আজকেও আকাশ অন্ধকার থাকতে বৃষ্টি মাথায় করে রওনা দিলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর বৃষ্টি থেমেও গেল। পথে দাঁড়ালে ফজরের আজান শুরু হলো। মালয়েশিয়াতে বেশ সুন্দর মসজিদ আছে! আরবের স্থাপত্যশৈলী এখানেও দেখা যায়। 

আজ বড় রাস্তায় চালানো শুরু হলো। তবে বেশ কিছু জায়গায় নুড়ি পাথর পেলাম। আমার রোড বাইকের চিকন চাকা নিয়ে প্রথম থেকেই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। মনে মনে যে ভয় ছিল তাই হলো, ভরদুপুরে চাকা লিক হয়ে গেল। টায়ার থেকে পুরোনো টিউব বের করে নতুন টিউবটা ভরলাম। আমার কাছে দেশ থেকে আনা একটা হ্যান্ড পাম্পার ছিল কিন্তু হাওয়া ভরা যাচ্ছে না। কিছুটা দূরে চঞ্চল আর মুনতাসীর বসে ছিল। সে পর্যন্ত সাইকেল ঠেলে নিয়ে এসে মুনতাসীর ভাইয়ের পাম্পার দিয়ে হাওয়া দিলাম। গরমে তখন ত্রাহি অবস্থা। বরফ দিয়ে লেবু পানি খেয়ে চলা শুরু করলাম। 

এখানে জুসগুলো বেশ সুপেয়। বারবার খেতে ইচ্ছে করে, দামেও সাশ্রয়ী। লম্বা হাইওয়ে দিয়ে আমাদের চলা শুরু। এই হাইওয়ে দিয়েই কুয়ালালামপুরের পথে যাব আমরা। বড় একটা ব্রিজ পেলাম ‘পেরাক নদীর’ উপর। সব দেশে নদী মনে হয় একই রকম, শুধু জলের রঙ সামান্য ভিন্ন। পরের ব্রিজে দেখলাম ‘সাঙ্গাই মানগুং’ নদী। তৃতীয় ব্রিজে উঠে দেখলাম ‘সানগান সিতিয়াওয়ান’ নদী। ম্যাপে নদীগুলোর নাম লেখা আছে। বেশ প্রশস্ত নদীগুলো। নানা আকারের নানা বর্ণের জাহাজ যাওয়া আসা করছে। আজকে ১১০কিলোমিটার চালিয়ে টপ গার্ডেন হোটেলে এসে উঠলাম। 

দেখতে দেখতে কতগুলো দিন পার করে ফেললাম। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল প্যাডেল দিয়ে যাচ্ছি। দারুণ সব জায়গা দেখছি, সঙ্গে কত বিচিত্র মানুষ! আজকের আবহাওয়া বেশ উত্তপ্ত। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বের হয়েছি। একটু চালিয়েই শরীর ভিজে গেছে। একটা গ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। রাস্তার পাশে ধান খেত, সেখান থেকে বাংলা কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। আমাদের দেশের ভাইয়েরা কাজ করছে। সাইকেলে পতাকা দেখে তাদের টনক নড়েছে। ‘বাংলাদেশ’ বলে কেউ একজন জোর গলায় চিৎকার দিলো। স্বদেশীয় না হলে আর কেই-বা পতাকা দেখে ডাক দেবে। 

গতকালের ভয়টা এখনো রয়েই গেলো। রাস্তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়েই পথ চলতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই পেছনের চাকা লিক হলো। গতকাল সামনের চাকার টিউব গেলো আজ পেছনের চাকা। কি হচ্ছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সামনে আর কোনো লিক হলে উপায় নেই। কারণ সঙ্গে করে লিক সারানোর প্যাচকিট আনা হয়নি। সাইড হয়ে চাকা খুলে বসলাম। টায়ার-টিউব খুলে সাবধানে অবশিষ্ট টিউবটা ভরছিলাম হঠাৎ কী মনে হলো মুনতাসীর ভাই পাম্পার নিয়ে সাইকেল চালানো শুরু করে দিলো। আমি আর চঞ্চল থ বনে গেলাম। এই মাঝপথে পাম্পার এখন সবচেয়ে জরুরি জিনিস। চঞ্চলের কাছে একটা চলনসই পাম্পার ছিল, তাই দিয়েই কাজ কোনোমতে চালিয়ে নিলাম। কিছু দূর যেতেই একটা বাসা খুঁজে পেলাম যেখানে অনেকগুলো সাইকেল ও মটরসাইকেল রয়েছে। পাম্পারের আশায় সেখানে থামলাম এবং পেয়েও গেলাম। 

পথে একবার আইসক্রিম ব্রেক নিলাম। এ সময় ডাবের পানি খেলাম। তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এইচ-৫ রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি, ডাবল লেন। একটা গাছ নেই যে একটু ছায়াতলে দাঁড়াব। কয়েক মাইল পরপর একটা ব্রিজ আর বাসস্টপ আছে। নতুন জিনিস লক্ষ্য করলাম এই ফুটওভার ব্রিজগুলোতে মানুষের সাথে মটরবাইকও রাস্তা পার হতে পারে। অর্থাৎ সিঁড়ি এবং রাস্তা দুরকম ব্যবস্থাই  আছে। 

