‘‘কলমের এক খোঁচায় দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেই বাদ দিয়ে দিলেন। যেন বাপের জমিদারি আর কি। খাজনা দেও নাই বাড়ি থেকে বের করে দিলাম। দল এরশাদ সাহেবের, আরে মিয়া আপনি বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কে? জন্মলগ্ন থেকে আছি আমরা। আপনি কোথায় ছিলেন। আমরা যখন জাতীয় পার্টি করি তখন আপনি ঘরে। তখন কোনো কারখানায় চাকরি করেছেন। বড় বড় কথা বলেন। আজেবাজে কথা বলবেন না।”

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে উদ্দেশ্য করে শনিবার (৯ আগস্ট) রাজধানীর গুলশানে ইমানুয়েল কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত পার্টির দশম জাতীয় কাউন্সিলে দলের কো চেয়ারম্যান ও সাবেকমন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশীদ এসব কথা বলেন।

এই কাউন্সিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে কাজী ফিরোজ বলেন, “জাতীয় পার্টিকে যে স্বৈরাচার বলে, তার কারণ রয়েছে। জন্মলগ্ন থেকে আমাদের গঠনতন্ত্রে একটা ধারা ছিল ২০ ক ধারা। এরশাদ সাহেবকে বলেছি, স্যার এটা উঠিয়ে দেন, আপনি ইচ্ছা করিয়া যাহা করিবেন তাহাই তো হইবে। এটা রাখার দরকার কি? কোনো দলের গঠনতন্ত্রে এমন ধারা নাই। কিন্তু তিনি সেটা বাদ দিলেন না। সেই স্বৈরতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক ধারা নিয়ে জাতীয় পার্টি জন্মলগ্ন থেকে জ্বলছে। জিএম কাদের যে ধারার অপব্যবহার করছেন। যার কারণে আজ কাউন্সিল হচ্ছে।”

আরো পড়ুন:

জাপাকে তিন কাজের পরামর্শ দিলেন জেপি মহাসচিব শেখ শহীদ

লেভেল প্লেয়িং ছাড়া নির্বাচনে যাওয়া হাত পা বেঁধে সাঁতার কাটার শামিল: জাপা

‘‘আমরা উত্তরোধিকার সূত্রে এই কালো আইন বহন করছি। আমাদের সভাপতি-মহাসচিবকে বলেছি, এই ধারা তুলতে হবে। হাওলাদার সাহেবও বলেছেন, তুলে দেওয়া হবে। তারা কথা রেখেছেন, এই ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। আপনারা ভাগ্যবান যে আজকে থেকে জাতীয় পার্টি এই বাজে ধারামুক্ত হইলো।” - ঘোষণা দেন কাজী ফিরোজ।

জিএম কাদেরকে জাতীয় বেইমান উল্লেখ করে দলটির সাবেক মহাসচিব বলেন, “সবাই সাক্ষী ১২ নভেম্বর আমাদের একটা বর্ধিত সভা হয়েছিল, ৫৮ জেলার নেতা বক্তব্য রাখলেন, তারা বললো,  এই নির্বাচনে যাবেন না, যাবেন না। যারা যাবেন তারাই জাতীয় বেইমান। উনি বললেন, আপনারা আমার উপর ভরসা রাখেন, আমি জাতীয় বেইমান হবো না। পরে কি দেখা গেলো তিনি নির্বাচনে গিয়ে জাতীয় বেইমান হলেন। আজকে যে মানুষ আমাদের দোসর বলে, বেইমান বলে, দালাল বলে আপনার আর আপনার বউ এর এসব অপকর্মের জন্যই বলেন।”

ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, মুজিবুল হক চুন্নু, কাজী ফিরোজ রশীদদের দলের অভিজ্ঞ ও পরীক্ষিত নেতৃত্ব উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, ব্যারিস্টার আনিসসহ বর্তমান নেতৃত্ব শান্তিপ্রিয় মানুষ। তারা বহিস্কার-আবিস্কার করবেন না। কাজের মূল্যায়ণ করবেন। নেতাকর্মীরা যে যেভাবে কাজ করতে চান করতে পারবেন।”

