মাসুকা শিক্ষকই হতে চেয়েছিলেন, দুর্ঘটনার সময় শ্রেণিকক্ষে পড়াচ্ছিলেন
Published: 23rd, July 2025 GMT
ছোটবেলা থেকেই শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন মাসুকা বেগম। পড়ালেখা শেষে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। চার বছর আগে তিনি যোগ দেন রাজধানী ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। গত সোমবার সেখানে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন মাসুকা। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
নিহত মাসুকা বেগম ওরফে নিপু (৩৮) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা চিলোকুট গ্রামের চৌধুরী বাড়ির সিদ্দিক আহমেদের মেয়ে। তবে তাঁর পরিবারের সদস্যরা জেলা শহরের মেড্ডা সবুজবাগ এলাকায় থাকেন। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মাসুকা সবার ছোট। তাঁর মা মারা গেছেন। বড় বোন পাপড়ি রহমানের শ্বশুরবাড়ি আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুরে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সোহাগপুর গ্রামে মাসুকা বেগমকে দাফন করা হয়েছে।
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৩২। অগ্নিদগ্ধ হয়ে যাঁরা হাসপাতালে ভর্তি আছেন, তাঁদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সময় স্কুলে ক্লাস নিচ্ছিলেন মাসুকা বেগম। তিনি ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। তাঁর শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। তাঁকে উদ্ধার করে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। পরে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী গতকাল বিকেলে তাঁর মরদেহ বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি আশুগঞ্জের সোহাগপুরে নেওয়া হয়। বিকেল ছয়টায় তাঁর লাশ দাফন করা হয়। তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে স্বজনেরা জড়ো হন। গ্রামে শোকের পরিবেশ তৈরি হয়।
মাসুকার বোনের স্বামী খলিলুর রহমান বলেন, ‘সোমবার বিমান দুর্ঘটনার পর থেকেই মাসুকার কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না। ঘণ্টাখানেক পর একজন ফোন ধরে বলল, “মাসুকা আহত হয়েছে।” ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর কোনো সন্ধান পাচ্ছিলাম না। রাত নয়টার দিকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে আহতদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। ওই তালিকায় মাসুকার নাম পাওয়া যায়। তাঁর সহকর্মী জানান, মাসুকার কণ্ঠনালিসহ শরীরের ৮৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে; বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম। এরপর রাত সাড়ে ১২টায় মাসুকার মৃত্যুর খবর পাই।’
খলিলুর রহমান আরও বলেন, মাসুকা মনপ্রাণ দিয়ে শিক্ষকতা করত। তাঁকে বিয়ের কথা বললে সে বলত, ‘বিয়ে করব না। শিক্ষার্থীরাই আমার সন্তান।’
নিহত মাসুকার বাবা সিদ্দিক আহমেদ বলেন, ‘১৫ বছর আগে মাসুকার মা মারা যায়। শিক্ষকতা ও আমাদের সংসারের জন্য সে আর বিয়ে করতে চায়নি। মাসুকা নিয়মিত আমার খোঁজখবর নিত; প্রতি মাসে টাকা পাঠাত। ১০-১৫ দিন আগে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল। এত অল্প বয়সে মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, কখনো ভাবিনি।’
ভাগনি ফাহমিদা খানমও জানান, তাঁর খালা মাসুকা বেগম শিক্ষকতা পেশাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি বলেন, ‘আমার খুব আদরের আন্টি (মাসুকা) ছিলেন। আমিও তাঁর খুব প্রিয় ছিলাম। কয়েক দিন আগে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল। তখন পরিবারের সবার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন। আমাদের বাড়িতে নিয়মিত আসতেন।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ক ষকত
এছাড়াও পড়ুন:
হনুমান কি পর্বত কাঁধে করে উড়ে এসেছিলেন?
