Prothomalo:
2025-10-04@07:00:14 GMT

দাও

Published: 4th, October 2025 GMT

ফুয়াদ বড় হচ্ছে নানা রকম স্বপ্ন দেখতে দেখতে। বাজারে ওর আব্বা টিকতে পারছে না। গ্যাং না করলে কেউ আর বাজারে টিকতে পারে না। একদিকে বাজারে ওর আব্বার দোকানটা পড়ে যাচ্ছে, মানে ব্যবসা নেই বলা চলে। অন্যদিকে দাদার আমলের পুরোনা কাঠের বেড়ার বাড়িটা খসে খসে যাচ্ছে। বাজার আর বাড়ির মাঝখানে খালের পানি দিনে দিনে বেশি ঘোলা হচ্ছে। অথচ বাজার কিন্তু আরও সরগরম। আগে থানে, দোকানে কুপি জ্বলত। এখন হ্যাজাক জ্বলে। শোনা যাচ্ছে কারেন্টের লাইন আসবে। তারপরও একটাই ঘর ফুয়াদের বাপের।

সেই ঘরের এক চিকন চকিতে ফুয়াদ ঘুমায়। ঘরের আরেক দিকে, আরেক চকিতে ওর বাপ-মা। ওর চকিটা টলমলে এক জানালার ধারে। জানালাটা বন্ধ করার উপায় নেই, ভাঙা, তাই বাতাস ঢুকে রাতে মলিন পর্দা ফরফর করে ওড়ে। তখন ফুয়াদের ভয় লাগে। এই রকম রাতেও বালিশের নিচে পিঁপড়ারা লাইন করে আসা-যাওয়া করে। কুট করে কামড়ায়। চমকে পাশ ফিরতে গেলে চকির পায়া যখন ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তোলে, তখন ফুয়াদ লাথি দিয়ে ক্যাচকেচানি থামায়ে দেয়। তারপর কান পেতে থাকে—বাজার থেকে ভেসে আসা গমগম আওয়াজ কমতে শুরু করে। ফুয়াদ চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করে। কিন্তু দুই চোখ বন্ধ হতে চায় না। ওর আব্বা নানার বাড়ি বেড়াতে গেছে—আসলে ভালো-মন্দ খাইতে গেছে, ঘরেতে অভাব। রাত বাড়ে। খাওয়ার জন্য নানার বাড়ি বেড়াতে যেতে ওর মন চায় না। ভাবতে ভাবতে অন্ধকারে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে চৌকাঠে কার যেন ছায়া। সুনসান। দরজায় খিল না থাকায় বাতাসে খুলে যায়, আবার বন্ধ হওয়ার চেষ্টা করে একটা কপাট, কিন্তু বন্ধ হতে পারে না—দোলে। স্পষ্ট দেখা যায় যে ছায়াটা লম্বা হচ্ছে।

বাইরে রাতটা অদ্ভুত। শুকনা ও ঠান্ডা। ছয় দিন ধরে যে বৃষ্টি একটানা হলো, আজ তার বিরতি। ঘরের সামনে, একটু দূরে, নালায় জমে থাকা ঘোলা পানির ওপর ভাসতে থাকা কচুরিপানার গন্ধ ঘরে আসে। জাগ দেওয়া পাটের তীব্র গন্ধ নাকে লাগে।

ফুয়াদ বাইরে বের হয়। মা চোখ বন্ধ করে আছে, নাক ডাকার আওয়াজ শুরু হবে একটু পরে। নালার ওপারে বাজারের লোকজন, দোকানদার, দড়িতে ঝুলে থাকা রঙিন কাগজ, টিনের বাঁশি, শ্রীপুরের ট্যাবলেটের ক্যানভাসার, চিনি গলায়ে রং ঢেলে লাঠির মতো মিষ্টি বানানো—সব দেখা যায়। সেখানে রাস্তার ওপরে হ্যাজাক ঝোলানো—সোনালি-রুপালি রং। তার নিচে কয়েকজন সং। ঘামে চকচক করে তাদের মুখ। গলায় ঝোলানো ড্রাম। রাতে বাজানো নিষেধ। হাতে, মাথায়, ঘাড়ে মালসামান নিয়ে লোকজন একে অন্যকে ঠেলে বাজার ছাড়ছে। ঘুগরি পোকার ডাক বড় হচ্ছে। হ্যাজাকগুলো একটা একটা করে নিভে যাচ্ছে। অন্ধকারে সবকিছু ভূতের মতো লাগে।

ফুয়াদ আবার ঘরে ঢুকল। মায়ের গলা শুনতে পেল। একটা গীত। সুর চেনা, কথা পুরানা। শুনতে শুনতে ফুয়াদের মুখস্থ। একলা মানুষের রাতের অভ্যাস। দুপুর রাত! ওদের ঘড়ি নেই। তবু দেহের মধ্যে যে ঘড়ি থাকে, সেটা নদীর ঢেউয়ের মতো সময় গুনে চলে। জানালার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসার সঙ্গে সঙ্গে সে বিছানার চাদর অর্ধেক তুলে নিজেকে জড়িয়ে ধরল।

