‘যারা জানে আর যারা জানে না, তারা সমান নয়’
Published: 3rd, October 2025 GMT
ইসলামে জ্ঞানের মর্যাদা এমন উঁচু যে, এটি কেবল একটি গুণ নয়; বরং জীবনের মূল ভিত্তি। পবিত্র কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ আয়াতই ‘পড়’ নির্দেশ দিয়ে শুরু হয়েছে, যা জ্ঞানার্জনের প্রতি ইসলামের অটুট আহ্বানের প্রতীক।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এটা আল্লাহর কারিগরি, যিনি সবকিছুকে নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় তিনি তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত।’ (সুরা নামল, আয়াত: ৮৮)
এই আয়াতগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে জ্ঞান ইমানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলো, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? নিশ্চয়ই শুধু বিবেকবানরাই এতে চিন্তা করে।’ (সুরা জুমার, আয়াত: ৯)
আর সবচেয়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের মধ্য থেকে যারা ইমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তাদের মর্যাদা দান করবেন।’ (সুরা মুজাদালা, আয়াত: ১১)
বলো, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? নিশ্চয়ই শুধু বিবেকবানরাই এতে চিন্তা করে।সুরা জুমার, আয়াত: ৯এ আয়াতটি ইসলামে জ্ঞানের অবস্থানকে স্পষ্ট করে তোলে, যা ইমানের সঙ্গে মিলিত হয়ে মানুষকে উন্নত করে।
আরও পড়ুনজ্ঞান ও বিনয়: ইমান দৃঢ় করার দুই উপাদান২১ আগস্ট ২০২৫ইসলামে জ্ঞানের অবস্থানইসলামের ইতিহাসে জ্ঞানকে এমনভাবে সম্মানিত করা হয়েছে যে এটি কেবল ধর্মীয় জ্ঞান নয়; বরং জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.
হাসান বসরী (রহ.) বলেছেন, ‘জ্ঞান না থাকলে মানুষ পশুর মতো হয়ে যেত। জ্ঞান অর্জন করো, কারণ এটি তাকওয়া। এর অন্বেষণ ইবাদত, এর আলোচনা তাসবিহ, এর অনুসন্ধান জিহাদ, এর শিক্ষাদান সদকা, এর বিতরণ কুরবত, একাকিত্বে সঙ্গী, নির্জনতায় সাহচর্য, ইসলামের পথপ্রদর্শক, দুঃখ–সুখে সহ্যকারী, প্রবাসে নিকটজন, জান্নাতের পথের আলোকবর্তিকা। আল্লাহ এর মাধ্যমে কিছু লোককে উন্নত করে তাদের নেতা বানান, যাদের অনুসরণ করা হয়, যাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা হয়, যাদের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়। ফেরেশতারা তাদের সঙ্গে সঙ্গী হয় এবং তাদের ডানায় স্পর্শ করে। কারণ, জ্ঞান হৃদয়ের জীবন, দৃষ্টির আলো। এর মাধ্যমে মানুষ সৎ লোকদের স্তরে পৌঁছায়, আল্লাহকে আনুগত্য করে, তাঁকে ইবাদত করে, তাঁকে একত্ববাদ করে, তাঁকে মহিমান্বিত করে। এর মাধ্যমে বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়, সৌভাগ্যবানরা এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় এবং অশুভরা এর থেকে বঞ্চিত হয়।’ (ইমাম গাজালি, ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, কিতাব আল-ইলম, বাব আওয়াল ফি ফাজলিল ইলম ওয়াত্তা'লিম, প্রথম খণ্ড)
জ্ঞান এজন্য শিখো না যাতে আলিমদের সামনে গর্ব করতে পারো বা অজ্ঞদের সঙ্গে তর্ক করতে পারো বা মানুষকে তোমাদের দিকে টানতে পারো। যে এমন করে, সে জাহান্নামী।সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৩জ্ঞান কেবল ধর্মীয় নয়, এটি জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। ফকিহরা বলেছেন, যেসব জ্ঞান উম্মাহের উপকারী, তার অর্জন ফরজে কিফায়া। ধর্মীয় জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করলে উম্মাহের পশ্চাদপসরণ ঘটে। জ্ঞান ছাড়া কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়।
শ্রেষ্ঠ উম্মাহ হওয়ার পথপবিত্র কোরআন বলেছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কী আছে।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ১০১) আবার বলেছেন, ‘বলো, পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, আল্লাহ সৃষ্টির সূচনা কীভাবে করেছেন। তারপর আল্লাহই আরেকবার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ২০)