তিনি বলেন, “কথা হবে একটা, এত কথা বাড়ায়ে লাভ নেই। ওয়ান ইলেভেনের সময় এরশাদ সাহেব জাতীয় পার্টির দায়িত্ব আনিস সাহেবকে দিয়ে গেছিলেন, উনি দুবছর দায়িত্বও পালন করেছেন। এ দুবছরে আমরা যারা নেতাকর্মী আমরা ঠিকমতো কাজ করতে পেরেছি।”

“আমি মনে করি, সামনে মঞ্চে যে নেতৃত্ব আছে, সারাদেশ থেকে যে নেতাকর্মীরা এসেছেন আমরা সবাই যদি পাড়া-মহল্লায় ওয়ার্ড এ এরশাদের কাজ-অবদান নিয়ে ফেরিওয়ালার মতো ঘুরে বেড়াই তাহলে আমরা সফলকাম হবো”- বলেন, সাহিদুর রহমান টেপা।

জিএম কাদেরের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “তুই কেটা, চুন্নু, কাজী ফিরোজ বাবলাদের মতো নেতাকে বহিস্কার করে দেন। যখন তখন সই করে ত্যাগি নেতাদের বের করে দেন।”

“জিএম কাদেরের একনায়কতন্ত্রের সই এর জন্য আমরা জাতীয় পার্টি করি নাই। আমার সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে, আমি বলেছিলাম, এই নির্বাচনে যাবেন না। তিনি বলেছিলেন, (যদিও আমার এই কথা বলা উচিত হবে না।) তুমি কি রাজনীতি বেশি বুঝ? আমি বলেছিলাম, শুক্র শুক্র আট দিন আগে রাজনীতিতে এসেছেন। আপনি ছিলেন ক্লার্ক।”

টেপা আরো বলেন, “আমি জন্মসূত্রে রাজনীতি করি। রাজনীতি আমার নেশা, পেশা না। আমরা রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। আমরা চার ভাই বীরমুক্তিযোদ্ধা। দেশকে স্বাধীন করেছি চার ভাই কাধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি। তাই আমি মনে করি, রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকা উচিত। তাহলে দেশ, জাতি ও নেতাকর্মীদের জন্য সঠিক রাজনীতি করা সম্ভব হবে।”

সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, “দেশ জাতি ও সকল ধর্মের উন্নয়নের রূপকার এরশাদ। যিনি ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, শুক্রবারে ছুটি, মসজিদ মাদ্রাসার খেদমত করেছেন। জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী মিশনে সৈন্য পাঠিয়ে বিশ্বদরবারে দেশের মান উজ্জ্বল করেছিলেন, তাকে বলেন আপনারা স্বৈরাচার। অথচ আপনারা হলেন এখন একহাজার পার্সেন্ট স্বৈরাচার।”

তিনি বলেন, “সাবেক সফলমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিস, হাওলাদার, চুন্নুর নেতৃত্বে আজকের থেকে তিনমাসের মধ্যে সারাদেশ চষে বেড়িয়ে সকলকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে আমরা শক্তিশালী জাতীয় পার্টি গড়ে তুলবো।”

শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, “মঞ্চে বক্তারা বলে গেছেন, আমরা সবাই যদি ঐক্যবদ্ধ হই তাহলে যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটাতে পারি। আজকে দেখেন, ৯০ এ এরশাদ সাহেবের মুক্তি হয়েছিল, এই মঞ্জু সাহেবের নেতৃত্বে। শুধু এরশাদকে মুক্ত করেননি জাপাকে ৩৫টি আসনে নির্বাচিত হয়েছি। বাংলাদেশে আর কোনো সময় জাপা এত আসন পাইনি। ৯৬ এ ৩৪টি আসন, এই মঞ্জু ভাইর নেতৃত্বে। তারপর আর উল্লেখযোগ্য আসন পাইনি। নেতৃত্বের কারণে হয়েছে, তিনি যতদিন ছিলেন জাতীয় পার্টির যৌবন ছিল। দলের অবস্থাও ভালো ছিল, জনগণের কাছে মূল্যায়নও ছিল, পরীক্ষিতও ছিলাম।”

নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আপনারা দলের প্রাণ, আপনাদের নেতৃত্বে এরশাদের অসমাপ্ত কাজ যেন করতে পারি। আপনারা চাইলে জাতীয় পার্টি একটা সুন্দর ও সম্মানজনক জায়গা যেতে পারে।”

