আরবি নববর্ষ ১৪৪৭-এর আগমনকে স্বাগত জানাই। হিজরি নতুন বছর শুরু হয় মহররম মাস দিয়ে। হিজরি সন মূলত একটি চন্দ্রনির্ভর বর্ষপঞ্জিকা, যা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণে গণনা করা হয়। ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান, আনন্দ-উৎসবসহ সর্বক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ চান্দ্র তারিখের ওপর নির্ভরশীল। আরবি হিজরি সনের সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তমদ্দুনও ঐতিহ্যগতভাবে সম্পৃক্ত।
বছরকে আমরা সাল বা সন বলি। সন শব্দটি আরবি; বাংলায় বর্ষ, বছর ও অব্দ। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনের সময়কে সৌরবর্ষ এবং পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের আবর্তনের সময়কে চান্দ্রবর্ষ বলা হয়। চাঁদের হিসাবে সব ইবাদতের প্রচলন হজরত আদম (আ.
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন খলিফা বললেন, পরবর্তী কোনো সময়ে তা কীভাবে বোঝা যাবে যে, এটি কোন সনে পেশ করা হয়েছিল? অতঃপর তিনি সাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের জ্ঞানী-গুণীর পরামর্শে হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা অনুযায়ী ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হিজরি সন প্রবর্তনের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলী (রা.)। পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামী বর্ষ শুরু করার পরামর্শ দেন হজরত উসমান (রা.)। (বুখারি ও আবুদাউদ) ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। ইসলামের ইতিহাসে এই মাস এমন কতগুলো উল্লেখযোগ্য স্মৃতিবিজড়িত, যেসব স্মৃতির সম্মানার্থেই এই মাসকে মহররম বা সম্মানিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সুরা তাওবার ৩৬ আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২। তার মধ্যে চারটি মাস (মহররম, রজব, জিলকদ, জিলহজ) সম্মানিত।’
এ আয়াতের চারটি সম্মানিত মাসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে মহানবী (সা.) বিদায় হজের সময় মিনা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলেন, তিনটি মাস হলো জিলকদ, জিলহজ ও মহররম এবং অপরটি হলো রজব। (তাফসির ইবনে কাসির) হাদিস শরিফে চান্দ্রবর্ষের ১২ মাসের মধ্যে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি)
মুসলিম হিসেবে হিজরি নববর্ষ উদযাপন কিংবা মুসলিমদের গৌরবের দিনটি পালনের ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপকতা লাভ করেনি।
আমরা অনেকে জানি না, মুসলিমদের নববর্ষ কোন মাসে হয়? আবার কেউ হয়তো হিজরি বর্ষ গণনার সঠিক ইতিহাস জানেন না! হিজরি সনের তারিখেরও খবর রাখেন না।
হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম কারবালার ঐতিহাসিক হৃদয়বিদারক ঘটনার অনন্য স্মৃতি বহন করে। মুসলিম বিশ্বে মহররম মাসকে শোকের মাস হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। এ মাসের ১০ তারিখে কারবালা ময়দানে প্রিয় নবীর (সা.) দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-সহ অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম শাহাদাতের সুধা পান করেন নির্মম ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে। তাই শোকের মাসটির শুরুতে অনেকেই আনন্দ উৎসব উদযাপন করাকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন।
