সময়টা ২০২২ সালের মাঝামাঝি। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বেলা দেড়টার দিকে মগবাজার থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় পুরান ঢাকার একটি প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে ছুটে চলা। উদ্দেশ্য, একটি বেসরকারি ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে পরীক্ষায় সহধর্মিণীর অংশগ্রহণ। সঙ্গে আছে ছয় মাসের কম বয়সী সন্তান। রোদে হাঁসফাঁস অবস্থার মধ্যে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। অবশ্য অটোরিকশা চলতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে সে।
পরীক্ষার সময় ছিল বেলা তিনটা। পুরান ঢাকার সরু গলির যানজটের কথা ভেবে সময় হাতে রেখে বের হওয়ার চেষ্টা ছিল। যা ভেবেছিলাম, তা–ই হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সড়কে ঢুকতেই গাড়ির জট। ধীরে এগোচ্ছে অটোরিকশা। দুশ্চিন্তাও বাড়ছে। অটোরিকশার দরজার ফাঁক দিয়ে পরীক্ষার্থীদের অনেককে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সঙ্গে শিশুসন্তান থাকায় আমাদের সে সুযোগ ছিল না।
ভিড় ঠেলে শেষ পর্যন্ত মিনিট দশেক আগে পরীক্ষাকেন্দ্রের সামনে পৌঁছাল অটোরিকশা। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। তখনো ঘুমিয়ে খুদে যাত্রী। প্রথম সন্তান; এত ছোট শিশু কোলে নিতে অভ্যস্ত নই আমি। তাই আসার সময় বেড়াতে আসা আমার ছোট বোনকেও নিয়ে এলাম। সন্তানকে বোনের কোলে রাখলাম। ফিডারসহ অন্যান্য জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিয়ে কেন্দ্রের উদ্দেশে ছুটল ওর মা। তখনো খুদে অভিভাবক ঘুমাচ্ছে। মন থেকে চাচ্ছিলাম, যতটুকু বেশি ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায়।
কিন্তু বিপত্তি বাধাল কড়া রোদ। আশপাশে সেভাবে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। সূর্যের আলো পড়তেই ঘুমের মধ্যে সে নড়াচড়া করছে। গরমে ঘেমেও যাচ্ছে। বাসা থেকে নেওয়া হাতপাখাও তেমন কাজে দিচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারীকে বললাম, ভেতরে ঢোকা যাবে কি না। তিনি জানালেন, ভেতরে ঢোকার সুযোগ নেই।
কিছুটা অসহায় লাগছিল। কিছুক্ষণ পর আবার ওই কর্মচারীকে বললাম, ছোট শিশু। গরমে বেকায়দা অবস্থা। শুধু ওকে নিয়ে সীমানাদেয়ালের ভেতরে আড়ালে একটু দাঁড়াতে দিলে ভালো হতো। কিছুটা ভেবেচিন্তে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে; তবে ভেতরে যাওয়া যাবে না। বুঝেনই তো, আমাদেরও কিছু করার থাকে না।’ যাক বাবা, আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
পকেট গেট (মূল ফটক লাগোয়া ছোট একটি ফটক) পেরিয়ে ছোট বোন আমার শিশুসন্তানকে নিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের একটি ভবন আর সীমানাদেয়ালের মাঝের গলিতে গিয়ে দাঁড়াল। আমিও ওর জিনিসপত্র আনা ব্যাগটি নিয়ে ঢুকলাম। এর মধ্যে পাশের দাপ্তরিক কক্ষ থেকে একটি চেয়ার এনে আমার বোনকে বসতে দিলেন ওই কর্মচারী। আমি দাঁড়িয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছি। তবে গরমের মধ্যে কোলে রাখায় তেমন কাজ হচ্ছিল না। মনে হচ্ছে, যেকোনো সময় বাচ্চার ঘুম ভেঙে যাবে।
একপর্যায়ে ওই কর্মচারী জানতে চাইলেন আমি কী করি। সাংবাদিকতা নিয়ে সমাজের একটি অংশের নেতিবাচক ধারণা আছে। তাই আগ বাড়িয়ে আমি পেশার পরিচয় দিই না। কেউ জানতে চাইলে, সাংবাদিকতা করি—এতটুকু বলেই থামতে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করি। তবে ওই কর্মচারী থামলেন না। বললেন, ‘কোন পেপারে (পত্রিকায়)?’ তখন আমি বললাম, প্রথম আলোতে। এ কথা শুনতেই ওই কর্মচারীর অভিব্যক্তি পাল্টে গেল। হাসিমুখে বললেন, ‘আমি প্রথম আলো পত্রিকা পড়ি।’
