ইসলামে জ্ঞানের মর্যাদা এমন উঁচু যে, এটি কেবল একটি গুণ নয়; বরং জীবনের মূল ভিত্তি। পবিত্র কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ আয়াতই ‘পড়’ নির্দেশ দিয়ে শুরু হয়েছে, যা জ্ঞানার্জনের প্রতি ইসলামের অটুট আহ্বানের প্রতীক।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এটা আল্লাহর কারিগরি, যিনি সবকিছুকে নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় তিনি তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত।’ (সুরা নামল, আয়াত: ৮৮)

এই আয়াতগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে জ্ঞান ইমানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলো, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? নিশ্চয়ই শুধু বিবেকবানরাই এতে চিন্তা করে।’ (সুরা জুমার, আয়াত: ৯)

আর সবচেয়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের মধ্য থেকে যারা ইমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তাদের মর্যাদা দান করবেন।’ (সুরা মুজাদালা, আয়াত: ১১)

বলো, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? নিশ্চয়ই শুধু বিবেকবানরাই এতে চিন্তা করে।সুরা জুমার, আয়াত: ৯

এ আয়াতটি ইসলামে জ্ঞানের অবস্থানকে স্পষ্ট করে তোলে, যা ইমানের সঙ্গে মিলিত হয়ে মানুষকে উন্নত করে।

আরও পড়ুনজ্ঞান ও বিনয়: ইমান দৃঢ় করার দুই উপাদান২১ আগস্ট ২০২৫ইসলামে জ্ঞানের অবস্থান

ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞানকে এমনভাবে সম্মানিত করা হয়েছে যে এটি কেবল ধর্মীয় জ্ঞান নয়; বরং জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.

) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের পথে চলে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। ফেরেশতারা জ্ঞানার্জনকারীর জন্য খুশি হয়ে তাদের ডানা বিছিয়ে দেয়। আকাশের সবাই এবং পৃথিবীর সবাই, এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত জ্ঞানীর জন্য দোয়া করে। জ্ঞানীর ওপর আবেদের মর্যাদা অন্য তারকাদের ওপর চাঁদের মর্যাদার মতো। জ্ঞানীরা নবীদের উত্তরাধিকারী, যদিও নবীরা দিনার–দিরহাম (স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা) রেখে যাননি, শুধু জ্ঞান রেখে গেছেন। যার তা নেয়, সে প্রচুর উত্তরাধিকার পায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৬৯৯)

হাসান বসরী (রহ.) বলেছেন, ‘জ্ঞান না থাকলে মানুষ পশুর মতো হয়ে যেত। জ্ঞান অর্জন করো, কারণ এটি তাকওয়া। এর অন্বেষণ ইবাদত, এর আলোচনা তাসবিহ, এর অনুসন্ধান জিহাদ, এর শিক্ষাদান সদকা, এর বিতরণ কুরবত, একাকিত্বে সঙ্গী, নির্জনতায় সাহচর্য, ইসলামের পথপ্রদর্শক, দুঃখ–সুখে সহ্যকারী, প্রবাসে নিকটজন, জান্নাতের পথের আলোকবর্তিকা। আল্লাহ এর মাধ্যমে কিছু লোককে উন্নত করে তাদের নেতা বানান, যাদের অনুসরণ করা হয়, যাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা হয়, যাদের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়। ফেরেশতারা তাদের সঙ্গে সঙ্গী হয় এবং তাদের ডানায় স্পর্শ করে। কারণ, জ্ঞান হৃদয়ের জীবন, দৃষ্টির আলো। এর মাধ্যমে মানুষ সৎ লোকদের স্তরে পৌঁছায়, আল্লাহকে আনুগত্য করে, তাঁকে ইবাদত করে, তাঁকে একত্ববাদ করে, তাঁকে মহিমান্বিত করে। এর মাধ্যমে বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়, সৌভাগ্যবানরা এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় এবং অশুভরা এর থেকে বঞ্চিত হয়।’ (ইমাম গাজালি, ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, কিতাব আল-ইলম, বাব আওয়াল ফি ফাজলিল ইলম ওয়াত্তা'লিম, প্রথম খণ্ড)

জ্ঞান এজন্য শিখো না যাতে আলিমদের সামনে গর্ব করতে পারো বা অজ্ঞদের সঙ্গে তর্ক করতে পারো বা মানুষকে তোমাদের দিকে টানতে পারো। যে এমন করে, সে জাহান্নামী।সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৩