মহররম মাস মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র মাস হিসেবে বিবেচিত। এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ। তাই এই মাস ইবাদত-বন্দেগি, দান-খয়রাত এবং আত্মসমালোচনার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি মুসলিমদের আত্মোন্নয়ন, ত্যাগ ও একতার শিক্ষা দেয়।
ড. মো. শাহজাহান কবীর: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক
স্টাডিজ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
আদি বিশ্বাস ও উৎসবে ফুল-বিহঙ্গের প্রভাব
বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষের কাছে ফুল অতি পবিত্র। ফলে তাদের দৈনন্দিন উপাসনা ছাড়াও উৎসবের নানা আচারে ফুলের ব্যবহার লক্ষণীয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি মারমা। তারা উদ্যাপন করে নববর্ষবরণ অনুষ্ঠান বা ‘সাংগ্রাইং’। এটি তাাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব।
কেন এই উৎসব? মূলত সংক্রান্তি শব্দ থেকেই এসেছে ‘সাংগ্রাইং’ শব্দটি। মারমারা বিশ্বাস করে, এ পৃথিবীতে সাংগ্রাং নামে এক ধর্মীয় দেবী মানুষের সৌভাগ্য আর কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসেন। তাই স্বর্গ থেকে মর্ত্যে দেবী নেমে আসার অর্থাৎ পৃথিবীতে পা রাখার ক্ষণটি থেকেই শুরু হয় সাংগ্রাইং বা নববর্ষ উদ্যাপনের উৎসব।
পৃথিবীতে যে কদিন দেবী অবস্থান করবেন, সে কদিন ধরেই চলে উৎসবটি। সাধারণত তিন দিন এ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা উদ্যাপন করা হয়। সাংগ্রাং দেবীর ফুল পছন্দ। তাই এ উৎসবে ফুলের ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয়। প্রথম দিনটিকে তারা বলে ‘পাইং ছোয়াইক’, যার শাব্দিক অর্থ ‘ফুল তোলা’। এদিন যুবতীরা গোলাপ, জবা, গন্ধরাজ, বেলিসহ নানা ধরনের পাহাড়ি সুগন্ধি ফুল সংগ্রহ করে। রাতে সেসব ফুল সাজিয়ে দল বেঁধে ভোরবেলা সবাই বৌদ্ধবিহারে গমন করে। আগেই বুদ্ধমূর্তির বেদির স্থানটুকু ফুল ও মাল্যে ভরিয়ে দেয়। অতঃপর তারা সেখানে মনের নানা ইচ্ছার কথা জানিয়ে প্রার্থনা করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি মারমা। তারা উদ্যাপন করে নববর্ষবরণ অনুষ্ঠান বা ‘সাংগ্রাইং’। আবার ফুলকে বরণ করতেই সমতলে সাঁওতালরা বাহাপরব বা বাহা উৎসব উদ্যাপন করে থাকে। ফুলের আধিক্য পাওয়া যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের বিজু উৎসবেও। উৎসবে মূল বিজুর আগের দিনটিকে তারা বলে ফুল বিজু।আবার ফুলকে বরণ করতেই সমতলে সাঁওতালরা বাহাপরব বা বাহা উৎসব উদ্যাপন করে থাকে। সাধারণত ফাগুন মাসের শেষে বা চৈত্রের শুরুতে আয়োজন করা হয় অনুষ্ঠানটি। সাঁওতালি ভাষায় ‘বাহা’ মানে ‘ফুল বা কুমারী কন্যা’ আর ‘পরব’ মানে ‘অনুষ্ঠান’ বা ‘উৎসব’। অনেকেই এটিকে বসন্ত উৎসব বা পুষ্প উৎসবও বলে থাকে। বসন্তে শাল, শিমুল, পলাশ, মহুয়া, চম্পা ফুল ফোটে চারদিকে। বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয় প্রকৃতি। কিন্তু বাহাপরবের আগে সাঁওতাল নারীরা সে ফুল উপভোগ করে না।
এ উৎসবটি তিন দিনের। তবে প্রথম দিনের অনুষ্ঠানই প্রধান। পরবের এক দিন আগে জাহের থান ও মাঝি থান নানাভাবে সাজানো হয়। নতুন সবুজ পত্রপল্লবে সেজে ওঠা ধরণি হলো পবিত্র কুমারী কন্যার প্রতীক। পরব শুরুর পূজায় দেবতাকে শাল ও মহুয়া ফুল উৎসর্গ করা হয়। অনুষ্ঠানে সাঁওতালরা শাল ফুলকে বরণ করে নেয় নানা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে।
বাহাপরবে শালফুল বরণের পর দুই সাঁওতাল বৃদ্ধার আনন্দ