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণের এক বিশিষ্ট অধ্যায়ে উঠে আসে এক অলৌকিক ঘটনার কথা। রাম-রাবণের মহাযুদ্ধে শ্রীরামচন্দ্রের ভাই লক্ষ্মণ অচেতন হয়ে পড়লে, তাঁকে জীবিত রাখতে প্রয়োজন হয় একটি বিশেষ ভেষজ উদ্ভিদের—সঞ্জীবনী বুটি। আয়ুর্বেদাচার্য সুষেণের পরামর্শে হনুমান ছুটে যান হিমালয়ের পাদদেশে গন্ধমাদন পর্বতে।
রামায়ণে বর্ণিত আছে, নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে। বিশ্বাস করা হয় যে তিনি দীর্ঘ আকাশপথ পাড়ি দেন এই পাহাড় বহন করে। পথিমধ্যে তিনি কিছু স্থানে বিশ্রামও নেন; যেসব স্থান আজও ‘হনুমান টোক’, ‘হনুমান চট’, ‘হনুমান ধারা’ নামে পরিচিত।
নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে।পৌরাণিক গ্রন্থগুলোয় সব ঘটনা রূপকভাবে লেখা আছে। এককথায় পুরাণের মধ্যে সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে আছে। গোলটা ফেলে মালটা বের করতে পারলে পৃথিবীর অনেক কল্যাণ হয়। এই ঘটনার রূপকতা ব্যাখ্যা করতে একটা গল্পের উল্লেখ করছি।
আরও পড়ুনভারতের আদিতম মহাকাব্য রামায়ণ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩বাড়িতে ২০০ মানুষকে নিমন্ত্রণ করে এক ব্যক্তি বাজারে গিয়ে অনেক বাজার করেছেন। ফেরার সময় তিনি নিজের সাইকেলের দুই হ্যান্ডলে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়েছেন, পেছনে দুটো ব্যাগ ঝোলানো, ক্যারিয়ারে একটা বস্তা বাঁধা। জায়গা না পেয়ে নিজের দুই কাঁধে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজার থেকে বাড়ির উদ্দেশে যাওয়ার পথে রাস্তায় এক লোক তাঁকে দেখে বললেন ‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন।
তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন। হনুমানের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটেছিল।
রামভক্ত হনুমান ছিলেন যোগী পুরুষ। তিনি যোগবলে অনেক অলৌকিক শক্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি যোগবলে নিজের আকার এত ছোট করে ফেলতে পারতেন যে তাঁকে খালি চোখে দেখা কষ্টকর হয়ে যেত। আবার তিনি ইচ্ছা করলে যোগবলে নিজের আকার অনেক বড় করে ফেলতে পারতেন। আর তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী।
‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন।তিনি আসলে ‘সঞ্জীবনী বুটি’ চিনতে না পেরে যোগবলে নিজের শরীরটা অনেক বড় করে সামনে যত ধরনের বৃক্ষ ও লতাপাতা পেয়েছিলেন, সেই সবকিছু সংগ্রহ করে বিশাল এক বোঝা বানিয়ে নিজের পিঠের ওপর তুলে যখন অতি দ্রুত এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে লাফ দিচ্ছিলেন, তখন সেই বিশালদেহী হনুমানকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন গোটা পাহাড়টাই পিঠে তুলে নিয়ে লাফাচ্ছেন।
আরও পড়ুনদুর্গাপূজার কাহিনি২০ অক্টোবর ২০২৩হনুমানের এই অসাধারণ কীর্তিকে অনেকেই অলৌকিক বলেই ভাবেন। কিন্তু অলৌকিকতা ছাপিয়ে এটা তাঁর গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা এবং গুরুর আদেশের প্রতি দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। ভারতের হিমাচল, উত্তরাখন্ড, মধ্যপ্রদেশ এমনকি বাংলাদেশের মহেশখালীর আদিনাথ ধামসহ কিছু স্থানে এই ঘটনার স্মৃতি বহন করে, এমন লোককথা এখনো প্রচলিত।
একটি পাহাড় কাঁধে বহন করে উড়ে যাওয়া প্রকৃতির নিয়মের বাইরে। আর অবতার, মহাপুরুষ বা প্রেরিত পুরুষেরা কখনো প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যান না। রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।
রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।মনে করেন, একজন যোগী পুরুষ নদীর তীর থেকে যোগবলে অদৃশ্য হয়ে নদীর মধ্যে ভেসে উঠলেন। আমি দেখতে পাচ্ছি না, জানতে পারছি না যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই আমার কাছে অলৌকিক। আর ওই যোগী জানেন যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই তাঁর কাছে লৌকিক।
যুগের পর যুগ ধরে লাখ লাখ ভক্তের হৃদয়ে এই ঘটনা গুরুর প্রতি শিষ্যের ভালোবাসা এবং নিজেকে গুরুর প্রতি সম্যকভাবে ন্যস্ত করার এক আস্থা ও অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে রয়েছে। হনুমানের এই গাথা তাঁর ভক্তিমূলক চরিত্রকে যেমন সমৃদ্ধ করে, তেমনি মানবজাতির দুর্দম সাহস ও আত্মত্যাগের কথাও মনে করিয়ে দেয়।
তথ্যসূত্র: ১. বাল্মীকি রামায়ণ. ২. কৃত্তিবাসী রামায়ণ, ৩. শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কথিত ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ, ৪. মহেশখালীর আদিনাথ ধাম অঞ্চলের লোককথা।
পার্থ দেব বর্মন: গবেষক, সৎসঙ্গ রিসার্চ সেন্টার
আরও পড়ুনরামচন্দ্র, বিষ্ণুর অবতার কিন্তু মানবিক১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