দুপুরের খাবার খেতে থেমেছিলাম ‘তাঙ্গুং কারাং’ নামে এক জায়গায়। সেখানেও দেশী ভাইদের পেয়ে গেলাম। নাম সাব্বির হোসেন। বয়স ২২ বছর। সাত মাস এই রেস্টুরেন্টে কাজ করছে। সাত লাখ টাকা লোন করে মালয়েশিয়া এসেছে। একদিন দেরি করলেই বেতন কেটে রাখে। প্রবাসে এরা কত কষ্ট করে তা আমি আরবে থাকতেও দেখেছি। বাড়ির লোক হয়তো বুঝতেও পারে না বিদেশ বিভূঁইয়ে তাদের সন্তানেরা কি নিদারুণ কষ্ট করে চলেছে! এ কারণেই এদের বলা হয় রেমিটেন্স যোদ্ধা। 

৮০ কিলোমিটার চালিয়ে আজকের মতো পৌঁছে গেলাম ‘জালান শ্রি পেনাম্বাং’। ভিআই বুটিক হোটেল আমাদের এক রাতের জন্য রাজকীয় বলা চলে। চঞ্চল আর আমি কথা বলে একটা ভালো ডিলে তিন বেডের ডিলাক্স রুম নিয়েছি। বেশ বড় আর খোলামেলা। রুম দেখেই মনে হয়েছিল এখানে কয়েকদিন থেকে গেলে মন্দ হতো না। 

আমাদের যে চলার গতি, তাতে জলদি কুয়ালালামপুরে পৌঁছে যাবো ধারণা করেছিলাম। প্রথম দিকে কষ্টের তীব্রতা কয়েক দিন যেতে যেতে শরীরে সয়ে যায়। কিন্তু আমাদের শরীর যখন গতি পেয়েছে তখনই কুয়ালালামপুরের রাস্তাও ফুরিয়েছে। শহর যত কাছে আসা শুরু করেছে গেঞ্জাম ততো বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। শহরজুড়ে সাপের মতো এত দিকে রাস্তা চলে গেছে যে দিশেহারা হবার দশা! বারবার সাইকেল থামিয়ে ম্যাপ দেখতে হচ্ছে। এর মধ্যে টুইনটাওয়ারের মাথা নানা ফাকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে। যদিও আমরা ওদিকে যাব না। আমরা পিন পয়েন্ট করেছি জালান সুলতান রোড। এখানে মূলত ট্যুরিস্টদের আনাগোনা। তাই হোটেলও বেশি। দুপুর ১টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু হোটেল খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হলো। কারণ আমাদের সাইকেলসমেত কেউ জায়গা দিচ্ছে না। সাইকেল আমাদের রুমে রাখতে দেবে না, আবার গ্যারেজেও রাখার ব্যবস্থা নেই। সাইকেল নিয়ে বেশ কিছু হোটেলে কথা বললাম। এদিকে আমরা বেশ ক্লান্ত। ভোরে বের হয়ে ৪৬ কিলোমিটার চালিয়ে এসেছি। তার উপর উত্তাপময় আবহাওয়া। অনেক খুঁজে একটা হোটেল পেলাম। প্রতিরাত ভাড়া পড়বে ৩১০ রিঙ্গিত। আমাদের জন্য একটু বেশিই বলা চলে। টাকায় এক রাত প্রায় ৯ হাজার। তিন জনের আলাদা বিছানা। রুমের শেষ প্রান্তে কাচের দেয়াল, সেখান থেকে মানুষজনের ভিড়ভাট্টা দেখা যায়।  স্ট্রিট ফুডের স্বর্গরাজ্য বলা যায় এই অংশটুকু। 

হোটেলে ব্যাগপত্তর রেখে সাইকেলের বাক্স খুঁজতে বের হলাম। এখন এটাই সবচেয়ে জরুরি কাজ। সাইকেলের একটা দোকান পেলাম ঠিকই কিন্তু তারা সাইকেলের বাক্স রাখে না। অন্য আরেকটা দোকানে খবর নিলাম, তাদের কাছেও নেই, তবে তারা চেষ্টা করে দেখবে জানালো। ৫০ রিঙ্গিত পড়বে প্রতি বক্স। 

সাইকেল নিয়ে লম্বা সফরে বের হওয়া মোটেও সহজ কাজ না। এ জন্য খুব কম লোকে সাইকেল নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করে। শেষে অনেকগুলো রিঙ্গিত খরচা করে মুনতাসীর ভাইয়ের বান্ধবীর মারফতে দুইটা দকানের খোঁজ পেয়েছিলাম। সেখানেই বাক্স পেলাম। বাক্স হোটেলে এনে আধাবেলা সময় সেগুলো তিনজনে মিলে প্যাক করলাম। ঘেমেনেয়ে একাকার। 

