টানা ১২ দিন তীব্র পাল্টাপাল্টি হামলার পর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে ইরান ও ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত হামলা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই দেশ। যদিও যুদ্ধবিরতি পুরোপুরি কার্যকর হওয়ার আগে একে অপরের ওপর হামলা চালিয়েছে ইরান ও ইসরায়েল।
১৩ জুন থেকে ইরানে ইসরায়েলের হামলা; জবাবে পরদিন থেকে ইসরায়েলে ইরানের পাল্টা হামলা; এই সংঘাতের মধ্যে ২১ জুন ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা; জবাবে এক দিন পর ২৩ জুন কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের হামলা—১২ দিন চলমান এমন সংকটের মধ্যে হঠাৎ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন ট্রাম্প।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগে এই সংঘাতে ইরানে সামরিক বাহিনীর বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা-সদস্য, পরমাণুবিজ্ঞানী, বেসামরিক নাগরিকসহ ছয় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের হামলায় দেশটির বিভিন্ন পরমাণু স্থাপনা ও সামরিক-বেসামরিক স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপর দিকে ইসরায়েলের বিভিন্ন গণমাধ্যমের হিসাবে, ইরানের হামলায় দেশটিতে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত অন্তত ২৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কার্যালয়সহ দেশটির বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক স্থাপনায় হামলার দাবি করেছে তেহরান।
যুদ্ধবিরতির প্রথম ঘোষণা আসে ট্রাম্পের কাছ থেকে। ২৩ জুন রাতে কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের আল উদেইদ সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের হামলার কয়েক ঘণ্টা পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি জানান, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। যুদ্ধবিরতির একটি সময়ক্রমও উল্লেখ করেন তিনি। তাতে বলা হয়, প্রথমে ইরান ও পরে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি কার্যকর করবে।
সে হিসাবে ইরানের স্থানীয় সময় গতকাল সকাল সাড়ে সাতটা থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু করার কথা ছিল তেহরানের। সকালে যুদ্ধবিরতি শুরুর কথাও জানিয়েছিল ইরানের সংবাদমাধ্যম প্রেস টিভি। এরপর ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এক বিবৃতিতে জানায়, ‘জায়নবাদী’ শত্রু ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধে’ বিরতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী, ইরান যুদ্ধবিরতি শুরুর ১২ ঘণ্টা পর ইসরায়েলের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটায় যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার কথা ছিল ইসরায়েলি বাহিনীর। তবে ইরানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার আগেই যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার কথা জানান ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ইরানে ইসরায়েলের ‘সব লক্ষ্য’ অর্জন হয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানায় তাঁর কার্যালয়।
অবশ্য ইরানে ইসরায়েল নিজেদের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন তেহরানভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক আবাস আসলানি। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, এই সংঘাতে ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা এবং দেশটিতে সরকার পরিবর্তন করা। ইরানে পরমাণু স্থাপনায় হামলা হলেও সেগুলো আগে থেকেই খালি করা হয়েছিল বলে জানা গেছে। সরকারও পরিবর্তন হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি যদি শেষ পর্যন্ত টিকে যায়, তাহলে বলা চলে ইসরায়েল তাদের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকরের আগে ব্যাপক হামলা
ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর ইসরায়েলে ব্যাপক হামলা চালায় ইরান। গতকাল ইরানের যুদ্ধবিরতি কার্যকরের সময়ের আগে ও কিছুটা পরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে নিরাপদে থাকতে ছয়বার সতর্কবার্তা জারি করে ইসরায়েল। দেশটির দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে বাজতে থাকে সাইরেন। তেল আবিব থেকে শোনা যায় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। একটি ভিডিওতে দক্ষিণ ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হতে দেখা যায়।
এই দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত ইসরায়েলের বিরশেবা শহর। ইসরায়েলের জরুরি সেবা সংস্থার প্রধান এলি বিন বলেন, হামলায় বিরশেবার তিনটি ভবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা রয়েছেন। নিহত হয়েছেন চারজন। এ নিয়ে ইসরায়েলে গতকাল পর্যন্ত ২৮ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যম।
ইসরায়েলের অভিযোগ, যুদ্ধবিরতির সময় শুরু হওয়ার পরও হামলা চালায় ইরান। এর ‘শক্তিশালী জবাব’ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। তবে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোরের (আইআরজিসি) পক্ষ থেকে জানানো হয়, যুদ্ধবিরতি শুরুর কয়েক মিনিট আগে ওই হামলা চালানো হয়েছিল। যুদ্ধবিরতির সময় শুরুর পর ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলে পৌঁছায়।
সকাল সাড়ে সাতটায় ইরান যুদ্ধবিরতি শুরুর আগে ইসরায়েলও তেহরানসহ ইরানের বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালায়। গতকাল ইরানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ রেজা জাফরগানি বলেন, আগের ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন ১০৭ জন। তাঁদের মধ্যে একজন পরমাণুবিজ্ঞানী রয়েছেন। আর ১২ দিনের সংঘাতে ইরানে মোট নিহত হয়েছেন ৬০৬ জন। আহত হয়েছেন পাঁচ হাজার জনের বেশি।
ইরান যুদ্ধবিরতি শুরুর পর দেশটিতে হামলা চালায় ইসরায়েলও। গতকাল স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটায় ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি শুরুর আগে তেহরানসহ ইরানের একাধিক এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। পরে নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনালাপ হয়েছে ট্রাম্পের। ওই আলাপের পর আরও হামলা চালানো থেকে বিরত থাকতে রাজি হয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী।
যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনে ট্রাম্পের ক্ষোভ
যুদ্ধবিরতির সময় শুরু হওয়ার পর ইসরায়েল ও ইরান—দুই দেশই তা লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ আনেন ট্রাম্প। গতকাল নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ছাড়ার আগে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ইরান ও ইসরায়েলকে নিয়ে খুশি নন। বিশেষ করে ইসরায়েলের ওপর। কারণ, যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার পর তারা হামলা চালিয়েছে।
ইসরায়েলকে নিয়ে ট্রুথ সোশ্যালেও একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেন ট্রাম্প। এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল, এই বোমাগুলো আপনারা (ইরানে) ফেলবেন না। যদি আপনারা এটি করেন, তাহলে তা হবে যুদ্ধবিরতির বড় লঙ্ঘন। এখনই আপনাদের পাইলটদের দেশে ফিরিয়ে আনুন।’
যেভাবে হলো যুদ্ধবিরতি আলোচনা
২৩ জুন রাতে কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে যখন ইরান হামলা চালায়, তখন হোয়াইট হাউসের ‘সিচুয়েশন রুমে’ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ছিলেন ট্রাম্প। ওই হামলার কয়েক ঘণ্টা পর ট্রুথ সোশ্যালে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প বলেন, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। তাঁর ঘোষণার ৬ ঘণ্টা পর ইরান প্রথম যুদ্ধবিরতি শুরু করবে। এর ১২ ঘণ্টা পর যুদ্ধবিরতি শুরু করবে ইসরায়েল। এক পক্ষের যুদ্ধবিরতির সময় অন্য পক্ষ এর প্রতি সম্মান জানাবে। এভাবে মোট ২৪ ঘণ্টা পর ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ শেষ হবে।