জ্ঞান কেবল ধর্মীয় নয়, এটি জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। ফকিহরা বলেছেন, যেসব জ্ঞান উম্মাহের উপকারী, তার অর্জন ফরজে কিফায়া। ধর্মীয় জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করলে উম্মাহের পশ্চাদপসরণ ঘটে। জ্ঞান ছাড়া কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়।

শ্রেষ্ঠ উম্মাহ হওয়ার পথ

পবিত্র কোরআন বলেছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কী আছে।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ১০১) আবার বলেছেন, ‘বলো, পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, আল্লাহ সৃষ্টির সূচনা কীভাবে করেছেন। তারপর আল্লাহই আরেকবার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ২০)

এই আয়াতগুলো অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ ও জ্ঞানার্জনের আহ্বান জানায়। ইসলাম উম্মাহকে ‘খাইর উম্মাহ’ বলেছে, মানে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। কিন্তু এই মর্যাদা অর্জন করতে হলে দুটি দিকে অগ্রগতি দরকার।

প্রথমত, নৈতিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে, যাতে উম্মাহের আচরণ ও সংস্কার সর্বোত্তম হয়।

দ্বিতীয়ত, শক্তির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, চিন্তাধারা, সামরিক ও বৈজ্ঞানিক।

এই দুটি অগ্রগতি জ্ঞান ছাড়া সম্ভব নয়। জ্ঞান ছাড়া উম্মাহ পিছিয়ে পড়বে, বিভক্ত ও দুর্বল হয়ে যাবে। জ্ঞানই উম্মাহের ঐক্যের ভিত্তি, তার ফলাফলের চাবিকাঠি।

ইসলাম জ্ঞানার্জনের জন্য ভ্রমণকে উৎসাহিত করে। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘সর্বোত্তম সদকা হলো একজন মুসলিম যে জ্ঞান শিখে তার ভাইকে শেখায়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৪২)

আরেক হাদিসে আছে, ‘মুমিনের আমলের মধ্যে যে অংশ তাকে অনুসরণ করে, তা হলো জ্ঞান, যা সে শিখিয়ে ছড়িয়ে দেয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৪৩)

কিন্তু জ্ঞানার্জনের সঙ্গে এর প্রয়োগ অপরিহার্য। হাদিসে রয়েছে, ‘জ্ঞান এজন্য শিখো না যেন আলিমদের সামনে গর্ব করতে পারো বা অজ্ঞদের সঙ্গে তর্ক করতে পারো বা মানুষকে তোমাদের দিকে টানতে পারো। যে এমন করে, সে জাহান্নামী।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৩)

জ্ঞানার্জনের পদ্ধতিতে ইসলাম চিন্তাভাবনার ওপর জোর দেয়, যেমন পর্যবেক্ষণ, যুক্তি ও তথ্য সংগ্রহ।

জ্ঞানের মর্যাদায় ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের তুলনা

জার্মান মুসলিম পণ্ডিতজ্ঞ সিগ্রিদ হুনকে তাঁর বইয়ে ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের তুলনা করেছেন। খ্রিষ্টধর্মের মধ্যযুগে গির্জা জ্ঞানের বিরোধী ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর গির্জা গ্রিক–রোমান সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এথেন্সের বিদ্যালয় বন্ধ হয়, আলেকজান্দ্রিয়ায় গ্রিক দর্শনকে দমন করা হয়। গির্জা বিশ্বাস করত, আত্মশুদ্ধির একমাত্র পথ বাইবেল এবং দুনিয়াবি চিন্তা ভ্রষ্টতার দিক। ল্যাকট্যানশিয়াস বলেছেন, ‘পৃথিবী গোলাকার? এটা কি সম্ভব? মানুষের পা মাথার ওপরে, গাছ উল্টো?’ (সিগ্রিড হুনকে, আল্লাহ'স সান ওভার দ্য অক্সিডেন্ট: আওয়ার আরেবিয়ান হেরিটেজ, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯১ খ্রি., পৃষ্ঠা: ১২৩)

অন্যদিকে ইসলাম জ্ঞানকে ফরজ করেছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘পুরুষ–নারী সব মুমিনের ওপর জ্ঞানার্জন করা ফরজ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪)

