আবাসন খাতে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের (বিএইচবিএফসি) ঋণের চাহিদা বাড়ছে। এ খাতে ঋণদানকারী রাষ্ট্রীয় বিশেষায়িত একমাত্র সংস্থা বিএইচবিএফসি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় ঋণের সুদের হার কম হওয়ায় গৃহঋণ নিতে আগ্রহীরা এ সংস্থায় বেশি ঝুঁকছেন। কিন্তু তহবিলসংকটে সংস্থাটি সন্তোষজনক মাত্রায় ঋণ দিতে পারছে না।
বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদেরও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গৃহঋণ দিতে পারছে না বিএইচবিএফসি। এমন বাস্তবতায় আবাসন খাতে ঋণ বাড়াতে বিএইচবিএফসি সরকারের কাছে এক হাজার কোটি টাকার ঋণসহায়তা চেয়েছে। গত ২৬ জুন অনুষ্ঠিত সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় ৩ শতাংশ সুদে ২০ বছর মেয়াদে সরকার থেকে এ ঋণ চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। গত ২৪ জুলাই সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো.
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিঠি এসেছে। আবাসন খাতে বিএইচবিএফসির ঋণের চাহিদা যে বাড়ছে, এটাও ঠিক। সংস্থাটিকে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে কাজ চলছে। সম্প্রতি আমরা এ ব্যাপারে অর্থ বিভাগের মতামত চেয়েছি। দেখা যাক।’
সাত দশকের বেশি সময় ধরে সুপরিকল্পিত আবাসন বিনির্মাণে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ঋণ দিয়ে আসছে বিএইচবিএফসি। সবার জন্য আবাসন, এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ৭৩টি শাখা কার্যালয়ের মাধ্যমে এ ঋণ দেওয়া হচ্ছে। দেশের নগর ও মহানগর অঞ্চলের বাইরে সব উপজেলা এবং গুরুত্বপূর্ণ গ্রোথ সেন্টারগুলোতে সম্প্রসারণ করা হয়েছে এ ঋণ কার্যক্রম।
ঋণ পাওয়ার যুক্তি হিসেবে সংস্থাটি কিছু তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে। জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৪৬ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করে ঋণ দিয়েছে ৬৯৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ হাজার ২৮৯ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করে দিয়েছে ৯১৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করে দিয়েছে ৯২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে টাকার অভাবে ৪১২ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করতে পারেনি সংস্থাটি।
অর্থসংকট কাটাতে ৩ শতাংশ সুদে ২০ বছর মেয়াদে সরকারের কাছে এক হাজার কোটি টাকা চেয়েছে সংস্থাটি।মোট তহবিল কতবিএইচবিএফসি সরকারকে জানিয়েছে, ১৯৫২ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো ঋণ অবলোপন করেনি সংস্থাটি। সংস্থাটি কোনো ঋণ মওকুফও করেনি। খেলাপি ঋণের হার ২৫ শতাংশ থেকে কমে নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে। সংস্থাটির কোনো প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি নেই। প্রচলিত ঋণের পাশাপাশি শরিয়াহভিত্তিক ঋণসুবিধাও রয়েছে সংস্থাটির। বিএইচবিএফসি থেকে ঋণ নিলে তা ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে পরিশোধের সুযোগ রয়েছে।
সংস্থাটি এর তহবিলের মোট স্থিতিও জানিয়েছে। এ পর্যন্ত ছয়টি খাতে মোট তহবিল পেয়েছে ৪ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিশোধিত মূলধন হচ্ছে ১১৫ কোটি টাকা। বাকি তহবিলের মধ্যে ঋণপত্র (ডিবেঞ্চার) বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করা অর্থই বেশি, যার পরিমাণ ১ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইএসডিবি) প্রথম পর্যায়ে ৯২৮ কোটি ৩০ লাখ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৭০০ কোটি টাকা দিয়েছে। সরকারি ঋণ রয়েছে ৮২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং স্থায়ী আমানত রয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। মোট তহবিলের মধ্যে স্থিতি বা ব্যালান্সের পরিমাণ বর্তমানে ২ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা।
যেসব উৎস থেকে তহবিল পেয়েছে সংস্থাটি, তাদের কোনো কিস্তি বকেয়া নেই। এগুলোর সুদের হার ২ থেকে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত। সুদ ও আসল মিলিয়ে ঋণদাতা সংস্থাগুলোকে তিন অর্থবছরে সংস্থাটি ৩২৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।
লভ্যাংশ পাচ্ছে সরকারঋণ আবেদনের পর বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে এক পর্যায়ে ঋণ মঞ্জুর করে বিএইচবিএফসি। দেড় বছর আগে যেসব ঋণ আবেদন মঞ্জুর হয়েছে, তার মধ্যে গত মার্চ পর্যন্ত অনেকে ঋণ পাননি। এর মধ্যে সাধারণ ঋণ রয়েছে ৩৩৪ কোটি টাকা আর সরকারি কর্মচারীদের গৃহঋণ রয়েছে ৫০ কোটি টাকা।
সংস্থাটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানিয়েছে, ঋণ প্রস্তাব মঞ্জুর করার পরও ঋণের চেক দেওয়া যাচ্ছে না নগদ তহবিলের চরম সংকটের কারণে। এতে গ্রাহক অসন্তোষ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরে কর–পরবর্তী মুনাফা থেকে সরকারকে লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মুনাফা থেকেও ৫০ কোটি টাকার লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়, যা বর্তমান সংকটকে আরও নাজুক করে তুলেছে।
বিএইচবিএফসির এমডি মো. আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যুক্তি তুলে ধরে সরকারের কাছে এক হাজার কোটি টাকার তহবিল চেয়েছি। আশা করছি, সরকার তা ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ট ক র ঋণ তহব ল র পর য য় সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
স্বস্তিতে বিদ্যুৎ, সংকটে গ্যাস সরবরাহ
বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত নিয়ে দুর্নীতি-অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ ছিল গত সরকারের সময়ে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদন বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে অন্তত ৬০০ কোটি ডলার নয়ছয় হয়েছে। এ দুর্নীতির বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি এক বছরে। আদানি, রামপালসহ বিতর্কিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি বাতিল বা সংশোধনে কমিটি করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে খরচ কমিয়ে সাশ্রয়ে জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সাশ্রয় করেছে তারা। তারপরও বিদ্যুৎ-গ্যাস খাতে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ভর্তুকি গেছে গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫)। গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। এবার লোডশেডিং করতে হয়নি। চাহিদাও কিছুটা কম ছিল। বিদ্যুৎ খাত অনেকটা স্বস্তিতে ছিল। তবে টানা সংকট ছিল গ্যাস সরবরাহে। শিল্পে নতুন সংযোগ বন্ধ আছে আট মাস ধরে।
গত সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সবচেয়ে বেশি ভুগেছে বকেয়া বিল পরিশোধের চাপে। এতে সরবরাহ ধরে রাখতে পারেনি। টানা তিন বছর লোডশেডিং করতে হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নেয়। শুরুতেই জ্বালানি তেল আমদানির বিদেশি কোম্পানির ৫০ কোটি ডলারের বকেয়া শোধ করা হয়। গ্যাস খাতে ৭৫ কোটি ডলার বকেয়া রেখে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। গত এপ্রিলে সব বকেয়া শোধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিদ্যুৎ খাতের বকেয়াও অনেকটা শোধ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমস্যা এক বছরে সমাধানের মতো নয়। গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। চাইলেই চট করে গ্যাস সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতবিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০ নিয়ে। এ আইনে বলা হয়, এর অধীন নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে যাওয়া যাবে না। এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। বিগত সরকার এ আইনের মেয়াদ বারবার বাড়িয়ে দরপত্র ছাড়া একের পর এক চুক্তি করেছে। এসব চুক্তি বাতিলের দাবি ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৮ নভেম্বর অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইনটি রহিত করেছে। তবে এ আইনের অধীন করা সব চুক্তি বলবৎ রেখেছে। বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বেশি আপত্তি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া নিয়ে, যা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিচিত। এক বছরে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া কমানোর দৃষ্টান্ত নেই।
অবশ্য বিশেষ আইনের অধীন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় ৫ সেপ্টেম্বর একটি কমিটি করে দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটি এখনো কাজ করছে। তাদের পরামর্শে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনায় আরেকটি কমিটি করা হয়েছে গত ২১ জানুয়ারি। এখন পর্যন্ত কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ কমানোর সমঝোতা হয়নি।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীন ৩৭টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সম্মতিপত্র দিয়েছিল গত সরকার। এগুলো বাতিল করে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে সামিটের সঙ্গে চুক্তি করে গিয়েছিল গত সরকার। এটিও বাতিল করা হয়েছে। আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে টার্ম শিট সই হয়েছিল, সেটিও বাতিল করা হয়েছে। এস আলম গ্রুপের বিনিয়োগে জ্বালানি তেল পরিশোধনের প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার, এটিও বাতিল করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। বিগত সরকার আইন সংশোধন করে দাম নির্ধারণের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে নেয়। এরপর কয়েক দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায় নির্বাহী আদেশে। অন্তর্বর্তী সরকার দাম নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে। এরপর শিল্পে গ্যাসের দাম এক দফা বাড়ানো হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা এখনো জ্বালানি বিভাগের হাতে রয়ে গেছে। প্রতি মাসে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে।
গ্যাস নিয়ে সংকটগ্যাসের সরবরাহ নিয়ে বিপাকে আছে সরকার। দেশি গ্যাসের উৎপাদন টানা কমছে। নতুন নতুন কূপ খনন করে উৎপাদন ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সরবরাহ বাড়াতে এলএনজি আমদানি বাড়ানো হচ্ছে। তবু চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। নতুন গ্যাস আবিষ্কারে গতিশীল কোনো কার্যক্রম নেই। গত দেড় দশকেও সমুদ্রে গ্যাস আবিষ্কার করা যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের সবশেষ দরপত্রে কোনো কোম্পানি অংশ নেয়নি। সমুদ্রে অনুসন্ধানে থাকা একমাত্র কোম্পানি ভারতের ওএনজিসি চলে যাচ্ছে। তার মানে আগামী কয়েক বছরেও সমুদ্রে গ্যাসের সম্ভাবনা নেই। দরপত্র আহ্বান করতে নতুন উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) করা হচ্ছে। স্থলভাগেও গ্যাস অনুসন্ধানে একটি পিএসসি তৈরি করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমস্যা এক বছরে সমাধানের মতো নয়। গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু চাইলেই চট করে গ্যাস সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়তেও অন্তত তিন বছর সময় দরকার। তবু সর্বোচ্চ এলএনজি আমদানি করে শিল্পে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হয়েছে। গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, বির্তকিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিল বা সংশোধন, আদানির সঙ্গে বিরোধ—এসব বিষয়ে ফাওজুল কবির খান বলেন, এসব বিষয়ে অগ্রগতি আছে। কমিটি কাজ করছে। চুক্তি সংশোধন করে বিদ্যুতের দাম কমাতে আলোচনা চলছে। আদানির সঙ্গেও আলোচনায় অগ্রগতি আছে। চূড়ান্ত ফল না আসায় প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। তবে ভেতরে–ভেতরে অনেক কাজ চলছে। একটু সময় লাগবে।