হোয়াইট হাউসের বরাতে আল-জাজিরার খবরে বলা হয়, যুদ্ধবিরতিতে নেতানিয়াহুকে রাজি করানোর জন্য তাঁর সঙ্গে কথা বলেন ট্রাম্প। নেতানিয়াহু রাজি হওয়ার পর তিনি ফোন করেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে। অনুরোধ করেন, যুদ্ধবিরতিতে ইরানকে রাজি করানোর জন্য। কাতারের আহ্বানে রাজি হয় তেহরান। এ সময় ইরানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফও।
‘আমরা খুব খুশি’
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির পর স্বস্তি প্রকাশ করেছেন দুই দেশের মানুষ। যুদ্ধবিরতির খবর পেয়ে ইরানের রাশত এলাকা থেকে তেহরানে ফিরছিলেন রেজা শরিফি নামের এক ব্যক্তি। রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আমরা খুব খুশি। যে–ই মধ্যস্থতা করুন না কেন, তা কোনো বিষয় নয়। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, সেটিই আসল বিষয়।’ আর তেল আবিবের বাসিন্দা আরিক দাইমান্ত বলেন, ‘আমি আশা করি এই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে নতুন দিনের সূচনা হবে।’
যুদ্ধবিরতিতে স্বস্তি প্রকাশ করেছে বিভিন্ন দেশও। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, ‘সত্যিকারের একটি যুদ্ধবিরতির’ আশা করছে বেইজিং। এই যুদ্ধবিরতি যেন টেকসই হয়, সে আশা প্রকাশ করেছে রাশিয়াও। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন, এমন পদক্ষেপকে স্বাগত জানান তাঁরা।
যুদ্ধবিরতির পর পরমাণু প্রকল্প নিয়ে তেহরানকে আলোচনার টেবিলে ফেরার আহ্বান জানিয়েছে ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি–বিষয়ক প্রধান কাজা কালাস বলেছেন, এই যুদ্ধবিরতি যেন মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি মোড় বদল হয়, সে আশা করছেন তিনি।
হরমুজ প্রণালি নিয়ে স্বস্তি ফিরল
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর হরমুজ প্রণালি দিয়ে জাহাজ চলাচল নিয়ে বড় শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এই প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্তে অনুমোদন দিয়েছিল ইরানের পার্লামেন্ট। এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত কার্যকরে শুধু প্রয়োজন ছিল ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সায়। এমন উত্তেজনার মধ্যে ২৩ জুন হরমুজ প্রণালির পথ এড়িয়ে যায় অন্তত পাঁচটি জাহাজ।
হরমুজ প্রণালি দিয়ে বিশ্বের ২০ শতাংশ জ্বালানি পরিবহন করা হয়। গতকাল যুদ্ধবিরতির পর এএফপি জানায়, প্রণালিটি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে তেহরান। নরওয়েভিত্তিক জ্বালানি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিস্টাড এনার্জির গবেষক জর্জ লিওন এএফপিকে বলেন, ‘আমি মনে করি, হরমুজ প্রণালি বন্ধের ঝুঁকি এখন দ্রুত কমে এসেছে। কারণ, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।’
পরমাণু প্রকল্প নিয়ে সমস্যা সমাধানের আহ্বান
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের দ্বন্দ্বের শুরু ১৯৭৯ সালে দেশটিতে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে। ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে অনেক আগে থেকে দেশ দুটির আপত্তি রয়েছে। ইসরায়েলের অভিযোগ, প্রকল্পগুলোর শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের কথা বলে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে তেহরান। সেই অভিযোগ থেকে ১৩ জুন ইরানে হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী।