ইসলামি সভ্যতায় বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা, গণিত—সবকিছুতে অগ্রগতি হয়েছে। এই তুলনা দেখায়, ইসলাম জ্ঞানকে উন্নয়নের চালিকা শক্তি মনে করে।

ইসলাম জ্ঞানকে ইমানের সঙ্গে যুক্ত করে মানুষকে উন্নত পথের সন্ধান দিয়েছে। খ্রিষ্টধর্মের মধ্যযুগে জ্ঞানীদের দমন করা হলেও বিপরীতে ইসলাম জ্ঞানকে ফরজ করেছে।জ্ঞান ছাড়া বিকাশ অসম্ভব

ইসলামকে কখনো অজ্ঞতা বা কুসংস্কারের ধর্ম বলা হয়, কিন্তু এটি ভুল। ইসলামের প্রথম আহ্বানই জ্ঞানের। জ্ঞান ছাড়া উম্মাহ উন্নতি করতে পারবে না। জ্ঞান দিয়ে দারিদ্র্য, রোগ ও বিভেদ দূর করা যায়।

পবিত্র কোরআন বলেছে, ‘জানো যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তোমার গুনাহের জন্য ও মুমিন পুরুষ–নারীদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করো। আল্লাহ তোমাদের চলাফেরা ও বাসস্থান সম্পর্কে জানেন।’ (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৯)

কাজের আগে জ্ঞানার্জনের নির্দেশ, কারণ জ্ঞান কাজের ভিত্তি।

জ্ঞানার্জনের পথ কঠিন, কিন্তু পুরস্কার মহান। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে জ্ঞান গোপন করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে জ্বলন্ত লাগাম দিয়ে আটকাবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৫)

ইসলামে শিক্ষককে সহজ করতে বলা হয়েছে আর শিক্ষার্থীকে বলা হয়েছে ধৈর্য ধারণ করতে।

জ্ঞান বিতরণ না করে লুকিয়ে রাখলে তার জন্য অভিশাপ দেওয়া হয়েছে, ‘আমি যে সব উজ্জ্বল নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি ঐগুলিকে কিতাবে মানুষের জন্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করার পরও যারা ঐসব বিষয়কে গোপন করে আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ দেবেন এবং অভিশাপকারীরা তাদেরকে অভিশাপ দেবে। কিন্তু যারা তওবা করে, সংশোধন করে এবং স্পষ্ট করে দেয়, তাদের তওবা আমি গ্রহণ করব।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৯-১৬০)

ইসলাম জ্ঞানকে ইমানের সঙ্গে যুক্ত করে মানুষকে উন্নত পথের সন্ধান দিয়েছে। খ্রিষ্টধর্মের মধ্যযুগে জ্ঞানীদের দমন করা হলেও বিপরীতে ইসলাম জ্ঞানকে ফরজ করেছে। জ্ঞান ছাড়া উম্মাহের উন্নয়ন অসম্ভব। আমাদের জ্ঞান অর্জন করতে হবে, শেখাতে হবে এবং প্রয়োগ করতে হবে। এটিই ‘খাইর উম্মাহ’ হওয়ার পথ।

আরও পড়ুনজীবন ও মৃত্যু: পরিপূরক নাকি বিপরীত২১ আগস্ট ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খ র ষ টধর ম র জ ঞ ন র জন র ইসল ম জ ঞ ন আল ল হ ত র জন র প ইসল ম র সন ধ ন র জন য বল ছ ন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

ঊষর দিন ধূসর রাতের ‘প্রোটাগনিস্ট’ নিখোঁজ

পাপড়ি রহমানের উপন্যাস ‘ঊষর দিন ধূসর রাত’। পড়ার শুরুতে মনে হয়েছিল শেফালি উপন্যাসের মূল প্রোটাগনিস্ট। আরেকটু এগোনোর পরে মনে হলো মূল চরিত্রটি বোধহয় মুমু। শেষে আরেকটি চরিত্র বকুল এসে সেই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিলো। কেউই প্রোটাগনিস্ট হয়ে উঠলো না। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাওয়ার পরে মনে হলো আরে প্রোটাগনিস্ট তো তুহিন। কেননা তুহিন শেষতক ‘আমি’ হিসেবে উপন্যাসের চরিত্র হয়ে ওঠে। কিন্তু নাহ, কেউই আসলে প্রোটাগনিস্ট না। বরং এইসব চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্য যে যে প্রতীকী রূপ ব্যবহৃত হয়েছে, যে ইলিউশন তৈরি হয়েছে তার ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে এই অস্থির নগরজীবনের গল্প, সেই গল্পটিই প্রোটাগনিস্ট। 