খরচ কমিয়ে সাশ্রয়ে নজরবিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ আছে। গত সরকার তাই দফায় দফায় দাম বাড়িয়েছিল। খরচ কমাতে সাশ্রয়ে নজর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের এক বছরের সাফল্য নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগ আলাদা করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে খরচ কমানোর তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আমদানি ও কেনাকাটার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এনে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন খাতে খরচ কমানো হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, বিশেষ বিধান বাতিল করে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে এলএনজি কেনায় ৩০২ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। চলতি অর্থবছরে আরও ব্যাপক সাশ্রয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জ্বালানি তেল আমদানিতে আগের বছরের চেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সাত হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে। কাফকো সার কারখানা ও লাফার্জ সিমেন্টের সঙ্গে নতুন করে গ্যাস বিক্রয় চুক্তি করায় বছরে এক হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় হবে। সিস্টেম লস কমানোয় ২১৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বেড়েছে। শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোয় ৯৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটা ঠিক, সরকারের উদ্যোগে প্রতিযোগিতা বাড়ায় খরচ কমেছে অনেক ক্ষেত্রে। তবে খরচ কমাতে বৈশ্বিক পরিস্থিতিও ভূমিকা রেখেছে। আগের বছরের তুলনায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম কম ছিল গত এক বছর। এ ছাড়া গত বছর বিশ্বে জ্বালানি পরিবহনের জাহাজভাড়া কমেছে।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, দেশি গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে ১৫০টি কূপ সংস্কার ও খননের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নতুন তিনটি রিগ কিনে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৯টি কূপের কাজ শেষে দিনে ৮ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস খাতের ১০টি প্রকল্পের খরচ কমিয়ে ৩২৮ কোটি টাকা সাশ্রয় খরচ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদন বলছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি তেল আমদানির সার্ভিস চার্জ ৪ শতাংশ কমানোয় ৪৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। প্রতি জাহাজে ১৫ হাজার টনের বদলে ২০ হাজার টন তেল আমদানি নির্ধারণ করায় ৩৫৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিটের দাম ৮ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করায় বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ কমিয়ে ২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা সাশ্রয়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্থাপনা ভাড়া, বিলম্ব মাশুল (জরিমানা) আদায়সহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ৯ হাজার ২১০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
সাশ্রয়ের মধ্যেই বেড়েছে ভর্তুকিপেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে লোকসান শুরু হয় সংস্থাটির। প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। ২০১৮-১৯ সালে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। ওই বছর ভর্তুকি ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর এলএনজি আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তুকিও বাড়তে থাকে। গত অর্থবছরে তারা ভর্তুকি নিয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ভর্তুকি ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ খাতে গত অর্থবছরে ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। তারা নিয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এটি চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) কমে আসবে। তাই ৩৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটে। যদিও গত অর্থবছরে ১০ শতাংশ খরচ কমিয়ে ১১ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা সাশ্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল। গত বছরের আগস্ট থেকে গত মে পর্যন্ত দেড় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা গেছে। মেয়াদ শেষে ১০টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করায় ৫২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, গ্রীষ্মে পরিকল্পনা নিয়ে লোডশেডিংমুক্ত রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ বকেয়া ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বৈদেশিক বকেয়া শোধ করা হয়েছে ১৫ কোটি ২৬ লাখ ডলার। আদানির বকেয়া ৭ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা থেকে ২ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছে।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশের সরকারি ভবনের ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়ে এক থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। চারটি ধাপে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ৫৫টি স্থানে ৫ হাজার ২৩৮ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
তবে সরকারের এক বছরের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভোক্তাদের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে করণীয় স্পষ্টভাবে সরকারের নজরে আনা হয়েছে; কিন্তু সরকার তার ধারেকাছেও যায়নি। আগের সরকারের আমলে লুণ্ঠনের যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তার সুরক্ষা দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। জ্বালানি খাত সংস্কারে সুপারিশ, দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কিছুই করেনি সরকার।