ইসরায়েলের হামলার মধ্যে জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) বিরুদ্ধে ‘পক্ষপাতিত্বের’ অভিযোগ এনেছিল তেহরান। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (এনপিটি) থেকে ইরান বের হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফোয়াদ ইজাদি। এই চুক্তির একটি শর্ত অনুযায়ী স্বাক্ষরকারী দেশগুলো পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারবে না।
গতকাল যুদ্ধবিরতি শুরুর পর ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি এক বিবৃতিতে বলেন, নিজেদের পরমাণু প্রকল্পগুলোয় ক্ষয়ক্ষতি পর্যালোচনা করে দেখছেন তাঁরা। এগুলো পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সে প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলোর কার্যক্রমে যেন ভবিষ্যতে আর বাধা না আসে, সে বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে তাঁদের।
তবে যুদ্ধবিরতির পর বিভিন্ন দেশসহ আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাও ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু আলোচনায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ইরানে ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর ওই আলোচনা স্থগিত করেছিল তেহরান। তবে ওই আলোচনা আবার শুরুর কথা বলেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। গতকাল সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ফোনালাপে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্যা সমাধানে প্রস্তুত আছে তেহরান। তিনি এ-ও জানিয়ে দেন, ইসরায়েল হামলা না চালালে আগ বাড়িয়ে হামলা চালাবে না তেহরান।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র এক ব ব ত ত পরর ষ ট র হওয় র পর শ র র পর র আহ ব ন র পরম ণ ক র যকর প রকল প ২৩ জ ন মন ত র ১২ দ ন দ শট ত ত র পর দ শট র র জন য বন ধ র লক ষ য গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
শশী থারুরকে নিয়ে কংগ্রেস জেরবার, মোদির মুখে মুচকি হাসি
কংগ্রেস নেতা শশী থারুরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঘিরে আরও একবার নতুনভাবে শুরু হয়েছে জল্পনা। তিনি নিজে থেকে দল ছাড়বেন, নাকি দল তাঁকে বহিষ্কার করবে, আলোচনার কেন্দ্রে এ দুই সম্ভাবনা। এ বিতর্ক কেরালার এই বিদগ্ধ সংসদ সদস্য নিজেই আবাহন করেছেন।
কেরালার নিলাম্বুর বিধানসভা কেন্দ্রের সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে বামফ্রন্টের প্রার্থীকে হারিয়ে কংগ্রেসের জয়ী হওয়ার দিনেই সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুতে শশী থারুর ভূয়সী প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। সেই নিবন্ধে তিনি লেখেন, ‘উদ্যম, সক্রিয়তা ও কোনো বিষয়ে সবার সঙ্গে জড়িত থাকার ইচ্ছা—প্রধানমন্ত্রীর এই তিন গুণ বৈশ্বিক মঞ্চে ভারতের মূল সম্পদ। তাই তিনি আরও বেশি সমর্থন পাওয়ার যোগ্য।’
পেহেলগাম–কাণ্ডের পর অপারেশন সিঁদুরের প্রয়োজনীয়তা ও সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদের চরিত্র বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে নরেন্দ্র মোদি বিভিন্ন দেশে সাতটি সর্বদলীয় প্রতিনিধদল পাঠিয়েছিলেন। একটি দলের নেতা করা হয়েছিল কেরালার তিরুবনন্তপুরম থেকে চারবার লোকসভায় নির্বাচিত কংগ্রেসের এই নেতাকে। প্রতিনিধিদলের শরিক হতে কংগ্রেসের কাছে চারজনের নাম চাওয়া হয়েছিল। শশী থারুরের নাম সেই তালিকায় ছিল না। কিন্তু কংগ্রেসকে অগ্রাহ্য করেই প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বেছে নিয়েছিলেন। শশী আগেও মোদি–ভক্ত ছিলেন। প্রতিনিধিদলের নেতা মনোনীত হওয়ার পর নতুন উদ্যমে তিনি মোদি–বন্দনায় মুখর হন। দেশে ও বিদেশে বারবার মোদির ‘দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বগুণের’ তারিফ করতে থাকেন। মোদির জাতীয়তাবাদের সমর্থনে কথা বলতে শুরু করেন। শশীকে নিয়ে কংগ্রেসে টানাপোড়েন আগে থেকেই চলছিল। অপারেশন সিঁদুরের পর তা তীব্রতর হয়েছে।