মানে হলো নদী বয়ে যেতে যেতে শুকিয়ে গেলো। তারপর জেগে রইলো দাগ। সেই দাগ বলে দিলো ‘এইখানে নদী ছিলো’।  ঔপন্যাসিক এই উপন্যাসের মূল গল্পটা পিলো পাসিংয়ের মতো এক চরিত্রের কাছ থেকে আরেকজনের দিকে এগিয়ে দিতে থাকেন। এরই মধ্যে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয় এই শহুরে সমাজের নারীদের জীবনচিত্র। যা আরেক নারী প্রায় নিখুঁতভাবে চিত্রিত করেছেন।

নারীর প্রিয় রং গোলাপি। এই রঙের একটি বাড়ির দিকে তাকিয়ে ফেলে আসা দাম্পত্যজীবনের কথা ভেবে অস্থির হয় শেফালি। দুই সন্তান নিয়ে যার সংসার। কিন্তু সন্তানেরা বড় হয়ে যে যার মতো থাকে, আর শেফালি চাকরি করে, একা সংসার করেন আর সময়ে-অসময়ে ওই গোলাপি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আদতে শেফালি তাকিয়ে থাকেন তার ফেলে আসা সংসারের দিকে। সেখান থেকে হারিয়ে যাওয়া শব্দ কুড়িয়ে আনেন, ভীত হন। ভীত হতে হতে শেফালি ট্রমাটাইজ এক জীবনযাপনে ঢুকে পড়েন। 

শেফালি সংসার ছেড়ে আসে। কারণ স্বামী শেফালির ভাতিজিকে যৌনহয়রানি করে। এই ঘটনা শেফালিকে সংসার ছেড়ে বের হয়ে আসার তাগিদ দেয়। দুই সন্তানের মধ্যে এক সন্তান বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, আরেক সন্তান বাবাকে এড়িয়ে চলে। এই সন্তান যে মায়ের ভালো থাকা না থাকার খুব খোঁজ রাখে, ব্যাপারটা এমনও নয়। অথচ শেষে দেখা যায় এক জীবন শেষ হয়ে এলেও দুজনের কেউই বিয়ে করে না। না শেফালি, না বাদল। যে বাদলকে শুরু থেকে শুধুই নিপীড়ক মনে হচ্ছিল, সেই বাদল ক্ষমা না পাওয়া এক অসমাপ্ত চরিত্র হয়ে আসে। আর শেফালিকে বলা হচ্ছে বুড়ো ঈগল, একা একা দীর্ঘ লড়াই করেও সে জয়ী হতে পারে না। এই উপন্যাসে দেখানো হয়েছে মাতৃত্ব কীভাবে নারীর শরীর ও সৌন্দর্য ভেঙেচুড়ে একাকার করে দেয়। মা হয়ে যাওয়া নারীটি প্রিয় পুরুষের কাছে কীভাবে অবহেলার পাত্র হয়ে ওঠে।

উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ কথক তুহিন, সে গান ভালোবাসে।  শেফালি দূর থেকে ছেলের গান শোনে। ছেলের আচরণের ভেতর বাবার আচরণের প্রতিফলন দেখতে থাকে শেফালি। তার স্মৃতিতে পাঠক বারবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ পান একাধিক নারীর কাছে। শেফালি কোনো বাড়িতে শিশু দেখলে তাদের নিজের সন্তানদের হারানো শৈশব, আর সন্তানদের মাকে দ্বিতীয় শেফালি ভাবেন। সন্তানদের ওপর চালানো শারীরিক নির্যাতনের কথা ভেবে তিনি ভীত হন। শেফালি এমন হাজারটা অপরাধবোধে ভীত মানুষ। দেখতে স্বীকৃত সুন্দরী নন। হাত-পা ছোট ছোট। একটু বেটে। সন্তান জন্ম দেওয়ার পরে এসবের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে যোগ হয়েছে থলথলে তলপেট। তাকে যে কেউ বেঢপ্পা বলতে পারে অনায়াসে। শেফালি পাঠককে ক্রমাগত নিয়ে যায় এমন এক জগতে যেখানে শেফালি বাস্তবতা থেকে স্মৃতিতে বসবাস করেন বেশি সময়। আবার কাজের ডেস্কে যখন ফিরে আসেন, তিনিই হয়ে ওঠেন অদম্য একজন। এই যে নারীর দ্বিচিত্র, এ হলো চিত্রকল্পে হাসি-কান্না ঝুলিয়ে রাখা নারীর অবয়বের মতো। একবার মনে হয় তিনি জিতেছেন, আবার মনে হয় তিনি হেরেছেন।