‘‘আজকে ছাত্ররা বলে স্বৈরাচারের দোসর, আরে বাবা স্বৈরাচারের দোসর আমরা তো না। নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াত সবাই ছিল কমবেশি। আমরা বিরোধী দলে ছিলাম উপায় ছিল না, কথা না শুনলে প্রবলেম হতো। নানা কারণে আমরা এই সরকারের সাথে ছিলাম”- যোগ করেন তিনি।

সেন্টু বলেন, “আমাদের স্বৈরাচার বলা হতো, অথচ দিনের ভোট রাতে করে আওয়ামী লীগ আমাদের ছাড়িয়ে গেছেন। আমাদের হাতে রক্তের গন্ধ ছিল না, কাদের হাতে ছিল দেশ ও জাতি দেখেছে।”

প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনী আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।

প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির (জেপির) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম।

স্বাগত বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। 

দলের যুগ্ম মহাসচিব বেলাল হোসেন, ফখরুল আহসান শাহজাদা ও দপ্তর সম্পাদক রাজ্জাক খানের পরিচালনায় কাউন্সিলে বক্তব্য রাখেন, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা, এটিইউ তাজ রহমান, সোলায়মান আলম শেঠ, নাসরিন জাহান রতনা, নাজমা আকতার, লিয়াকত হোসেন খোকা, মোস্তফা আল মাহমুদ, মাসরুর মওলা, জহিরুল ইসলাম জহির, জসিম উদ্দিন ভূইয়া, আরিফুর রহমানখান, নুরুল ইসলাম মিলন, জিয়াউল হক মৃধা, মোবারক হোসেন আজাদ, খান ইসরাফিল খোকনসহ দলটির অধিকাংশ সিনিয়র নেতা  ও বিভিন্ন জেলা কমিটির সভাপতি সাধারণ সম্পাদকরা।

কাউন্সিলে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য, দিদারুল আলম দিদার বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির(মতিন) মহাসচিব জাফর আহমেদ জয় প্রমুখ।

এ সময় সারাদেশ থেকে আগত কাউন্সিলরদের পাশাপাশি প্রায় তিন হাজারের অধিক ডেলিগেট কাউন্সিলে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সকালে জাতীয় ও দলীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে কাউন্সিলের উদ্বোধন করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ফিরোজ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর এরশ দ স হ ব জ এম ক দ র ল ইসল ম ম ক উন স ল ন ত কর ম র রহম ন র জন ত আম দ র ব র কর আপন র সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

জাহানারা ইমাম সংগ্রহের বই সম্পর্কিত বিতর্ক, বাংলা একাডেমি যা জানাল

পরিত্যক্ত বইয়ের ভান্ডারে জাহানারা ইমামের বই থাকার বিষয়ে একাডেমির কর্মকর্তারা জানতেন না বলে জানিয়েছে বাংলা একাডেমি।

রবিবার (৯ নভেম্বর) বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে একাডেমি জানায়, দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে ৮ নভেম্বর ‘জাহানারা ইমামের দেওয়া বই বিক্রি করেছে বাংলা একাডেমি, এখন দাম হাঁকা হচ্ছে লাখ টাকা'- শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে কিছু আংশিক সত্য উপস্থাপন করা হয়েছে, কিছু অংশ এমনভাবে হাইলাইট করা হয়েছে, যাতে প্রতিবেদনে অন্যরকম উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও পাঠক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়বেন।

আরো পড়ুন:

নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট হওয়ার পরই বইমেলার তারিখ ঘোষণা

বাংলা একাডেমিতে আল মাহমুদ লেখক কর্নার চালু

বলা হয়, অনলাইনে বিভ্রান্তিকর শিরোনাম এবং হাইলাইটস ব্যাপকভাবে টেমপ্লেট আকারে প্রচারিত হয়েছে। অন্য অনেকেই একই ধরনের হাইলাইট ব্যবহার করে সংবাদ প্রচার করেছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বভাবতই এ স্পর্শকাতর বিষয়ে বহুজন নিজেদের মতামত প্রকাশ করেছেন।

আরো বলা হয়েছে, বহুজনের মনোযোগের বিষয় হয়ে ওঠার কারণে আমরা শুধু সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় বাংলা একাডেমির বক্তব্য না পাঠিয়ে সাধারণ বিবৃতি আকারে প্রদান করছি। আশা করি, সংশ্লিষ্ট পত্রিকা বিষয়টি যথাযথভাবে উপস্থাপন করবে, এবং অন্যরাও বিষয়টি সম্পর্কে পুনর্মূল্যায়ন করতে পারবেন। প্রয়োজনে প্রকৃত তথ্য-উপাত্তসহ সংবাদ পরিবেশনেরও সুযোগ তৈরি হবে।