এই আয়াতগুলো অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ ও জ্ঞানার্জনের আহ্বান জানায়। ইসলাম উম্মাহকে ‘খাইর উম্মাহ’ বলেছে, মানে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। কিন্তু এই মর্যাদা অর্জন করতে হলে দুটি দিকে অগ্রগতি দরকার।
প্রথমত, নৈতিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে, যাতে উম্মাহের আচরণ ও সংস্কার সর্বোত্তম হয়।
দ্বিতীয়ত, শক্তির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, চিন্তাধারা, সামরিক ও বৈজ্ঞানিক।
এই দুটি অগ্রগতি জ্ঞান ছাড়া সম্ভব নয়। জ্ঞান ছাড়া উম্মাহ পিছিয়ে পড়বে, বিভক্ত ও দুর্বল হয়ে যাবে। জ্ঞানই উম্মাহের ঐক্যের ভিত্তি, তার ফলাফলের চাবিকাঠি।
ইসলাম জ্ঞানার্জনের জন্য ভ্রমণকে উৎসাহিত করে। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘সর্বোত্তম সদকা হলো একজন মুসলিম যে জ্ঞান শিখে তার ভাইকে শেখায়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৪২)
আরেক হাদিসে আছে, ‘মুমিনের আমলের মধ্যে যে অংশ তাকে অনুসরণ করে, তা হলো জ্ঞান, যা সে শিখিয়ে ছড়িয়ে দেয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৪৩)
কিন্তু জ্ঞানার্জনের সঙ্গে এর প্রয়োগ অপরিহার্য। হাদিসে রয়েছে, ‘জ্ঞান এজন্য শিখো না যেন আলিমদের সামনে গর্ব করতে পারো বা অজ্ঞদের সঙ্গে তর্ক করতে পারো বা মানুষকে তোমাদের দিকে টানতে পারো। যে এমন করে, সে জাহান্নামী।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৩)
জ্ঞানার্জনের পদ্ধতিতে ইসলাম চিন্তাভাবনার ওপর জোর দেয়, যেমন পর্যবেক্ষণ, যুক্তি ও তথ্য সংগ্রহ।
জ্ঞানের মর্যাদায় ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের তুলনাজার্মান মুসলিম পণ্ডিতজ্ঞ সিগ্রিদ হুনকে তাঁর বইয়ে ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের তুলনা করেছেন। খ্রিষ্টধর্মের মধ্যযুগে গির্জা জ্ঞানের বিরোধী ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর গির্জা গ্রিক–রোমান সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এথেন্সের বিদ্যালয় বন্ধ হয়, আলেকজান্দ্রিয়ায় গ্রিক দর্শনকে দমন করা হয়। গির্জা বিশ্বাস করত, আত্মশুদ্ধির একমাত্র পথ বাইবেল এবং দুনিয়াবি চিন্তা ভ্রষ্টতার দিক। ল্যাকট্যানশিয়াস বলেছেন, ‘পৃথিবী গোলাকার? এটা কি সম্ভব? মানুষের পা মাথার ওপরে, গাছ উল্টো?’ (সিগ্রিড হুনকে, আল্লাহ'স সান ওভার দ্য অক্সিডেন্ট: আওয়ার আরেবিয়ান হেরিটেজ, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯১ খ্রি., পৃষ্ঠা: ১২৩)
অন্যদিকে ইসলাম জ্ঞানকে ফরজ করেছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘পুরুষ–নারী সব মুমিনের ওপর জ্ঞানার্জন করা ফরজ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪)
ইসলামি সভ্যতায় বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা, গণিত—সবকিছুতে অগ্রগতি হয়েছে। এই তুলনা দেখায়, ইসলাম জ্ঞানকে উন্নয়নের চালিকা শক্তি মনে করে।
ইসলাম জ্ঞানকে ইমানের সঙ্গে যুক্ত করে মানুষকে উন্নত পথের সন্ধান দিয়েছে। খ্রিষ্টধর্মের মধ্যযুগে জ্ঞানীদের দমন করা হলেও বিপরীতে ইসলাম জ্ঞানকে ফরজ করেছে।জ্ঞান ছাড়া বিকাশ অসম্ভবইসলামকে কখনো অজ্ঞতা বা কুসংস্কারের ধর্ম বলা হয়, কিন্তু এটি ভুল। ইসলামের প্রথম আহ্বানই জ্ঞানের। জ্ঞান ছাড়া উম্মাহ উন্নতি করতে পারবে না। জ্ঞান দিয়ে দারিদ্র্য, রোগ ও বিভেদ দূর করা যায়।
পবিত্র কোরআন বলেছে, ‘জানো যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তোমার গুনাহের জন্য ও মুমিন পুরুষ–নারীদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করো। আল্লাহ তোমাদের চলাফেরা ও বাসস্থান সম্পর্কে জানেন।’ (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৯)
কাজের আগে জ্ঞানার্জনের নির্দেশ, কারণ জ্ঞান কাজের ভিত্তি।