মুমুকে আমরা পাই শহরে নিজের মতো করে বসবাস করা, আর্থিকভাবে স্বাধীন এক নারী হিসেবে। যে তার এক বান্ধবীর সঙ্গে মিলে শাড়ির ব্যবসা করে। কিন্তু থাকে একা এক ফ্ল্যাটে। সম্পর্ক থেকে লিভ টুগেদারে যায় এক কবির সঙ্গে। মাঝেমধ্যে মুমুর ফ্ল্যাটে কবি সজল আসে। তার আসাকে বিচিত্রভাবে উপস্থাপন করেছেন ঔপন্যাসিক। যেমন: ‘বর্ষার নতুন জলে  পুঁটি মাছের মতো রঙিন লেজ নাড়িয়ে এগিয়ে আসে সজলই।’

সজল আসে, সজল চলে যায়। মুমু একা হয়ে যায়। এই একা হয়ে যাওয়া মানুষটি অন্ধকার ভয় পায়। সজলকে সে যখন তার ভয়ের কথা জানায় তখন সজল আর তার কথায় মনোযোগ দেয় না। মুমুর বান্ধবী, ব্যবসায়িক পার্টনার টুলকি সজলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মুমু বুঝতে পারে, প্রশ্ন করে না। কিন্তু হঠাৎ একদিন সজল হারিয়ে যায়। তাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ায় মুমু। তারপর জানতে পারে সজল বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। মুমু পাগলের মতো হয়ে যায়। একটি সংসারের প্রয়োজনিয়তা মুমু বুঝতে পারে। 

জীবন থেকে পালিয়ে নয়, বরং জীবনের খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে আসে বকুল। সৎ ফুফু শেফালির বাসায় যায় কিন্তু শেফালি তার উপস্থিতি ভালোভাবে নেয় না। নেবে কীভাবে? তারই বোন চম্পা এসেছিল বাসায়। চম্পাকে বাদল মলেস্ট করেছিল, আর ঘুনে ধরা সংসারটা ওই আঘাতেই ভেঙে পড়েছিল। 

বকুল চাকরি খুঁজে বেড়ায়। শেষে একটি পত্রিকায় সাব-এডিটর হিসেবে চাকরি পেয়ে যায়। এই পাওয়া বকুলকে আনন্দে ভাসিয়ে দেয়। সে ভাবে, অনেক কিছু পেয়ে গেছে। বাড়িতে ফেরার ইচ্ছা হয় না তার। সেখানে দুই ভাইয়ের শাসনে অতিষ্ঠ ছিল বকুল। কিন্তু মায়ের জন্য পরাণ পোড়ে তার। কিছুদিন যেতে না যেতেই বকুলকে নিজের অসহায় অবস্থার কথা বলেন সম্পাদক মোসাদ্দেক। তিনি বকুলকে বিয়ে করতে চান। বকুল কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে তাকে বিয়ে করে। কিন্তু বকুলকে নিজের ফ্ল্যাটে নেন না মোসাদ্দেক। তিনি একটি ভাড়া করা ফ্ল্যাটে বকুলকে রাখেন। বকুল খাঁচায় বন্দি পাখির মতো হাহাকারসমেত বন্দি হয়ে পড়ে। হঠাৎ একদিন বুঝতে পারে মোসাদ্দেক তারই পাশে বসে 
প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছেন। এরপর মোসাদ্দেক প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে ফিরে যান। তার কয়েকদিন পরেই হার্ট অ্যাটাকে মরে যান মোসাদ্দেক। বকুলের মনে প্রশ্ন জাগে। সে উত্তর খুঁজে বেড়ায়: ‘কেন? কেন মানুষ এমন?  কী আছে এই গৃহে? এই পৃথিবীর কোথাও দাগহীন সংসার? পুড়ে যাওয়ার নিত্য যে যন্ত্রণা, রক্তক্ষরণ সেইসব পুনরায় পাওয়ার জন্যই কি মানুষ মেলে দেয় নিজের করপুট?’ 