দ্য হিন্দু পত্রিকায় শশীর নিবন্ধ (লেসেন্স ফ্রম অপারেশন সিন্দুরর্স গ্লোবাল আউটরিচ) প্রকাশিত হয় ২৩ জুন। তার মাত্র কয় দিন আগে ওই কাগজেই কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী এক নিবন্ধে মোদি সরকারের ইসরায়েল–ফিলিস্তিন নীতির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। গাজায় ইসরায়েলি তাণ্ডব নিয়ে ভারত সরকারের বিস্ময়কর নীরবতার উল্লেখ করে সোনিয়া লিখেছিলেন, ‘শুধু কণ্ঠ রুদ্ধ রাখাই নয়, দীর্ঘকাল যাবৎ লালিত মূল্যবোধও ভারত বিসর্জন দিয়েছে।’ মোদির সমালোচনা করা সোনিয়ার ওই নিবন্ধের পিঠাপিঠি ওই কাগজেই শশীর ‘মোদি–বন্দনা’ কংগ্রেস নেতৃত্বকে ক্ষুব্ধ করে। কংগ্রেস মনে করছে, সোনিয়া তাঁর নিবন্ধে মোদির পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করেছিলেন, অথচ শশী থারুর মুখর হলেন মোদির পররাষ্ট্রনীতির সার্থকতা নিয়ে। মোদির প্রশংসা করে তিনি লিখলেন, ‘ভারত ঐক্যবদ্ধ থাকলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে নিজেদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরা যায়।’
ওই নিবন্ধের পর শশীকে নিয়ে কংগ্রেস ও জাতীয় রাজনীতিতে নতুনভাবে যে আলোড়ন উঠেছে, কেরালার এই সংসদ সদস্য গতকাল মঙ্গলবার নিজেই তা নস্যাৎ করেছেন। বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদির উদ্যম, প্রাণশক্তি ও সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতার প্রশংসা করেছি বলেই এমন ভাবা ঠিক নয় যে আমি লাফ মেরে বিজেপিতে ঢুকে পড়তে চাইছি। দুর্ভাগ্য যে কেউ কেউ এমন একটা ছবি আঁকতে চাইছেন। আমি যা লিখেছি, যা বলেছি, তাতে জাতীয় ঐক্য, জাতীয় স্বার্থ ও দেশের জন্য দাঁড়ানোর কথাই বলা হয়েছে।’
শশী আরও বলেন, ‘আমি গর্বিত দেশের সেবা করার সুযোগ পেয়েছি বলে। আমি মনে করি, রাজনৈতিক বিরোধিতা দেশের সীমান্তেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত। বিজেপির পররাষ্ট্রনীতি বা কংগ্রেসের পররাষ্ট্রনীতি বলে কিছু থাকা উচিত বলে আমি মনে করি না। মনে করি, পররাষ্ট্রনীতি হবে একমাত্র ভারতের। স্বার্থও ভারতের।’
কংগ্রেস না ছাড়ার বাসনার কথা এর আগেও এ ধরনের বিতর্কের মুখে শশী বলেছিলেন। কিন্তু দলীয় নীতি মেনে সরকারের সমালোচনাও করেননি। বরং বারবার দলের নীতি ও মনোভাবের বাইরে গিয়ে মোদি সরকারের প্রশংসা করেছেন। এ নিয়ে দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বেড়ে গেছে। দূরত্ব ঘোচাতে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে শশীর বৈঠকও হয়েছিল। কিন্তু তারপরও তাঁর ‘মোদি–বন্দনা’ বন্ধ হয়নি। এ কারণেই দলের একটা বড় অংশ, প্রধানত কেরালার কংগ্রেস মহল মনে করছে, শশীর দলত্যাগ ও বিজেপিতে যোগদান স্রেফ সময়ের ব্যাপার।
অপারেশন সিঁদুর চলাকালে শুরু হয়েছিল উপনির্বাচনের প্রচার। উপনির্বাচন ছিল দেশের চার রাজ্যের পাঁচ বিধানসভা কেন্দ্রে। কেরালার নিলাম্বুরের পাশাপাশি ভোট ছিল পশ্চিমবঙ্গের কালীগঞ্জ, পাঞ্জাবের লুধিয়ানা এবং গুজরাটের বিষবদার ও কাডি আসনে। এই পাঁচ আসনের একটিও কংগ্রেসের দখলে ছিল না। লুধিয়ানা ও বিষবদার ছিল আম আদমি পার্টির কাছে, কালীগঞ্জ তৃণমূল কংগ্রেসের, কাডি বিজেপির এবং নিলাম্বুর বাম জোটের কাছে। কেরালার এই কেন্দ্র কংগ্রেস ছিনিয়ে নেয় প্রধানত বাম ভোট ভাগ হওয়ায়। ২০১৬ ও ২০২১ সালের ভোটে ওই কেন্দ্রে জিতেছিলেন বাম–সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আনওয়ার। দল ও বিধায়ক পদে ইস্তফা দিয়ে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়ে এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আনওয়ার ভোট পান প্রায় ২০ হাজার। বাম ভোটের এই ভাগাভাগিতে ১১ হাজার ভোটে জিতে আসনটি দখল করে কংগ্রেস। উপনির্বাচনে বিজেপি পায় চতুর্থ স্থান।
লক্ষ্যণীয়, নিলাম্বুর উপনির্বাচনের আগে দেশে ফিরে এলেও শশী থারুরকে কংগ্রেস প্রচার করতে দেয়নি। রাজ্যের কংগ্রেস নেতৃত্ব তাঁকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে। শশীকে উপেক্ষা ও কার্যত একঘরে করে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব বুঝিয়ে দেয়, রাজ্য রাজনীতিতে তাঁর ওজন যৎসামান্য। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এই মহল বোঝাতে চাইছে, শশীর সাহায্য ছাড়াই কংগ্রেসকে ক্ষমতায় ফেরানোর শক্তি তাঁদের আছে। কেরালার কংগ্রেসের প্রধান মুখ রাহুল–ঘনিষ্ট কে সি বেণুগোপাল। কেরালা বিধানসভার নির্বাচন আগামী বছর, ২০২৬ সালে।
