছে।
সবচেয়ে প্রবলভাবে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে জার্মানি। গাজায় বেসামরিক লোকজনের ওপর নির্বিচার বোমাবর্ষণের জন্য ইসরায়েলকে সমালোচনা করতে অস্বীকার করেছে জার্মানি এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সহায়তাকারী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-তে তহবিল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তারা। এই তহবিল থেকে হামাসকে সহায়তা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করে আসছে ইসরায়েল।
শুরুতে ইসরায়েলপন্থি ছিল, তবে গত বছর নির্বাচনে লেবার পার্টির জয়ের পর কিছুটা অবস্থান পরিবর্তন ঘটেছে। চলতি মাসে যুক্তরাজ্য চারটি দেশের সঙ্গে মিলে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থি জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির এবং অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচকে ‘পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দেওয়ার’ জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ইসরায়েল এই সিদ্ধান্তকে ‘অপমানজনক’ এবং ‘গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
ফ্রান্সই ইসরায়েলের ব্যাপারে সবচেয়ে সন্দেহজনক মনোভাব পোষণ করেছে। গত বছর এপ্রিল মাসে গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য আহ্বান জানানো চারটি ইইউ সদস্য দেশের মধ্যে অন্যতম ছিল এমানুয়েল মাখোঁর দেশ। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ঘোষণা দেন যে, তিনি কয়েক মাসের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবেন। তাদের এই স্বীকৃতি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আংশিক হলেও মাখোঁর বিশ্বাস একসময় এটা সঠিক হবে। ফ্রান্স অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোকে এই পথে চালিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়, যার পরবর্তী মাসে স্পেন, নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।
ই-থ্রি (জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য) ইরান ও ইসরায়েলের ওপর কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারে?
এই তিনটি দেশ ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি, যাদের সম্মিলিত মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ১১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এদের মধ্যে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের রয়েছে বিমানবাহী রণতরী এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় মোতায়েনযোগ্য অভিযান বাহিনী। এরা পারমাণবিক শক্তিধর দেশও।
তবু এসব সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি ইরান বা ইসরায়েলকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত অবস্থান থেকে সরাতে যথেষ্ট নয়।
ই-থ্রি এর প্রকৃত মূল্য হলো, তারা ইরান ও ইসরায়েল উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার সক্ষমতা রাখে।
নিস-এর ইউরোপীয় ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক জর্জ টজোগোপুলোস বলেছেন, “জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক মৃদু।”
“এখন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তারাই কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে যাতে সংঘাত থামে এবং আলোচনা আবার শুরু হয়,” বলেন তিনি।
ই-থ্রি কি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি চুক্তির মধ্যস্থতা করতে পারবে?
এটি খুব কঠিন হবে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া জেসিপিওএ (২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি) পুনরুজ্জীবিত করতে তাদের ব্যর্থতা বিবেচনা করলে।
“জেসিপিওএ ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ হলো ট্রাম্প প্রশাসন, ট্রাম্প নিজে এবং ইসরায়েলি সরকারের এই বিশ্বাস যে, ইরানের ক্ষেত্রে কূটনীতি কাজ করবে না। তাই তিন ইউরোপীয় দেশের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা হয়েছে,” বলেন টজোগোপুলোস।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করাও ই-থ্রির জন্য কঠিন। ট্রাম্প বর্তমানে নিজের গোয়েন্দা সংস্থার মত উপেক্ষা করে ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে বলছেন, ইরান বোমা বানাচ্ছে।
শুক্রবার (২১ জুন) ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ‘ভুল’ বলেছেন। তিনি বলেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে না এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিকে পুনরায় অনুমোদন দেননি।
আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের পরমাণু বিস্তার রোধ নীতির পরিচালক কেলসি ডেভেনপোর্ট বলেন, “যদি ইসরায়েলের কাছে প্রমাণ থাকে যে, ইরান বোমা তৈরিতে দৌড়াচ্ছে, তাহলে সেটা আরো প্রকাশ্যে শেয়ার করা দরকার, কারণ কেউই এই মূল্যায়ন নিশ্চিত করছে না।”
“যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ই-থ্রি একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে আমরা আশাবাদী হতে পারি কিন্তু ইউরোপ যদি স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে, তাহলে আমি তাদের সফলতার ওপর বাজি ধরতাম না,” বলেন তিনি।
ইউরোপীয়দের সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই কম- কেলসি ডেভেনপোর্টের সঙ্গে একমত অ্যাথেন্সের প্যানটিওন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক অ্যাঞ্জেলোস সিরিগোস।
তিনি বলেন, “গুরুত্বপূর্ণভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে একমাত্র আমেরিকাই। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই ইরানিরা সেটা চায় কি না। স্থায়ী শান্তির জন্য সাধারণত একপক্ষকে বুঝতে হয় যে সামরিক সমাধান নেই।”
তিনি ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন, যা পরে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিতে রূপ নেয় এবং যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধ থেকে ডেটন অ্যাকর্ডে পরিণত হয়; যেখানে যুক্তরাষ্ট্র মূল ভূমিকা রেখেছিল।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কি কূটনৈতিক সমাধান খুঁজে পেতে পারবে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, না। কারণ চীন, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও ইরানের বিষয় নিয়ে একমত নয়।
“নিরাপত্তা পরিষদ এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না,” বলেন সিরিগোস।
“যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা চীনের মধ্যে কেউ একজন এটা ভেটো দেবে। মূল পার্থক্য হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে। চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। তারা সেখানে থেকে তাদের অধিকাংশ তেল কেনে; তারা ইরানে পারমাণবিক কার্যক্রমের উপকরণ পাঠায়। মূলত ইরানের সঙ্গে চীনই সবচেয়ে বেশি যুক্ত।”
রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানে আক্রমণ না করার আহ্বান জানিয়েছে, কারণ এতে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি রয়েছে।
কিন্তু রাশিয়ার কাছে ইরানের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই, বলেন সিরিগোস।
“বর্তমানে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলেমিশে চলছে। তারা জড়িত হতে চায় না। ক্ষমতাও নেই। তাই এটি বাধ্যতামূলক কিছুকে স্বেচ্ছায় করা কাজ বানিয়ে ফেলছে,” বলেন তিনি।
“এই মুহূর্তে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে যুদ্ধের যুক্তিই নিয়ন্ত্রণ করবে এবং আমরা জানি না যুদ্ধ কেমন হবে, কিংবা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কতটা ক্ষতি হবে,” বলেন টজোগোপুলোস।
[লেখক পরিচিত ও নোট: জন টি. পসারোপুলোস একজন স্বতন্ত্র সাংবাদিক, যিনি এথেন্সে-ভিত্তিক কাজ করেন। তিনি ২০১২ সাল থেকে আলজাজিরার দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপবিষয়ক প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তার ব্যক্তিগত ব্লগ Hellenica পাওয়া যায় এই লিংকে: johntpsaropoulos.substack.com । এই ব্লগে তিনি গ্রিস ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতি, ইতিহাস ও সমাজ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখালেখি করেন।]
ঢাকা/রাসেল