প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে বাংলাদেশের ব্যয় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি, বিশ্বেও অন্যতম শীর্ষে। এরপরও মেট্রোরেলের পথে ৪৫টি ত্রুটি ও ঘাটতি থাকাটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এসব ত্রুটি ও ঘাটতির কারণে চালুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৩০-৪০ বার মেট্রোরেল বন্ধ রাখতে হয়েছে।

গত ২৬ অক্টোবর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে পথচারীর মৃত্যুর পর আধুনিক এই জনপরিবহনব্যবস্থার নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়েও বড়সড় প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডকে (ডিএমটিসিএল) অবশ্যই জননিরাপত্তাকে কেন্দ্রে রেখে মেট্রোরেলের ত্রুটি ও ঘাটতিগুলোকে জরুরি উদ্যোগ নিয়ে কাটিয়ে উঠতে হবে। না হলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে নাগরিক আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠা মেট্রোরেল নিয়েও জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে পারে।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই মতিঝিল-উত্তরা পর্যন্ত পথে যে ৪৫টি ত্রুটি ও ঘাটতি পেয়েছে, তার বিবরণ দিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এর মধ্যে সংকেত ও টেলিযোগাযোগ কাজে ১০টি, বৈদ্যুতিক কাজে ১৬ ধরনের, পুরকৌশল কাজে ১০ ধরনের এবং ট্রেন ও এর সঙ্গে যুক্ত ব্যবস্থাপনায় ৯ ধরনের ত্রুটি ও ঘাটতি রয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ১৬টি স্টেশনের অন্তত ৮৯টি জায়গায় বৃষ্টির পানি ঢোকে। স্টেশনের ছাদের ফাঁক এমনভাবে তৈরি করা যে লাইনের পাশাপাশি প্ল্যাটফর্মেও পানি পড়ে। যাত্রীরাও অভিযোগ করেছেন, বৃষ্টির সময় প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষার সময় ভিজে যেতে হয়। অনেক স্টেশনে ট্রেন নির্দিষ্ট জায়গায় না থেমে কিছুটা আগে-পরে থামছে।

তিন বছরের কম সময় আগে চালু হওয়া মেট্রোরেলের কিছু যন্ত্রাংশে কেন মরিচা পড়বে কিংবা শীতাতপনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কেন মাঝেমধ্যে অকার্যকর থাকবে। স্টেশনের লিফট ও এস্কেলেটরেও কেন অসংগতি থাকবে? চালুর একেবারে শুরু থেকেই টিকিট কাটার যন্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় ভাড়া আদায়ের ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত মানের না হওয়ায় যাত্রীদের নানা সময়ে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রত্যাশিত সমাধান না মেলাটা দুঃখজনক।

ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব ত্রুটি ও ঘাটতির কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই। যেখানে বিয়ারিং প্যাড মাথায় পড়ে নাগরিকের মৃত্যু হতে পারে, সেখানে এই ভাষ্য কতটা আশ্বস্ত করতে পারে? এসব ত্রুটির কারণে হুটহাট মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ থাকা এবং এর ফলে যে জনদুর্ভোগ ও আর্থিক ক্ষতি হয়, সেটাও তো বিবেচনায় নিতে হবে।

মেট্রোরেলে এসব ত্রুটি ও ঘাটতি থাকার কারণ হচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজগুলো ঠিকঠাকভাবে করেনি কিংবা চুক্তি অনুযায়ী যতটুকু কাজ করার কথা ছিল, সেটা তারা করেনি। মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় শুধু পাঁচ গুণ বেশি ব্যয়ই হয়নি, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পেছনেও যে ব্যয় করা হয়েছে, সেটাও অস্বাভাবিক। এরপরও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বারবার করে চিঠি দেওয়ার পরও চাহিদামতো সমাধান না পাওয়াটা দুঃখজনক।

