ফুয়াদ বড় হচ্ছে নানা রকম স্বপ্ন দেখতে দেখতে। বাজারে ওর আব্বা টিকতে পারছে না। গ্যাং না করলে কেউ আর বাজারে টিকতে পারে না। একদিকে বাজারে ওর আব্বার দোকানটা পড়ে যাচ্ছে, মানে ব্যবসা নেই বলা চলে। অন্যদিকে দাদার আমলের পুরোনা কাঠের বেড়ার বাড়িটা খসে খসে যাচ্ছে। বাজার আর বাড়ির মাঝখানে খালের পানি দিনে দিনে বেশি ঘোলা হচ্ছে। অথচ বাজার কিন্তু আরও সরগরম। আগে থানে, দোকানে কুপি জ্বলত। এখন হ্যাজাক জ্বলে। শোনা যাচ্ছে কারেন্টের লাইন আসবে। তারপরও একটাই ঘর ফুয়াদের বাপের।
সেই ঘরের এক চিকন চকিতে ফুয়াদ ঘুমায়। ঘরের আরেক দিকে, আরেক চকিতে ওর বাপ-মা। ওর চকিটা টলমলে এক জানালার ধারে। জানালাটা বন্ধ করার উপায় নেই, ভাঙা, তাই বাতাস ঢুকে রাতে মলিন পর্দা ফরফর করে ওড়ে। তখন ফুয়াদের ভয় লাগে। এই রকম রাতেও বালিশের নিচে পিঁপড়ারা লাইন করে আসা-যাওয়া করে। কুট করে কামড়ায়। চমকে পাশ ফিরতে গেলে চকির পায়া যখন ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তোলে, তখন ফুয়াদ লাথি দিয়ে ক্যাচকেচানি থামায়ে দেয়। তারপর কান পেতে থাকে—বাজার থেকে ভেসে আসা গমগম আওয়াজ কমতে শুরু করে। ফুয়াদ চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করে। কিন্তু দুই চোখ বন্ধ হতে চায় না। ওর আব্বা নানার বাড়ি বেড়াতে গেছে—আসলে ভালো-মন্দ খাইতে গেছে, ঘরেতে অভাব। রাত বাড়ে। খাওয়ার জন্য নানার বাড়ি বেড়াতে যেতে ওর মন চায় না। ভাবতে ভাবতে অন্ধকারে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে চৌকাঠে কার যেন ছায়া। সুনসান। দরজায় খিল না থাকায় বাতাসে খুলে যায়, আবার বন্ধ হওয়ার চেষ্টা করে একটা কপাট, কিন্তু বন্ধ হতে পারে না—দোলে। স্পষ্ট দেখা যায় যে ছায়াটা লম্বা হচ্ছে।
বাইরে রাতটা অদ্ভুত। শুকনা ও ঠান্ডা। ছয় দিন ধরে যে বৃষ্টি একটানা হলো, আজ তার বিরতি। ঘরের সামনে, একটু দূরে, নালায় জমে থাকা ঘোলা পানির ওপর ভাসতে থাকা কচুরিপানার গন্ধ ঘরে আসে। জাগ দেওয়া পাটের তীব্র গন্ধ নাকে লাগে।
ফুয়াদ বাইরে বের হয়। মা চোখ বন্ধ করে আছে, নাক ডাকার আওয়াজ শুরু হবে একটু পরে। নালার ওপারে বাজারের লোকজন, দোকানদার, দড়িতে ঝুলে থাকা রঙিন কাগজ, টিনের বাঁশি, শ্রীপুরের ট্যাবলেটের ক্যানভাসার, চিনি গলায়ে রং ঢেলে লাঠির মতো মিষ্টি বানানো—সব দেখা যায়। সেখানে রাস্তার ওপরে হ্যাজাক ঝোলানো—সোনালি-রুপালি রং। তার নিচে কয়েকজন সং। ঘামে চকচক করে তাদের মুখ। গলায় ঝোলানো ড্রাম। রাতে বাজানো নিষেধ। হাতে, মাথায়, ঘাড়ে মালসামান নিয়ে লোকজন একে অন্যকে ঠেলে বাজার ছাড়ছে। ঘুগরি পোকার ডাক বড় হচ্ছে। হ্যাজাকগুলো একটা একটা করে নিভে যাচ্ছে। অন্ধকারে সবকিছু ভূতের মতো লাগে।
ফুয়াদ আবার ঘরে ঢুকল। মায়ের গলা শুনতে পেল। একটা গীত। সুর চেনা, কথা পুরানা। শুনতে শুনতে ফুয়াদের মুখস্থ। একলা মানুষের রাতের অভ্যাস। দুপুর রাত! ওদের ঘড়ি নেই। তবু দেহের মধ্যে যে ঘড়ি থাকে, সেটা নদীর ঢেউয়ের মতো সময় গুনে চলে। জানালার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসার সঙ্গে সঙ্গে সে বিছানার চাদর অর্ধেক তুলে নিজেকে জড়িয়ে ধরল।