জ্ঞানার্জনের পথ কঠিন, কিন্তু পুরস্কার মহান। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে জ্ঞান গোপন করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে জ্বলন্ত লাগাম দিয়ে আটকাবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৫)
ইসলামে শিক্ষককে সহজ করতে বলা হয়েছে আর শিক্ষার্থীকে বলা হয়েছে ধৈর্য ধারণ করতে।
জ্ঞান বিতরণ না করে লুকিয়ে রাখলে তার জন্য অভিশাপ দেওয়া হয়েছে, ‘আমি যে সব উজ্জ্বল নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি ঐগুলিকে কিতাবে মানুষের জন্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করার পরও যারা ঐসব বিষয়কে গোপন করে আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ দেবেন এবং অভিশাপকারীরা তাদেরকে অভিশাপ দেবে। কিন্তু যারা তওবা করে, সংশোধন করে এবং স্পষ্ট করে দেয়, তাদের তওবা আমি গ্রহণ করব।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৯-১৬০)
ইসলাম জ্ঞানকে ইমানের সঙ্গে যুক্ত করে মানুষকে উন্নত পথের সন্ধান দিয়েছে। খ্রিষ্টধর্মের মধ্যযুগে জ্ঞানীদের দমন করা হলেও বিপরীতে ইসলাম জ্ঞানকে ফরজ করেছে। জ্ঞান ছাড়া উম্মাহের উন্নয়ন অসম্ভব। আমাদের জ্ঞান অর্জন করতে হবে, শেখাতে হবে এবং প্রয়োগ করতে হবে। এটিই ‘খাইর উম্মাহ’ হওয়ার পথ।
আরও পড়ুনজীবন ও মৃত্যু: পরিপূরক নাকি বিপরীত২১ আগস্ট ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: খ র ষ টধর ম র জ ঞ ন র জন র ইসল ম জ ঞ ন আল ল হ ত র জন র প ইসল ম র সন ধ ন র জন য বল ছ ন র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
আজ জিতলেই সিরিজ বাংলাদেশের
এশিয়া কাপে স্মরণীয় জয় দিয়ে আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ এবার তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজেও আফগানিস্তানকে কোণঠাসা করেছে। সিরিজের প্রথম ম্যাচে দারুণ লড়াইয়ে জয় পাওয়ার পর আজ শুক্রবার (০৩ অক্টোবর) দ্বিতীয় ম্যাচে নামছে টাইগাররা। এই ম্যাচেই জয় পেলে এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ নিশ্চিত করার সুযোগ জাকের আলীর দলের সামনে।
সিরিজের প্রথম ম্যাচে ১৫২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুটা ভালো হলেও হঠাৎ করেই ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ। মাত্র ৯ রানের ব্যবধানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলার পর ম্যাচ হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তবে শেষদিকে নুরুল হাসান সোহান ও রিশাদ হোসেনের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ম্যাচ ঘুরে যায়। এর আগে তানজিদ তামিম ও পারভেজ ইমন ফিফটি তুলে নিয়ে জয়ের ভিত গড়ে দেন।
আরো পড়ুন:
বাংলাদেশকে ১৫২ রানের টার্গেট ছুড়ল আফগানিস্তান
টস হেরে বোলিংয়ে বাংলাদেশ
অধিনায়ক জাকের আলী ম্যাচ শেষে স্বীকার করেন, ব্যাটিং-বোলিংয়ে এখনও উন্নতির জায়গা আছে। তবে দলের মানসিক দৃঢ়তা তাকে আশাবাদী করেছে। তার ভাষায়, “এমন চাপ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হতেই পারে। ছেলেরা যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে আমি গর্বিত। কালই (আজ) সিরিজ জয় নিশ্চিত করতে চাই।”
বাংলাদেশ যেখানে সিরিজ নিশ্চিত করতে মরিয়া, সেখানে আফগানিস্তানের লক্ষ্য সমতায় ফেরা। প্রথম ম্যাচে ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল তারা। আজকের ম্যাচে সমানতালে জবাব দিতে না পারলে সিরিজ হাতছাড়া হয়ে যাবে রশিদ খানের দলের।
প্রথম দুই ম্যাচ হচ্ছে টানা দুই দিনে। ফলে খেলোয়াড়দের শারীরিক ও মানসিক শক্তি ধরে রাখা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে বাংলাদেশ চাইবে প্রথম ম্যাচের ভুলত্রুটি কাটিয়ে আরও শক্তিশালী পারফরম্যান্স উপহার দিতে।
আজকের ম্যাচে জয় পেলে বাংলাদেশ আগেভাগেই দ্বিপাক্ষিক সিরিজের ট্রফি ঘরে তুলবে। অন্যদিকে আফগানিস্তান সমতায় ফিরতে পারলে সিরিজের ভাগ্য গড়াবে আগামী ৫ অক্টোবরের শেষ ম্যাচে। এরপরই শুরু হবে ওয়ানডে সিরিজ, যা দুই দলকেই নতুন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করাবে।
ঢাকা/আমিনুল