প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাংলা একাডেমি গত ২৫/৬/২৫ থেকে ২৩/১০/২৫ তারিখে পরিত্যক্ত হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে মজুতকৃত কয়েক হাজার বই ও অন্য কাগজপত্র বিধিমোতাবেক নিলামে বিক্রি করে। এর মধ্যে আছে বইমেলায় জমা হওয়া বিপুলসংখ্যক বই, যে বইগুলো প্রতি বছর কমিটির মাধ্যমে বাছাইকৃত হয়ে মানহীন ও পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়; আছে গ্রন্থাগারের যে বইগুলো ব্যবহার-অযোগ্য ঘোষিত হয় সেগুলো; এবং বাংলা একাডেমির নিজস্ব প্রকাশনার যেসব বই নানা কারণে বিক্রয়-অযোগ্য হয়ে ওঠে সেগুলো।

এ ধরনের বইপুস্তক বহুদিন ধরে গ্রন্থাগার-সংলগ্ন একটি ঘরে গুদামজাত করা হয়। এটি পরিত্যক্ত বইয়ের গুদাম। এখানকার বইগুলোই সম্প্রতি নিলামে বিক্রি করা হয়েছে।

বলা হয়, এসব বই এখন বিক্রি করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে এজন্য যে, এ ঘরটি সম্পূর্ণ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। আগামী মেলায় প্রাপ্ত বই এবং অন্যসব কারণে পরিত্যক্ত হওয়া সম্ভাব্য বই রাখার কোনো জায়গা ওই ঘরে আর অবশিষ্ট ছিল না। ফলে ঘর খালি করার প্রয়োজন হয়েছিল। বিক্রির আগে গ্রন্থাগার ও সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হয়েছিল। তারা নিশ্চিত করেছে যে, এগুলো বহু বছর ধরে জমা হওয়া পরিত্যক্ত বই।

আরো বলা হয়, এখন প্রশ্ন, বাংলা একাডেমি কি জাহানারা ইমাম, আহমদ শরীফ, মুক্তাগাছা সংগ্রহ বা অন্য কোনো তালিকার বই বিক্রি করেছে? আসলে এ ধরনের কিছুই ঘটেনি। কয়েক বছর আগে থেকে জাহানারা ইমামসহ অন্যদের দেওয়া বইগুলো যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবেই আছে।

এ বিষয়ে কোনো নতুন কমিটি গঠিত হয়নি, বা সংগ্রহশালা পুনর্মূল্যায়নের কোনো ঘটনাও ঘটেনি। অন্তত এক দশক ধরে জমা হওয়া পরিত্যক্ত বইগুলোই কেবল বিক্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরে নতুন যুক্ত হয়েছে কেবল গত বছরের বইমেলায় প্রাপ্ত মানহীন ও পরিত্যক্ত ঘোষিত বইগুলো।

বিবৃতিতে বলা হয়, বর্তমান বিতর্কের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটি হলো, তাহলে এ তালিকায় জাহানারা ইমাম সংগ্রহের বেশ কিছু বই কীভাবে যুক্ত হয়েছে? ২০১৪ সালে ‘বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগার পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত কমিটি' গঠিত হয়। এ কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৩. ০১. ২০১৪ তারিখ সোমবার বিকাল ৫টায়।

বলা হয়, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন শামসুজ্জামান খান, অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ, অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, ফরিদা পারভীন, রেজিনা আক্তার ও মো. মোবারক হোসেন। সভায় একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে সে অনুযায়ী গ্রন্থাগার থেকে কিছু বই ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এজন্য মো. মোবারক হোসেন,অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ, সুব্রত বড়ুয়া, বিশ্বজিৎ ঘোষ ও রেজিনা আক্তারের সমন্বয়ে একটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি দীর্ঘদিন ধরে অনেকগুলো সভা করেছে এবং কোন বইগুলো গ্রন্থাগারে থাকবে না তা নির্ধারণ করেছে।