শশী কখনোই গান্ধী পরিবারের ‘ইয়েস ম্যান’ বা অন্ধ অনুগত হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। কূটনীতির পদ ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিলেও বরাবর তিনি দলে নিজস্বতা ধরে রেখেছেন। কংগ্রেসও সংসদে তাঁর বাগ্মিতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের চিড় প্রথম ধরে ২০২১ সালে, যখন গুলাম নবী আজাদের নেতৃত্বে ২৩ জন শীর্ষ কংগ্রেস নেতা উপর্যপরি ব্যর্থতা দেখে দল পরিচালনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে চিঠি লিখেছিলেন। শশী থারুর ছিলেন সেই ২৩ জনের একজন। পরে দলের সভাপতি নির্বাচনে মল্লিকার্জুন খাড়গের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। শশীর কথায়, সেটা ছিল দলের গণতান্ত্রিক চরিত্রের পরিচয়। এরপরও কংগ্রেস শশীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে তিরুবনন্তপুরম থেকে তাঁকে টিকিটও দেওয়া হয়।
শশীকে নিয়ে কংগ্রেস এখন কী করবে, কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই আলোচনার মূল বিষয়। দলের একাংশের মতে, শশী বরাবরই লাগামছাড়া। নিজস্বতা জাহির করতে ভালোবাসেন। এই মহল মনে করছে, ইদানীং দিনের পর দিন তিনি যেভাবে মোদির প্রশংসা করছেন, কখনো কেরালার সিপিএম মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের সুখ্যাতি করছেন, দলীয় অনুশাসন না মেনে মোদি সরকারের বিভিন্ন নীতি সমর্থন করছেন, তাতে মনে হচ্ছে তিনি চাইছেন দল তাঁকে বিতাড়িত করুক। সে ক্ষেত্রে বিজেপিতে যোগ দিতে তাঁর কোনো অসুবিধা থাকবে না। এই মহলের মতে, দলের তা করা উচিত নয়। দলে শশীর গুরুত্ব কমানো হোক। যেভাবে নিলাম্বুর নির্বাচনে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল না, সেভাবে তাঁকে উপেক্ষা করা হোক। দল ছাড়তে হলে সেই দায় যাতে তাঁর ওপরেই বর্তায়, সেটা দেখা দরকার।
শশীকে দলে নিলে কেরালায় বিজেপির যে খুব একটা লাভ হবে না কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তা জানা। কেরালায় বিজেপি এখনো তৃতীয় শক্তি। তা ছাড়া শশীর রাজনৈতিক চরিত্রও কেরালার নেতৃত্বের জানা। আরএসএস ও বিজেপির অনুশাসনের মধ্যে তাঁকে বেঁধে রাখা কঠিন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁকে পছন্দ করেন। বিজেপির একাংশের মতে, শশী দলত্যাগ করলে কিছুটা হলেও কংগ্রেসের ক্ষতি। বিজেপি প্রচার করতে পারবে যে কংগ্রেস গণতন্ত্রহীন। গান্ধী পরিবারের বিরোধিতা করে সেখানে কেউ টিকতে পারে না। তিনি বিজেপিতে যোগ দিলে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হবে। সংসদে বিজেপির পরিশীলিত স্বর গুরুত্ব পাবে। আন্তর্জাতিক স্তরেও গুরুত্ব বাড়বে। তা ছাড়া নরেন্দ্র মোদিও এমন ব্যক্তিদের গুরুত্ব দিচ্ছেন, যাঁরা রাজনৈতিকভাবে কম ওজনদার অথচ বৌদ্ধিক দিক থেকে সমৃদ্ধ। যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণো, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বর্তমানে কেরালা বিজেপির সভাপতি রাজীব চন্দ্রশেখর।
কী করবেন শশী থারুর? কেরালায় বিজেপির চোখে কংগ্রেস ও সিপিএম দুই দলই ‘ইসলামি মৌলবাদীদের দোসর’। এযাবৎ ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী শশী কি পারবেন বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদের আখ্যান মেনে নিতে? কংগ্রেসে উপেক্ষার পাত্র হয়েও কি তাঁর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব? কংগ্রেসও কি এই সময়ে শশীকে ছেঁটে ফেলার মতো ঝুঁকি নিতে চাইবে? বিশেষ করে, কেরালায় তাদের পরবর্তী পরীক্ষা যখন পঞ্চায়েত ভোট? যে ভোটে বামফ্রন্টকে হারাতে না পারলে বিধানসভায় জেতা কঠিন?
শশী থারুর এই মুহূর্তে কংগ্রেসের শাঁখের করাত। গলার কাঁটা।