এরপর ওই কর্মচারী বললেন, ‘একটি চেয়ার এনে দিই, বসুন।’ বিনয়ের সঙ্গে না করলাম। বললাম, না, লাগবে না। কিছুক্ষণ পর এসে বললেন, ‘বাবুকে নিয়ে অফিসের রুমে বসেন, ফ্যানের নিচে।’ এবার আর ‘না’ করলাম না। আমার বোন গিয়ে অফিসের বড়সড় একটি টেবিলের এক পাশে একটি চেয়ারে বসল। যাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা, সে কোলে তখনো ঘুমে। দেয়ালে লাগানো ফ্যানটির বাতাস গায়ে লাগতেই ঘুম আরও গভীর হলো। আর দূর থেকে দেখেই ফ্যানের বাতাসের প্রশান্তি যেন আমাকেই ছুঁয়ে গেল।
আমি গা এলিয়ে দিয়ে গলিতে রাখা চেয়ারটাতে গিয়ে বসলাম। ওই কর্মচারী এসে বললেন, ভেতরে বসুন ফ্যানের নিচে। বললাম, সেখানে ভিড় বাড়ানোর দরকার নেই। এবার বললেন, চা খাবেন? বিনয়ের সঙ্গে বললাম, না থাক; গরমের মধ্যে চা খাব না। মনে মনে বলছি, এমনিতে আমার সন্তানের জন্য যতটুকু করেছেন, তাতেই অনেক কৃতজ্ঞ।
এদিকে দেড় ঘণ্টার পরীক্ষার সময় যেন ফুরাতেই চায় না। বারবার মুঠোফোনে সময় দেখি। ঘুম থেকে জেগে বাচ্চা যদি কান্না শুরু করে, থামাতে না পারলে মুশকিল হবে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার মিনিট বিশেক আগে ও জেগে গেল। ফ্যানের নিচে বসেই তাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে আমার বোন। পরীক্ষার সময় শেষ হয়ে এলে আমরা ফটকের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। শেষের ঘণ্টা বাজতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে রীতিমতো দৌড়ে এসে হাজির সন্তানের মা; হাঁপাচ্ছিল সে। বলল, চারতলায় সিট পড়েছে, এ জন্য আসতে দেরি হয়েছে। পরীক্ষা মিনিট দশেক আগেই শেষ করে অপেক্ষা করছিল কখন ঘণ্টা বাজবে। জানতে চাইছে, ও কান্না করেছে কি না, কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। আমি বললাম, কোনো সমস্যা হয়নি। পরে কথা বলব, আগে অটোরিকশা ধরো। মানুষ বেশি, অটোরিকশা পাব না। পরে এক চালক ভাড়া কিছুটা বেশি চাইলেও অটোরিকশা নিয়ে নিলাম।
সন্তান মায়ের কোলে, আমি নির্ভার। এরপর অটোরিকশায় বসে এতক্ষণ যা যা ঘটেছে বললাম। সহধর্মিণী সব শুনে বলল, লোকটা (কর্মচারী) অনেক ভালো মানুষ; আল্লাহ ওনার ভালো করুন। এরপর অটোরিকশা চলছিল আর আমি ভাবছিলাম, মাত্র কয়েক মাস আগে যোগ দেওয়া কর্মস্থলের পরিচয় দিতেই লোকটার বদলে যাওয়া অভিব্যক্তি, সেই অপ্রত্যাশিত আতিথেয়তার কথা। এই আস্থা ও ভালোবাসা প্রথম আলো রাতারাতি অর্জন করেনি, এত সহজে অর্জিত হয়নি।
মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমন্বিত বার্তা
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ক ষ র সন ত ন বলল ন প রথম বলল ম র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
শাহরুখকে ‘কুৎসিত’ বলেছিলেন হেমা মালিনী, এরপর...
বলিউড ‘বাদশা’ শাহরুখ খানের জীবনের গল্পটাই যেন এক সিনেমা। দিল্লির এক তরুণ থেকে মুম্বাইয়ের মান্নাত বাড়ির মালিক হয়ে ওঠা, কোটি ভক্তের ভালোবাসায় স্নাত এক তারকা—এই যাত্রা সহজ ছিল না। কিন্তু এই সাফল্যের শুরুটা ছিল বেশ রোমাঞ্চকর ও খানিকটা অবিশ্বাস্য। আজ শনিবার অভিনেতার ৬০তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে জেনে নেওয়া যাক অভিনেতার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের এক ঘটনা, যা এত দিন আড়ালেই ছিল।
শাহরুখ খানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রযোজক বিবেক বাসওয়ানি সম্প্রতি রেডিও নাশার এক সাক্ষাৎকারে সেই শুরুর দিনের এক ঘটনা শেয়ার করেছেন, যেদিন ‘কিং খান’ প্রথমবারের মতো সাক্ষাৎ করেছিলেন অভিনেত্রী ও পরিচালক হেমা মালিনীর সঙ্গে।
‘হেমা মালিনী ফোন করেছেন!’
বিবেক বলেন, ‘সেদিন আমি বুঝলাম, আমি সত্যি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকে পড়েছি। হঠাৎ একদিন আমাদের বাড়িতে ফোন আসে। আমার বাবা ফোন ধরেন, ওপাশ থেকে কেউ বলছেন, “আমি হেমা মালিনী বলছি।” বাবা তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “হেমা মালিনী মানে সেই সুপারস্টার?” তারপর তিনি আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে বললেন, “হেমা মালিনী ফোন করেছে!”’