আরো বলা হয়, বাংলা একাডেমিতে রক্ষিত তালিকা থেকে দেখা যায়, পরিবারের পক্ষ থেকে জাহানারা ইমামের মোট ৩৫৯টি বই দেওয়া হয়েছিল। বাছাইয়ের পরে অধিকাংশ বই সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট হয়।

‘বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগারে সংরক্ষণার্থে গ্রন্থ বাছাই কমিটির বাছাইকৃত গ্রহণযোগ্য বইয়ের তালিকা (জাহানারা ইমাম)'- প্রণয়ন করা হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। ওই বইগুলো বাংলা একাডেমির নির্দিষ্ট সেলফে মজুত আছে। সেখানে বইয়ের সংখ্যা ৩০৮টি। তিন তলার নির্ধারিত স্থানে যে কেউ বইগুলো দেখতে এবং ব্যবহার করতে পারবেন।

বাংলা একাডেমি জানায়, জাহানারা ইমামসহ অন্য সংগ্রহের যেসব বই গ্রন্থাগারের জন্য উপযোগী বিবেচিত হয়নি, সেগুলো আলাদা করে আর্কাইভ করা যেত। কিন্তু এ ধরনের পরিকল্পনা তখনকার দায়িত্বশীলরা কেন করেননি তা এখন অনুমান করা কঠিন।

তখন একাডেমি-প্রশাসনের প্রধান পদগুলোতে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই গত হয়েছেন; অন্যরাও এখন আর একাডেমিতে কর্মরত নেই। তখন গ্রন্থাগারের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারাও কেউ নেই। ফলে এই পরিত্যক্ত বইয়ের ভান্ডারে জাহানারা ইমাম সংগ্রহের কোনো বই তো দূরের কথা, কোনো ব্যবহার্য বই থাকতে পারে এমন দূরতম অনুমান করারও বাস্তবতা ছিল না।

তারা জানায়, বাংলা একাডেমির বর্তমান দায়িত্বরতদের সম্পর্কে বলা যায়, বইগুলো বিক্রির আগে আরেকবার পরীক্ষা করা যেত। কিন্তু বইয়ের সংখ্যা ছিল আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার। তদুপরি, গুরুত্বপূর্ণ কোনো বই এখানে থাকতে পারে, এমন সম্ভাবনাও সংশ্লিষ্ট কারো অভিজ্ঞতায় ছিল না।

আরে বলা হয়, এমতাবস্থায়, প্রথম আলোর প্রতিবেদক সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাংবাদিকতার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ প্রতিবেদকের সাথে আমার বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। তাকে পুরো বিষয়টি অনেকবার বলা হয়েছে। তবু তিনি এমন শিরোনাম করেছেন, যাতে মনে হবে, জাহানারা ইমামের বই আলাদা করে অথবা শনাক্ত করে অথবা ইচ্ছা করে বিক্রি করা হয়েছে, এবং কাজটা করেছে বর্তমান প্রশাসন।

বলা হয়, তিনি লিখেছেন, ‘বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম অবশ্য বলছেন, ২০১৪ সালে গঠিত একটি কমিটি একাডেমির সংগ্রহশালায় একাধিক কপি থাকা এবং অসংরক্ষণযোগ্য কিছু বই বাতিল বলে নির্ধারণ করেছিল, সেগুলোই বিক্রি করা হয়েছে।' এ বাক্য পড়লে যে কারো মনে হবে, বইগুলো আলাদা করে রাখা ছিল। মোটেই তা নয়। বইগুলো বহু বছর আগে থেকেই কয়েক হাজার বইয়ের পরিত্যক্ত মজুতের সাথে রাখা ছিল, এবং সে তথ্য এখন কর্মরত একাডেমির কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে ছিল না।

বিবৃতিতে বলা হয়, একই ভঙ্গি অক্ষুণ্ন রেখে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাড়তি কিংবা অসংরক্ষণযোগ্য বই বিক্রির যুক্তি বাংলা একাডেমি দিলেও এক্ষেত্রে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের নীতি পরিপন্থি কাজ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশে এবং বিদেশে গ্রন্থাগার পরিচালনার কাজে যুক্ত থাকা বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী। তিনি বলছেন, বিশিষ্ট ব্যক্তির সংগ্রহশালার বই এভাবে বিক্রি করা ‘স্পষ্ট অন্যায়’।