ফুয়াদ দাও ফেলে একলাফে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। চকির পায়া ক্যাচ করে উঠল। মার নাকডাকার আওয়াজ শুরু হয়েছে। তখন সে, দরজায় দাঁড়ায়ে আছে একজন পুরুষ লোক, দেখল। দুইটা দাঁত ঠোঁটের সামান্য বাইরে। মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। চোখ জ্বলজ্বল করছে। বিড়ালের মতো।

ঘুগরির কিরকিরানি ছাপিয়ে দূরে কেউ নালার ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাসে। চাপা গলায় একজন কইল—আল্লায় বিচার করবে। মনে হলো কথাটা মুখ দিয়ে বের হবার আগেই গলার ফাঁক দিয়ে ঘড় ঘড় করে উঠল। তারপর চুপ। এমন সময় কাঠের দরজার পাল্লায় টুপ টুপ শব্দ। দরজার কাছে এগিয়ে শব্দটা নিজের নিশ্বাস শোনার মতো সে শোনে। বুকের ভেতর শব্দ করে ওঠা ধুপধুপানি হাত দিয়ে চাপা দিয়ে থামাতে চায়। মায়ের গলা থেমে গেল। বাজারের ওদিকটা এখন সম্পূর্ণ সুনসান। শিয়াল ডাকছে কোথাও। দরজার ঠিক ওপাশে কেউ অবশ্যই দাঁড়ানো। তাকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ছায়াটা আছে। আলো ছাড়া ছায়া ভালো কথা নয়। ফুয়াদ নিশ্চিত হয়, সে একা নয়; আরও কেউ আরেক দিক থেকে এই রাতকে শুনছে। ঘাড়ের ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে গেল। মনে হলো কেউ পাশ দিয়ে দৌড় দিল।

জানালার বাইরে অর্ধেক চাঁদ। রাস্তাটা চুপচাপ লম্বা আউলা-ঝাউলা হয়ে শুয়ে আছে। এখানে–ওখানে পানি জমে থাকা জায়গাগুলো কালচে। পাশের বাড়ির খুলিতে ঝুলতে থাকা কাপড়গুলোকে মনে হচ্ছে আঁকা ছবি। জোছনার আভা ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতরে। টিকটিক শব্দ হলো। খসে পড়তে থাকা কাঠের বেড়ার ওপর একটা টিকটিকি নড়ল। সে টিকটিকির আবার ডানা আছে, ডানা মেলে বেড়ার ওপর বসে আছে—এমনটাই মনে হলো ফুয়াদের। আর শব্দ নেই, তবু মনে হয় ঝিমঝিম শব্দ শোনা যাচ্ছে মাথার ভেতরে। টিকটিকিটা বিছানার দিকে নেমে আসবে, নাকি সোজা ওপরের দিকে উঠবে, বোঝা যাচ্ছে না। ফুয়াদ এমনভাবে চকির ওপর বসল, যেন বাতাসও বুঝতে না পারে। দরজার ওপাশে কে, সেটা দেখতে হবে। তোশকের তলা থেকে দাদার আমলের ভারী ‘দাও’ বের করে হাতে নিল। ছায়াটা নড়ে উঠল। মিলায়ে গেল।

ফুয়াদ দাও ফেলে একলাফে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। চকির পায়া ক্যাচ করে উঠল। মার নাকডাকার আওয়াজ শুরু হয়েছে। তখন সে, দরজায় দাঁড়ায়ে আছে একজন পুরুষ লোক, দেখল। দুইটা দাঁত ঠোঁটের সামান্য বাইরে। মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। চোখ জ্বলজ্বল করছে। বিড়ালের মতো। ফুয়াদ আধখোলা চোখে, পাপড়ির ফাঁক দিয়ে এমনভাবে তাকায়ে আছে, যাতে দেখতেও পারে আবার লোকটা বুঝতেও না পারে। মার নাকডাকা বদলাচ্ছে, কখনো খাটো, কখনো লম্বা হচ্ছে। সেই শব্দও কান খাড়া করে শুনছে দরজার মানুষটা, এমন মনে হলো। তারপর লোকটা ফিসফিস করে ডাকল—এ বাবা!

এই নামে একজনই ডাকে। দুপুরে দোকান বন্ধ করে ভাত খেতে এসে দূর থেকে ডাকতে শুরু করবে—এএএ বাবা। কিন্তু ওর আব্বা তো ভালো-মন্দ খাওয়ার জন্য বেড়াতে গেছে শ্বশুরবাড়ি! মানুষটা আবার বলল, ‘এ বাবা…’ তারপর আরও একবার। লোকটার মুখ থেকে তামাকের গন্ধের মতো স্মৃতি বের হচ্ছে। তার নিশ্বাসের শব্দ খানিক ঘন হলো, তারপর হালকা দীর্ঘশ্বাস। এমনভাবে তাকিয়ে থাকল যেন সে দ্বিধাগ্রস্ত—আরেকটু থাকব, নাকি চলে যাব! ফুয়াদ মাকে ডাকতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারল না।