ফুয়াদ দাও ফেলে একলাফে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। চকির পায়া ক্যাচ করে উঠল। মার নাকডাকার আওয়াজ শুরু হয়েছে। তখন সে, দরজায় দাঁড়ায়ে আছে একজন পুরুষ লোক, দেখল। দুইটা দাঁত ঠোঁটের সামান্য বাইরে। মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। চোখ জ্বলজ্বল করছে। বিড়ালের মতো।ঘুগরির কিরকিরানি ছাপিয়ে দূরে কেউ নালার ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাসে। চাপা গলায় একজন কইল—আল্লায় বিচার করবে। মনে হলো কথাটা মুখ দিয়ে বের হবার আগেই গলার ফাঁক দিয়ে ঘড় ঘড় করে উঠল। তারপর চুপ। এমন সময় কাঠের দরজার পাল্লায় টুপ টুপ শব্দ। দরজার কাছে এগিয়ে শব্দটা নিজের নিশ্বাস শোনার মতো সে শোনে। বুকের ভেতর শব্দ করে ওঠা ধুপধুপানি হাত দিয়ে চাপা দিয়ে থামাতে চায়। মায়ের গলা থেমে গেল। বাজারের ওদিকটা এখন সম্পূর্ণ সুনসান। শিয়াল ডাকছে কোথাও। দরজার ঠিক ওপাশে কেউ অবশ্যই দাঁড়ানো। তাকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ছায়াটা আছে। আলো ছাড়া ছায়া ভালো কথা নয়। ফুয়াদ নিশ্চিত হয়, সে একা নয়; আরও কেউ আরেক দিক থেকে এই রাতকে শুনছে। ঘাড়ের ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে গেল। মনে হলো কেউ পাশ দিয়ে দৌড় দিল।
জানালার বাইরে অর্ধেক চাঁদ। রাস্তাটা চুপচাপ লম্বা আউলা-ঝাউলা হয়ে শুয়ে আছে। এখানে–ওখানে পানি জমে থাকা জায়গাগুলো কালচে। পাশের বাড়ির খুলিতে ঝুলতে থাকা কাপড়গুলোকে মনে হচ্ছে আঁকা ছবি। জোছনার আভা ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতরে। টিকটিক শব্দ হলো। খসে পড়তে থাকা কাঠের বেড়ার ওপর একটা টিকটিকি নড়ল। সে টিকটিকির আবার ডানা আছে, ডানা মেলে বেড়ার ওপর বসে আছে—এমনটাই মনে হলো ফুয়াদের। আর শব্দ নেই, তবু মনে হয় ঝিমঝিম শব্দ শোনা যাচ্ছে মাথার ভেতরে। টিকটিকিটা বিছানার দিকে নেমে আসবে, নাকি সোজা ওপরের দিকে উঠবে, বোঝা যাচ্ছে না। ফুয়াদ এমনভাবে চকির ওপর বসল, যেন বাতাসও বুঝতে না পারে। দরজার ওপাশে কে, সেটা দেখতে হবে। তোশকের তলা থেকে দাদার আমলের ভারী ‘দাও’ বের করে হাতে নিল। ছায়াটা নড়ে উঠল। মিলায়ে গেল।
ফুয়াদ দাও ফেলে একলাফে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। চকির পায়া ক্যাচ করে উঠল। মার নাকডাকার আওয়াজ শুরু হয়েছে। তখন সে, দরজায় দাঁড়ায়ে আছে একজন পুরুষ লোক, দেখল। দুইটা দাঁত ঠোঁটের সামান্য বাইরে। মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। চোখ জ্বলজ্বল করছে। বিড়ালের মতো। ফুয়াদ আধখোলা চোখে, পাপড়ির ফাঁক দিয়ে এমনভাবে তাকায়ে আছে, যাতে দেখতেও পারে আবার লোকটা বুঝতেও না পারে। মার নাকডাকা বদলাচ্ছে, কখনো খাটো, কখনো লম্বা হচ্ছে। সেই শব্দও কান খাড়া করে শুনছে দরজার মানুষটা, এমন মনে হলো। তারপর লোকটা ফিসফিস করে ডাকল—এ বাবা!