বলা হয়, বাংলা একাডেমি আসলে ‘বাড়তি কিংবা অসংরক্ষণযোগ্য বই বিক্রির যুক্তি' দেয়নি, প্রায় এক যুগ আগে সংঘটিত একটা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে কেবল। যেখানে বইগুলো চিহ্নিতই ছিল না, সেখানে ‘স্পষ্ট অন্যায়'টা কার, তা স্পষ্ট না করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন জাহানারা ইমামের বইগুলোই বিক্রি করা হয়েছে।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, তার (প্রথম আলোর প্রতিবেদকের) অসঙ্গত মনোভাব এবং উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েছে প্রতিবেদনের এ অংশে: ‘বাংলা একাডেমির নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় জাহানারা ইমামসহ কয়েকজনের ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ এখনো আছে। সেখানে আলমারির ওপর নাম লিখে রাখা আছে, কার সংগ্রহ কোনটি। তার কিছু বই–ই বিক্রি করা হয়েছে।' এ অংশ, বিশেষত শেষ লাইনটি পড়লে যে কারো মনে হবে, আলমারিতে রাখা বইগুলো থেকে কিছু বই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা উপরে ব্যাখ্যা করেছি যে, ঘটনা এর ধারে কাছেও কিছু নয়।

বাংলা একাডেমি জানায়, প্রতিবেদক ছাঁটাই কমিটি সম্পর্কেও মনগড়া তথ্য দিয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগার বিভাগের ছিল বলে জানান ওই উপ-কমিটির সদস্য রেজিনা আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোন বইটি বাতিল করা হবে বা সংরক্ষণযোগ্য না, সে সিদ্ধান্ত নেয় গ্রন্থাগার বিভাগ।’

বলা হয়, আসলে যাচাই-বাছাই না করে স্রেফ একজন সদস্যের কথার ভিত্তিতে এখানে যা বলা হয়েছে, তা মোটেই সত্য নয়। আমি এখানে ১৭/৭/২০১৪ তারিখ বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় অনুষ্ঠিত ছাঁটাই উপকমিটির ষষ্ঠ সভার উপস্থিতিপত্র যোগ করছি। কমিটি গঠিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে এতগুলো সভায় সদস্যরা বই বাছাইয়ের কাজ করেছিলেন বলে গ্রন্থাগারের তখনকার কর্মী এবং ছাঁটাই কমিটির একজন সদস্য নিশ্চিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এ কমিটি পরে আরও বহুদিন কাজ করেছেন। যদি তারা বই বাছাইয়ের কাজই না করবেন, তাহলে এতগুলো সভা কেন হলো?

বিবৃতিতে বলা হয়, আমি এ প্রতিবেদককে ২০১৪ সালে গঠিত কমিটির রিপোর্টসহ আরো লিখিত তথ্য দিয়েছি। এবং অনুরোধ করেছি, তিনি যেন সরেজমিন ব্যাপারটা দেখেন এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি জানিয়েছেন, তার এত সময় নেই। স্পষ্টতই খুব স্পর্শকাতর একটি ইস্যুকে পুঁজি করে ‘ভাইরাল' প্রতিবেদন প্রণয়নই ছিল তার উদ্দেশ্য।

তার অন্যতম প্রমাণ এই যে, আহমদ শরীফ, সিকান্দার আবু জাফরসহ আরও কয়েকজনের বই পাওয়া গেলেও তিনি সে তথ্যটিকে উচ্চকিত হতে দেননি।

বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা সংবাদমাধ্যম এবং আগ্রহী সবাইকে অনুরোধ করব, তারা যেন বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারে এসে সংগ্রহশালা দেখেন। তাহলেই বোঝা যাবে, বহু বছর আগে এ সংগ্রহশালার যে তালিকা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, তা অক্ষত আছে।

জাহানারা ইমামসহ আমাদের দেশের শ্রদ্ধেয় মানুষদের বেশ কিছু বই বাংলা একাডেমির সিলসহ নীলক্ষেতে কিংবা অনলাইন প্লাটফর্মে বিক্রি হচ্ছে-এ ঘটনায় নিঃসন্দেহে বাংলা একাডেমির দায় আছে। কিন্তু বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা দায় কৌশলে বহুগুণ বাড়িয়ে বর্তমান প্রশাসনের ওপর বর্তানো নিশ্চয়ই সুরুচির পরিচয় নয়, সাংবাদিকতার তো নয়ই।

ঢাকা/রায়হান/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