ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য কমিশনার মারোশ শেফচোভিচ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর মধ্যে হওয়া একটি বাণিজ্যচুক্তির কথা বলেছেন। এই চুক্তি অনুযায়ী, ইউরোপীয় রপ্তানির ওপর যুক্তরাষ্ট্র ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক বসাবে। এর বদলে ইউরোপ আগামী তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি কিনবে এবং আরও ৬০০ বিলিয়ন ডলার সেখানে বিনিয়োগ করবে।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যদিও তার পরিমাণ প্রকাশ করা হয়নি। শেফচোভিচ এ চুক্তিকে বলছেন, ‘এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো চুক্তি ছিল।’ কিন্তু আসলেই কি এটা সবচেয়ে ভালো চুক্তি ছিল? ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর শুধু বিদেশি বাণিজ্য অংশীদারেরাই নন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, আইন প্রতিষ্ঠান, এমনকি সংবাদমাধ্যমও ভাবছে, ট্রাম্পের সঙ্গে চুক্তি করা মানে কি কেবল শক্তির খেলায় নামা, নাকি এর ফলে আমরা আইনকে অবহেলা করা এক নতুন স্বাভাবিক বাস্তবতায় ঢুকে পড়ছি?’

আরও পড়ুনট্রাম্প যেভাবে মিয়ানমারকে চীনের হাতে তুলে দিচ্ছেন০১ আগস্ট ২০২৫

এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আইনের শাসন না থাকলে কোনো চুক্তিকেই আমরা ‘সর্বোত্তম’ বলতে পারি না। বাজার যেটা চায়, সেটা হলো স্থিতিশীলতা ও পূর্বানুমানযোগ্যতা, যা আসে আইনের শাসন থেকে। আইন না থাকলে সবকিছু হয়ে দাঁড়ায় জোরজবরদস্তি আর লোকদেখানো নাটক। একটা ভালো চুক্তির জন্য দরকার দুটি বিষয়—একটি হলো সত্যিকারের সদিচ্ছা; আরেকটি হলো এমন নিয়মকানুন, যা নির্ভরযোগ্যভাবে কার্যকর করা যায় এবং একতরফাভাবে পরিবর্তন করা যায় না।

এবার ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প আগের চেয়ে বেশি বেপরোয়া ও ‘স্বাধীন’ হয়েছেন। তাঁর ওপর আইনের নিয়ন্ত্রণ কার্যত উঠে গেছে। এর একটি উদাহরণ হলো দেশের সবচেয়ে বড় আইনজীবী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তাঁর ‘চুক্তি’। এখন পর্যন্ত নয়টি বড় আইনপ্রতিষ্ঠান এমন চাপে পড়েছে যে তারা ট্রাম্পপন্থী কাজে ৯৪০ মিলিয়ন ডলারের বিনা পারিশ্রমিক আইনি সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল—তাদের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স বাতিল করা হবে, সরকারিভাবে চুক্তি থেকে বাদ দেওয়া হবে, এমনকি ফেডারেল কোর্টেও ঢুকতে দেওয়া হবে না। যদিও চারটি প্রতিষ্ঠান ট্রাম্পের এসব নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং আদালতে জয় পায়।

আরও পড়ুন‘ট্রাম্প ডকট্রিন’ নয় ইরানের ৩টি কৌশলই সফল তাহলে১৮ জুলাই ২০২৫

তাহলে প্রশ্ন আসে, দেশের সেরা আইনজীবীরা কেন এমন চাপের কাছে নতিস্বীকার করলেন? এর কারণ হলো আইনজীবীরা বুঝেছেন, এখন আর কেবল আইনের পক্ষে থাকলেই নিরাপদ থাকা যায় না। ট্রাম্প প্রশাসন পুরো আইন প্রয়োগব্যবস্থাকে নিজের ইচ্ছার অধীন নিয়ে এসেছে। প্রেসিডেন্ট চাইলে যেকোনো সময় যেকোনোভাবে তাঁদের শাস্তি দিতে পারেন। আইনের কোনো সুরক্ষা আর নেই। এখানেই মূল সমস্যা। যারা একচ্ছত্র ক্ষমতা চায়, তারা কোনো নিয়ম মানে না।

দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেই ট্রাম্প ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার মাধ্যমে অতিরিক্ত ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি ব্যবহার করেন ১৭৯৮ সালের এলিয়েন এনিমিস অ্যাক্ট। এই আইন কেবল তখনই কার্যকর হয়, যখন যুদ্ধ বা বিদেশি আগ্রাসনের মতো পরিস্থিতি ঘটে। কিন্তু ট্রাম্প এই আইন ব্যবহার করে ভেনেজুয়েলার একটি মাদক চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেন। এই যুক্তি ব্যবহার করে যেকোনো দেশের নাগরিককে (যে দেশ যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন বা মাদক পাচারের উৎস) টার্গেট করা সম্ভব।

আরও পড়ুনট্রাম্প কি বিশ্বের সব ডানপন্থী নিয়ে জোট গড়তে চান১৭ জুলাই ২০২৫

ট্রাম্পের আরেকটি নির্বাহী আদেশ যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার বাতিল করে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪তম সংশোধনী বলছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া এবং এখানকার আইনের আওতায় থাকা প্রত্যেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।’ এ পরিস্থিতিতে কেউ যদি ট্রাম্পের সঙ্গে চুক্তি করে, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ‘আপনি আসলে কোন ভিত্তিতে এই চুক্তিকে টেকসই বলে মনে করছেন?’