কাজ শেষ করে হোটেল ট্রেভেলগের সামনে দিয়ে অনেক দূর হেঁটে গেলাম। বিকাল হতে হতে জায়গাটা বাহারী খাবার আর মানুষে জমজমাট হয়ে যায়। রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে পেলাম মুসলিম চাইনিজদের তৈরি ‘ক্রিসপি রোটি বিফ’। রুটির ভেতরে বিফ বা চিকেনের কিমা দিয়ে তাতে পেঁয়াজ এবং সামান্য কারী মসলা মিশিয়ে গোল করে চাপ দিয়ে একটা চাকতির মত তৈরি করে তেলে ফ্রাই করে সার্ভ করে। পুরা প্রসেসটা কাচের অপর প্রান্ত থেকে সবাই দেখতে পাচ্ছে। কেনার জন্য রাস্তায় লম্বা লাইন ধরেছে নানা দেশের মানুষ। আমিও কৌতূহলী হয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। কাউন্টারে দাম লেখা আছে, চিকেন রুটি সাড়ে ৫ রিঙ্গিত আর বিফ রুটি সাড়ে ৬ রিঙ্গিত। আমি বিফ রুটি নিলাম, তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। 

এই আট দিনে আমরা চালিয়েছি লানকাউই থেকে কুয়ালালামপুর ৫১৫ কিলোমিটার পথ। আর দুইদিন পরেই আমার যাত্রার শেষ। গত কয়েক বছর থেকে এখানে আসার স্বপ্ন বুনেছিলাম। আয়রনম্যানের আসরে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ফিনিশলাইন পার করবো। এ পর্যন্ত আসতে কত সাধনা আর পরিশ্রম করতে হয়েছে তা আমি ছাড়া কেউ ঠাওর করতে পারবে না। ভাগ্য সহায় হলো। এরও শেষ হলো। আসলে কি এসবের কোন শেষ আছে? আবার নতুন কোন অভিজ্ঞতার জন্য বেড়িয়ে পড়তে হবে। জীবনটা অনেক ছোট, সময়কে যতই কষ্টের মনে হোক, গত হয়ে গেলে এর মায়া আটকে থাকে মনে। সেই মায়া কাটিয়ে আবার নতুন সময়ে আমাদের প্রবেশ করতেই হয়। সেই সময়টা আরো ভালো কাটুক, তাই প্রত্যাশা। (শেষ)  

তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম নত স র র জন য আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

সাবেক গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের পরিবারের সদস্যদের হিসাব তলব

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক ৩ গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর, সাবেক বিএফআইইউ প্রধান এবং তাদের পরিবারের সদস্য তথা স্ত্রী-সন্তান-জামাতা-পূত্রবধূর হিসাবও তলব করেছে। এসব ব্যক্তির হিসাবের যাবতীয় তথ্য জানাতে দেশের সব তফসিলি ব্যাংককে এ সংক্রান্ত চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ।

বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) বিএফআইইউর একজন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি জানান, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুরোধে সাবেক গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তাদের হিসাব তলব সংক্রান্ত চিঠি বুধবার ব্যাংকগুলোকে দিয়েছে বিএফআইইউ। 

আরো পড়ুন:

সাবেক ৩ গভর্নর ও ৬ ডেপুটি গভর্নরের ব্যাংক হিসাব তলব 

১২ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এল ১০৫ কোটি ডলার

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করা এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আর্থিক খাতের বিভিন্ন অনিয়ম, ব্যাংক দখলের মাধ্যমে অর্থ লোপাট এবং অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে ঋণ বিতরণের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। হিসাবের যাবতীয় তথ্য পাওয়ার পর এসব ব্যক্তির হিসাবে অস্বাভাবিক কোন লেনদেন হয়েছে কিনা সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।

যাদের হিসাব তলব করা হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, ফজলে কবির এবং আব্দুর রউফ তালুকদার। অভিযোগ অনুযায়ী, ফজলে কবিরের মেয়াদে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর দখল নিয়ে লুটপাট শুরু হয় এবং তা অব্যাহত থাকে আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়েও। বিশেষ করে রউফ তালুকদারের সময় টাকা ছাপিয়ে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাটের সুযোগ তৈরি হয়েছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

হিসাব তলব করা সাবেক ডেপুটি গভর্নরদের মধ্যে রয়েছেন এস কে সুর চৌধুরী, এস এম মনিরুজ্জামান, কাজী ছাইদুর রহমান এবং আবু ফরাহ মো. নাছের। এর মধ্যে এস কে সুর চৌধুরী বর্তমানে দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দি। একই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাসও।

অন্যদিকে সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে সরকারি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের অবৈধ আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর আবু ফরাহ মো. নাছেরের বিরুদ্ধে নীতিমালা শিথিল করে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

বিএফআইইউর সাবেক প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসান এবং মো. মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। বিএফআইইউ থেকে ব্যাংকগুলোকে পাঠানো চিঠিতে তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব, লেনদেন বিবরণী, হিসাব খোলার ফরম এবং পরিচয় সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ব্যাংকগুলোর কাছে চাওয়া হয়েছে। কোনো হিসাব বর্তমানে বন্ধ থাকলেও, সেটির তথ্য আলাদাভাবে জানাতে বলা হয়েছে।

ঢাকা/নাজমুল/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