বকুলের মা মালিহা খাতুন। মায়ের মৃত্যু বকুলকে অন্যরকম মানুষে পরিণত করে। সে সারাক্ষণ মায়ের উপস্থিতি বুঝতে পারে। এমনকি মোসাদ্দেকের স্ত্রীকেও তার কাছে মালিহা খাতুন মনে হয়।

‘ঊষর দিন ধূসর রাত’-এর নারীরা অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চিত ভয় বুকে নিয়ে তাড়া খেয়ে বেড়ায়, স্মৃতিতে ফেরে আর বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। এরা কেউ সাজানো সংসার ছেড়ে একা বেঁচেছে, কেউ একা থাকতে থাকতে একটি সংসার পাওয়ার আশায় ব্যক্তিগত আভিজাত্য বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসার মানুষকে ফিরে পেতে চেয়েছে। আর কেউ বিশ্বাস করে ঠকেছে।

এবার মাহিনের কথায় আসি। শেফালির ছোট ছেলে। মুমুর বন্ধু। মুমু মাঝেমধ্যে মাহিনের কাছে এসে নিজের কষ্টের কথা বলে, কান্নায় ফেটে পড়ে। তুহিন দূর থেকে বুঝতে পারে, আঁচ করতে পারে। সমবেদনা বোধ করে। গানপ্রিয় তুহিন মুমুকে ভালোবেসে ফেলে। তুহিন আসলে মাকেও ভালোবাসে, তার ভালোবাসার প্রকাশ শেষের দিকে এসে স্পষ্ট হয়। মা আর বাবার একা থাকার বিষয়টি তুহিনকে ভাবায়। মুমুর কাছে যায় তুহিন, কিন্তু মায়ের কাছে সময়মতো ফিরে আসে। 

মুমুর বাসা থেকে মায়ের বাসার দিকে যাওয়ার সময় একদিন তাকে কয়েকজন ধরে নিয়ে যায়। গুম হয়ে যায় তুহিন। শেফালি ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা, ভাবতে থাকে তুহিনের জন্ম আর সেই সময়ের অনুভূতি নিয়ে। তুহিন হারিয়ে যাওয়ার পরেও প্রতিদিন এক কৌটা ভাত বেশি রান্না করে শেফালি, ছেলে যদি ফিরে আসে। 

শেফালিকে পরিবার, সমাজ, বিশ্বাস, নিজস্ব বোঝাপড়া সব কিছুর সঙ্গে লড়তে হয়। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে হেরে যায় রাজনীতির ‘গুম প্রবণতার’ কাছে। এখানে শেফালি জানে না কার বিরুদ্ধে লড়বেন, কার কাছ থেকে সরে আসবেন। কেবল অপেক্ষা করতে থাকেন।

শেষ থাবাটা রাজনীতির। তিলে তিলে বড় করে তোলা সন্তান হারিয়ে ফেলা শেফালির মতো আরও অনেকেই প্রতিদিন এই ঠাঁইহীন শহর সমুদ্রে নিঃশব্দে ডুবে বেঁচে থাকা আয়ত্ব করেছে। কিন্তু একটি বিষয় ঔপন্যাসিক পাপড়ি রহমান খুব ভালোভাবে দেখিয়েছেন: তার উপন্যাসের নারীরা ভান করে বাঁচতে চায়নি। এই উপন্যাসে নারী মাতৃত্বের মধ্যে দিয়ে সৌন্দর্য হারিয়েছে ঠিকই কিন্তু সন্তানদের জীবনে মায়ের ছায়া হয়েছে সুতীব্র ও সুঘন।

উপন্যাসের দুর্বলতা খুঁজে নেবেন সমালোচকেরা, আমি কেবল চরিত্রদের সঙ্গে এক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়েছি। যেখানে তিনটি আলাদা গল্প, এক সূত্রে গেঁথে একটি উপন্যাসের জন্ম হয়েছে। নারীর সূক্ষ্ম বোঝাপড়া এখানে প্রধান। 

উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স। মূল্য ৫৬০ টাকা। 

ঢাকা/তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