মেট্রোরেল নির্মাণে যে বিপুল ব্যয় হয়েছে, তাতে ঋণ পরিশোধ করতে এমনিতেই চাপের মুখে পড়তে হবে। এরপর যদি ত্রুটিপূর্ণ স্থাপনার কারণে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেড়ে যায়, সেটা হবে ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’। ঠিকাদার ও পরামর্শকের দিক থেকে বিয়ারিং প্যাডের ৫ শতাংশ বিচ্যুতি সহনীয় বলে আশ্বস্ত করা হলেও বাস্তবে সেটা ঘটেনি। আমরা মনে করি, শুধু চিঠি দেওয়াটাই সমাধান নয়, ত্রুটিপূর্ণ স্থাপনার জন্য ঠিকাদার ও পরামর্শককে জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন। এত বিপুল ব্যয়ের পরও কেন এমন ত্রুটিপূর্ণ মেট্রোরেল?

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এসব ত র ট ব যবস থ ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় ঢাবিতে মানবেন্দ্র লারমাকে স্মরণ

সাবেক আইনপ্রণেতা ও বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হয়েছে। সোমবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় এক স্মরণসভায় তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

স্মরণসভার শুরুতে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন এম এন লারমার ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা।

মানবেন্দ্র লারমা গরিব মেহনতি মানুষের নেতা উল্লেখ করে স্মরণসভায় সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, ‘তিনি কেবল পাহাড়ি মানুষের নেতা ছিলেন না। বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সমগ্র নিপীড়িত মানুষের কথা বলেছেন। তিনি বাহাত্তরের সংবিধানে আদিবাসী, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি সে সময় সংসদে দাড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন যে তিনি একজন চাকমা, একজন চাকমা কোনো দিন বাঙালি হতে পারেন না।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, ‘জুলাই সনদে আজকে আদিবাসী মানুষের কথা বলা নেই। অথচ কেবল মুখে বহুত্ববাদী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে। বিগত সময়ের দলীয় সরকার নাহয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেনি। কিন্তু গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় পাহাড়ি আদিবাসীরা কমপক্ষে দুটি সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিভাবে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো উচ্চারণ করেনি।’

ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক বলেন, ‘চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান যে চেতনা নিয়ে শুরু হয়েছিল, আজ সেই চেতনা মৌলবাদী শক্তির কাছে লুট হয়ে গেছে। সত্তরের দশকে নতুন বাংলাদেশে মহান নেতা মানবেন্দ্র লারমা সেই স্বপ্ন দেখছিলেন, যে স্বপ্ন একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার, গরিব মেহনতি তথা নিপীড়িত পাহাড়ি আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বুনেছিলেন।’

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানে নিপীড়িত মানুষের অধিকারের কথা বলা হয়নি, নারী-পুরুষের বৈষম্য বিলোপ এবং মেহনতি মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা তুলে ধরা হয়নি। সে সময় শোষিত মানুষের বন্ধু মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁদের হয়ে কথা বলেছেন। তিনি সংবিধান প্রণয়নের সময় শ্রমিক, গরিব ও আদিবাসী নিপীড়িত মানুষের কথা বলেছিলেন।

সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের যত রাজনৈতিক দল আছে, তারা অন্য জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করার মতো মানসিকতা এখনো তৈরি করতে পারেনি। ভোটের আগে মুখে বললেও তা বাস্তবে বাস্তবায়ন করে না।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল কাফি রতন বলেন, ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জুম্ম জাতির জন্য ছাত্রজীবন থেকে অধিকারের কথা বলেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সংবিধান যখন বাঙালি বলে আদিবাসী মানুষের পরিচয় করে দিতে চেয়েছিল, সেই সময় গণপরিষদে এম এন লারমা প্রতিবাদ করেছিলেন।’

স্মরণসভায় আরও বক্তব্য দেন লেখক ও সাংবাদিক এহসান মাহমুদ, সাংবাদিক সাইফুর রহমান, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা ও নারীনেত্রী শিরিন হক। স্মরণসভা শেষে গান, কবিতা পাঠ ও প্রদীপ প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