অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই নানামুখী আন্দোলন ও দাবিদাওয়া মোকাবিলা করছে। ৮ আগস্ট এ সরকার শপথ নেয়। নানা পেশাজীবী, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলন, শ্রমিকদের দাবি এমনকি সরকারি কর্মচারীরাও বাদ যাচ্ছে না। ক্রিয়াশীল সব রাজনৈতিক দলের সমর্থনপুষ্ট হলেও রাজনৈতিক আন্দোলনও এ সময়ে চলছে। সরকার নানাভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও এসব আন্দোলন যেন কমছেই না। এসব সামাল দিতে গিয়ে সরকার যেমন হাঁপিয়ে উঠছে তেমনি অনেক সময় রাজধানীবাসীকেও পড়তে হচ্ছে বিপদে। নগরবাসীকে জিম্মি করেও আন্দোলন করেছে বিভিন্ন গ্রুপ। এমনিতেই যানজটের কারণে রাজধানীর মানুষ অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়ে। বৃষ্টিতে তাদের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। এর মধ্যে আন্দোলনের কারণে সড়ক বন্ধ থাকলে সে দুর্ভোগ হয় বহু গুণ।
রোববার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস হিসেবে এদিন সম্ভবত আন্দোলন সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। চলতি সপ্তাহের আন্দোলনের চিত্র প্রকাশিত হয়েছে সমকালের শেষ পাতায়। সেদিন রাজধানীর পাঁচ স্থানে সাতটি দলের আন্দোলনের বর্ণনা এসেছে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে আন্দোলন করেছেন ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা এবং তথ্য আপা প্রকল্পের নারীরা। গুলিস্তানের নগর ভবনে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা। মিন্টো রোডে বিক্ষোভ করেছেন জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতে আন্দোলন করে গ্রেপ্তার হওয়া প্রবাসীদের মুক্তির দাবিতে জেলফেরত প্রবাসীরা। একই জায়গায় আন্দোলন করেছেন কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্রকল্পের কর্মীরা। তিন দফা দাবিতে শহীদ মিনারে মহাসমাবেশ করেছেন প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি (জাতীয়করণকৃত) এবং শহীদ মিনার থেকে হাইকোর্ট এলাকায় যাওয়ার সময় পুলিশের বাধার মুখে পড়েন চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যরা।
এখানে কারও দাবিই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ সবার আন্দোলনেরই যৌক্তিকতা আছে; কিন্তু সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করছে এবং ইতোমধ্যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। অল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব পালনকারী এই সরকারের পক্ষে সবার দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়। তার পরও সরকার উল্লেখযোগ্য দাবি মেনে নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে গত সাড়ে ১০ মাসে চার শতাধিক আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিছু আন্দোলন ঠেকাতে সরকারকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। সরকার এভাবে আন্দোলনের কারণে যদি তার অগ্রাধিকারগুলোতে নজর দিতে না পারে, তা নিশ্চয় দুঃখজনক।
প্রশ্ন হলো, দাবি-দাওয়ার জন্য সড়কে কেন নামতে হবে? এর মধ্যে অনেক দাবি নিয়ে নিশ্চয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সেগুলো যথাসময়ে পূরণ হয়নি বলেই তাদের রাস্তায় নামতে হয়েছে। আবার এমনও হতে পারে, যখন এক দল দেখছে, অন্যরা আন্দোলন করছে; সুযোগ বুঝে তারাও নেমে পড়ছে। রাস্তায় নামার আগে অন্তত কর্তৃপক্ষকে যথেষ্ট সময় দেওয়া এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নীতিনির্ধারকদের কাছে দাবির যৌক্তিকতাও তুলে ধরা উচিত।
দুঃখজনক হলেও সত্য, দাবি-দাওয়া পেশ ও তা মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে আগে থেকেই এক ধরনের অপসংস্কৃতি চালু আছে। অনেক সময় কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকার সুন্দরভাবে দাবি করলেও তা মেনে নেয় না। রাস্তায় আন্দোলন গড়ানোর পরই তাদের টনক নড়ে। আবার সুযোগ সন্ধানী দল আছে; কিছু হলেই রাস্তায় নেমে পড়ে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বাস্তবতা আন্দোলনকারীদের বোঝা উচিত। সরকারেরও উচিত আন্তরিকতার সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দাবি শোনা এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের উচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসা। সরকারের বাস্তবতা তুলে ধরে তারা দাবি পূরণের আশ্বাস দিতে পারেন কিংবা পরবর্তী সরকারকে পরামর্শ দিতে পারেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে এই মুহূর্তে নির্বাচনকেন্দ্রিক কাজেই মনোনিবেশ করা উচিত। এর আগে সংস্কার এবং বিচারের যে দাবি আছে, তাও একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হলগুলোতে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কোনো ধরনের রাজনীতি করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ঘোষণায় ছাত্রনেতারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। ইতিমধ্যে এই নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনসহ শিক্ষার্থীদের নানা পর্যায়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি থাকা না–থাকা নিয়ে আলোচনা চলছে।
গত শুক্রবার গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবাসিক হলে রাজনীতি বন্ধের ওই ঘোষণা দেয়। তবে গতকাল শনিবার দিনভর এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য আসেনি। এ বিষয়ে করণীয় ও রূপরেখা ঠিক করতে গতকাল দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত হল প্রভোস্টসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বৈঠক করেছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে আজ রোববার বিকেলে ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন তাঁরা।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলের জন্য সংগঠনটির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে। এরপর ওই দিন মধ্যরাতে হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। বিভিন্ন হল থেকে কয়েক শ ছাত্র–ছাত্রী বাইরে বেরিয়ে আসেন। রাত একটার দিকে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন তাঁরা। শুক্রবার রাত দুইটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান ও প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তাঁদের সঙ্গে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের প্রায় এক ঘণ্টা আলাপ-আলোচনা হয়। তখন উপাচার্য বলেন, ‘হল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই হল প্রভোস্টের নেওয়া সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।’ পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, ‘হল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রিত থাকবে।’ উপাচার্যের এ বক্তব্যে শিক্ষার্থীরা ‘না, না’ বলে আপত্তি জানান এবং হলগুলোতে সম্পূর্ণভাবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করেন। পরে রাত তিনটার দিকে বিক্ষোভের মুখে প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ হলগুলোতে ‘প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেন।
শিক্ষার্থীরা প্রক্টরের আশ্বাসে উল্লাস প্রকাশ করে হলে ফিরে যান। প্রক্টরের ওই ঘোষণার আধঘণ্টা পর স্যার এ এফ রহমান হলের প্রভোস্ট অফিস থেকে এক প্রজ্ঞাপন আসে। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের কমিটিভুক্তরা পদত্যাগ ও মুচলেকা প্রদান সাপেক্ষে হলে অবস্থান করতে পারবেন। অন্যথায় তাদের হল থেকে বহিষ্কার করা হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল ছাত্রলীগ। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দিন পর ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে বিতাড়িত হয় ছাত্রলীগ। সে সময় শিক্ষার্থীরা প্রতিটি হলের হল প্রাধ্যক্ষদের কাছ থেকে আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে—এমন বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর নেয়। মূলত সেই বিজ্ঞপ্তির আলোকে শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করায় ক্ষোভ জানায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার প্রতিবাদে শুক্রবার মধ্যরাতে রোকেয়া হলের ছাত্রীরা হলের তালা ভেঙে বেরিয়ে এসে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ করেন