এই সংকটে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় বিশ্ববিদ্যালয়ও। ট্রাম্প প্রশাসন তাদের হুমকি দিয়েছে, বিলিয়ন ডলারের সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেবে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর-ছাড়ের সুবিধাও বাতিল করবে। এখন তারা ভাবছে, ট্রাম্পকে খুশি রাখতে কি চুক্তি করে ফেলবে, নাকি একজোট হয়ে বলবে, ‘আমরা এই অন্যায় শর্ত মেনে নেব না?’ যে চুক্তি যেকোনো সময় একতরফাভাবে বাতিল বা পরিবর্তন করা যায়, সেই চুক্তি আসলে ফাঁকা বুলি। এটি আত্মপ্রবঞ্চনা, স্বার্থের মুখোশ।

রিচার্ড কে শারউইন নিউইয়র্ক ল স্কুলের আইন বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ 

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র আইন র ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

গুলিতে নিহত ছেলের জামা-জুতা আগলে দিন কাটে নাছিমার

ছেলে সাদ আল আফনানের কথা উঠলেই নাছিমা আক্তারের চোখ পানিতে টলমল হয়ে উঠে। একমাত্র ছেলেটি নেই, তা যেন ভাবতে পারেন না তিনি। ঘরে থাকা ছেলের বই-খাতা, জামাকাপড়, জুতা সবকিছুই যত্নে সাজিয়ে রেখেছেন। এসব নিয়েই দিন কাটে তাঁর।

গত বছরের ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাদ আল আফনান (১৯)। ওই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে পুরো লক্ষ্মীপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে নিহত হন ৪ শিক্ষার্থীসহ ১২ জন, আহত হন শতাধিক ব্যক্তি। টানা ছয় ঘণ্টা ধরে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করেন তৎকালীন সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সালাহ উদ্দিনসহ তাঁর বাহিনী।

নিহত আফনান লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি লক্ষ্মীপুর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। আফনান নিহত হওয়ার মাত্র দুই মাস আগেই অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয় নাছিমার স্বামী সালেহ আহমেদের। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেকে ঘিরেই ছিল নাছিমার জগৎ। তবে স্বামীর মৃত্যুশোক না কাটতেই হারাতে হয় ছেলেকেও।

ওর রুমটা আমি ঠিক আগের মতোই রাখি। ওর বইগুলো, ওর জামাটা, এমনকি ওর শেষ পরা স্যান্ডেলটাও। জানি, আমার ছেলেটা আর আসবে না, তবু মন মানে না, বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে।নাছিমা আক্তার, সাদ আল আফনানের মা

সম্প্রতি বাড়িতে গিয়ে কথা হয় নাছিমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, একাকী ঘরে ছেলের জামাকাপড়, বই খাতা নিয়ে বেশির ভাগ সময় কাটে তাঁর। ছেলের ব্যবহৃত জিনিসগুলো যত্নের সঙ্গে ঘরে সাজিয়ে রেখেছেন। ছেলে নেই, তা ভাবতে পারেন না তিনি। কাঁদতে কাঁদতে নাছিমা বলেন, ‘রাত হলে বুক ফেটে কান্না আসে। চোখে ঘুম আসে না। প্রতিদিন ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুতে হয়। ছেলের ছবিটা বুকে নিয়ে রাত কাটে’।

নাছিমা আরও বলেন, ‘ওর রুমটা আমি ঠিক আগের মতোই রাখি। ওর বইগুলো, ওর জামাটা, এমনকি ওর শেষ পরা স্যান্ডেলটাও। জানি, আমার ছেলেটা আর আসবে না, তবু মন মানে না, বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে।’

গত বছরের ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরে গুলিতে নিহত অন্য তিন শিক্ষার্থী হলেন মো. ওসমান পাটোয়ারী, কাইছার হোসেন ও সাব্বির হোসেন। হত্যাকারীদের বিচার হবে সেই আশায় রয়েছেন তাঁদের স্বজনেরা।

নিহত মো. ওসমান পাটোয়ারীর ভাই ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে হারিয়ে আম্মু এখনো ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। আমাদের প্রত্যাশা হত্যাকারীদের বিচার হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিচারের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি’।

নিহত সাব্বির হোসেনের বাবা আমির হোসেন বলেন, সন্তানকে এক মুহূর্তের জন্য তিনি ভুলতে পারেননি। সন্তানের হত্যাকারীরাই কেবল নয়, এর নির্দেশদাতাসহ জড়িত সবার বিচার দাবি করেন তিনি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত বছরের ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শহরের তেহমনী এলাকা থেকে তোলা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভিক্ষাবৃত্তি নয়, যেন পরিকল্পিত অভিযান!
  • ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের ওপর আদেশ এক দিন পেছাল
  • দেড় যুগেও গড়ে ওঠেনি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ
  • ভারতের ওপর শুল্ক আরো বৃদ্ধি করবেন ট্রাম্প
  • দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আসামিদের আপিল শুনানি চলছে
  • নালায় পড়ে নারীর মৃত্যু: দায়িত্বে অবহেলা তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি চেয়ে রিট
  • দুদকের মামলায় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক কারাগারে
  • গুলিতে নিহত ছেলের জামা-জুতা আগলে দিন কাটে নাছিমার
  • শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের একই আইনজীবী নিয়ে বার্গম্যানের প্রশ্ন