এই নামে একজনই ডাকে। দুপুরে দোকান বন্ধ করে ভাত খেতে এসে দূর থেকে ডাকতে শুরু করবে—এএএ বাবা। কিন্তু ওর আব্বা তো ভালো-মন্দ খাওয়ার জন্য বেড়াতে গেছে শ্বশুরবাড়ি! মানুষটা আবার বলল, ‘এ বাবা…’ তারপর আরও একবার। লোকটার মুখ থেকে তামাকের গন্ধের মতো স্মৃতি বের হচ্ছে। তার নিশ্বাসের শব্দ খানিক ঘন হলো, তারপর হালকা দীর্ঘশ্বাস। এমনভাবে তাকিয়ে থাকল যেন সে দ্বিধাগ্রস্ত—আরেকটু থাকব, নাকি চলে যাব! ফুয়াদ মাকে ডাকতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারল না।
মা ঘরে এসে বলল, ‘আজকে তোর পনেরো বছর হইল।’ তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘রাতে বাইরে গেছিলি ক্যান? বড় হইতে না হইতেই রাত-বিরেতে বাইরে যাস? গ্যাং করতেছিস না তো?’ ফুয়াদের ঘুম কাটেনি। সকালের নাশতার থালা বিছানার কিনারায় রাখল মা। বাসি ভাতের সঙ্গে ডিমের পোজ।অলংকরণ: মাসুক হেলাল.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আওয় জ ত রপর র ওপর দরজ র
এছাড়াও পড়ুন:
ঐহিক অমরতায় রণদা প্রসাদ সাহা
দানবীর রণদা প্রসাদ সাহাকে তাঁর গ্রামের ছোট–বড় সবাই ডাকে জেঠামনি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া উপাধি ছিল রায়বাহাদুর। সে নামেও তাঁকে ডাকতেন অনেকে। কিন্তু তিনি সেই অভিজাত সম্বোধন পছন্দ করতেন না। তবে আর পি সাহা নামটিই ছিল সাধারণের মধ্যে অধিক পরিচিত। দাতা বা দানবীর এই মানুষটি মির্জাপুরবাসীর কাছে আজও জেঠামনি হিসেবেই যেন ঘরের মানুষ, প্রাণের ভালোবাসার মানুষটি। এক উচ্চতর মূল্যবোধের অধিকারী, বিস্ময়কর রকম শক্তিমান মানুষ ছিলেন দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা। তাঁর প্রাণশক্তি, শ্রমশক্তি ও চিন্তাশক্তি ছিল বিস্ময়কর। আর বোধের জায়গাটিতে—মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করাকে তিনি মানবীয় কর্তব্য মনে করতেন। পৃথিবীকে সবার জন্য সুখকর করে তোলা সম্ভব এই বিশ্বাসেই তিনি জনহিতকর কাজ করে যেতেন অক্লান্তভাবে। এই ব্রত থেকেই লাভ করেছিলেন ‘দানবীর’ অভিধা। তাঁর কীর্তির চেয়ে অনেক বড় ছিলেন তিনি।
রণদা প্রসাদ সাহার জন্ম ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর, টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কম্পাউন্ড থেকে পুত্র ভবানী প্রসাদসহ তাঁকে রাতের গভীরে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তারপর তাঁদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। ৭৪ বছরের কর্মময় জীবন রণদা প্রসাদ সাহার।
মির্জাপুর তখন একেবারেই অজপাড়াগাঁ। পিতা দেবেন্দ্র সাহার নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না। রুটিরুজির সন্ধানে বারবার তাঁকে পেশা বদল করতে হয়েছে। বেশির ভাগ সময়ে দলিল লেখকের কাজ করেছেন তিনি।
প্রসবকালে ধনুষ্টঙ্কারে অকালে মারা যান মা কুমুদিনী দেবী। তিনি রোগশয্যায় না পেয়েছেন এতটুকু ওষুধ-পথ্য, না পেয়েছেন সেবাযত্ন। শৈশবের এই অসহ্য স্মৃতি রণদা প্রসাদকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এমনভাবে যে পরবর্তীকালে তাঁকে তা একজন সেবকে পরিণত করেছিল। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুস্থ মানুষের সেবাপ্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী’।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় মাতৃভক্তির কথা আমরা সবাই জানি। রণদা প্রসাদ বিদ্যাসাগরের মতো মাতৃভক্তি দেখানোর সুযোগ পাননি। তিনি মাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। মায়ের স্নেহের আঁচল জড়িয়ে ধরতে না ধরতে তিনি বিদায় নেন। অভাবের সংসারে প্রসূতি মায়ের যত্ন দূরে থাকুক, উপযুক্ত আহারই সময়মতো জোটেনি। চিকিৎসার জন্য সারা গ্রাম খুঁজে একজন ডাক্তারও সেদিন মেলেনি কিংবা অর্থাভাবে কোনো ডাক্তার আনা যায়নি। প্রসবকালে ধনুষ্টঙ্কারে অকালে মারা যান মা কুমুদিনী দেবী। তিনি রোগশয্যায় না পেয়েছেন এতটুকু ওষুধ-পথ্য, না পেয়েছেন সেবাযত্ন। অশৌচের অসিলায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুই ছিল তখনকার দিনে মেয়েদের এক মর্মান্তিক নিয়তি। মায়ের এই মৃত্যুদৃশ্যের নীরব দর্শক ছিল সাত বছরের অবোধ বালক রণদা প্রসাদ। শৈশবের এই অসহ্য স্মৃতি রণদা প্রসাদের নিদ্রা-জাগরণের প্রতিটি মুহূর্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এমনভাবে যে পরবর্তীকালে তাঁকে তা একজন সেবকে পরিণত করেছিল। নিজের মায়ের জীবন দেখে তিনি নারী জীবনের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করেন এবং নারী জাতির কল্যাণ্যে কিছু করার সংকল্প গ্রহণ করেন। সামর্থ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দুঃখ-স্মৃতিকে রূপ দিয়েছিলেন দুস্থ মানুষের সেবাপ্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী’তে—স্থাপন করেছিলেন মাতৃভক্তির এক অনন্য নজির।
রণদা প্রসাদ সাহা কোলাজ