মা ঘরে এসে বলল, ‘আজকে তোর পনেরো বছর হইল।’ তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘রাতে বাইরে গেছিলি ক্যান? বড় হইতে না হইতেই রাত-বিরেতে বাইরে যাস? গ্যাং করতেছিস না তো?’ ফুয়াদের ঘুম কাটেনি। সকালের নাশতার থালা বিছানার কিনারায় রাখল মা। বাসি ভাতের সঙ্গে ডিমের পোজ।অলংকরণ: মাসুক হেলাল.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আওয় জ ত রপর র ওপর দরজ র

এছাড়াও পড়ুন:

দাওয়াতের ভাষা হবে মিষ্টি ও সুন্দর

দাওয়াত মানে ডাকা বা আহ্বান করা। মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকে আনা, দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তির দিকে আহ্বান করাই এর মূল উদ্দেশ্য। এটি কেবল একটি ধারণা নয়; বরং প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব ও কাজ।

যেমন ডাক্তারি বিদ্যা ছাড়া চিকিৎসা করলে রোগীর প্রাণহানি হতে পারে, তেমনি দাওয়াতের জ্ঞান ছাড়া ময়দানে নামলে মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।

ভরা মজলিশে অশালীন ভাষা ব্যবহার বা কটু কথা বলা দাওয়াতের সঠিক পদ্ধতি নয়। এতে সাধারণ মুসলমান, বিশেষত কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণেরা ইসলাম ও আলেমদের থেকে দূরে সরে যেতে পারেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইসলামবিদ্বেষীরা সরল মুসলমানদের ইমান নিয়ে খেলতে পারে এবং নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে।

‘আপনার প্রভুর পথে দাওয়াত দিন জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সুন্দর নীতিসম্পন্ন উপদেশ দিয়ে। তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো এমনভাবে, যা সবচেয়ে সুন্দর।সুরা নাহল, আয়াত: ১২৫আরও পড়ুননারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কী বলে ইসলাম২৮ আগস্ট ২০২৫

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা আমাদের দাওয়াতের পদ্ধতি স্পষ্টভাবে শিখিয়েছেন, ‘আপনার প্রভুর পথে দাওয়াত দিন জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সুন্দর নীতিসম্পন্ন উপদেশ দিয়ে। তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো এমনভাবে, যা সবচেয়ে সুন্দর।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ১২৫)

এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, দাওয়াত মানে কেবল আহ্বান নয়; বরং শালীন, সদয় ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ভাষায় মানুষকে আল্লাহর পথে আনা। ঝগড়া বা কটু ভাষার পরিবর্তে সৌজন্য ও সদাচার দাওয়াতকে কার্যকর করে।

রাসুল (সা.) দাওয়াতের কাজে সর্বদা নম্রতা ও ভালোবাসার পরিচয় দিয়েছেন। কাফের-মুশরিকরা তাঁকে বিদ্রূপ করে ‘রাইনা’ (আমাদের দিকে তাকান) শব্দটির ভিন্ন উচ্চারণ করে (যার অর্থ হতো ‘আমাদের রাখাল’) ডাকত। তবু তিনি কখনো কটু কথা বলেননি; বরং শান্তভাবে ভালোবাসার ভাষায় দাওয়াত চালিয়ে গেছেন।

হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘সহজ করে দাও, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, ভয় দেখিয়ে মানুষকে দূরে সরিও না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৯; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৩৪)

আরও পড়ুননিজেকে অযোগ্য মনে হলে ইসলাম কী বলে১৭ আগস্ট ২০২৫সহজ করে দাও, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, ভয় দেখিয়ে মানুষকে দূরে সরিও না।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৯

এ হাদিসে দাওয়াত ও শিক্ষা প্রদানের মূলনীতি শেখানো হয়েছে। মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতে হবে সহজ ও বোধগম্য ভাষায়, যাতে তারা আকৃষ্ট হয়। কঠোরতা, জটিল নিয়ম বা ভয় দেখিয়ে কাউকে দূরে ঠেলে দেওয়া ইসলামের শিক্ষা নয়। ভালোবাসা, দয়া ও আশার বার্তাই সফল দাওয়াতের প্রকৃত পথ।

আমাদের দাওয়াতি মজলিশ হোক ভালোবাসা ও প্রজ্ঞার আলোকধারা, যেখানে ছড়িয়ে পড়বে সহনশীলতা ও সৌজন্য, হিংসা-বিদ্বেষের কোনো ছাপ থাকবে না। কোমল ও মমতাভরা আহ্বানে মানুষ আকৃষ্ট হবে, হৃদয় উন্মুক্ত হবে আল্লাহর স্মরণে।

আসুন আমরা এমন দাওয়াতের পরিবেশ গড়ে তুলি, যাতে আমাদের ভালোবাসার পরশে দূরে সরে যাওয়া মানুষেরাও ফিরে আসে প্রতিপালকের পথে, ইসলামের পথে।

শাব্বির আহমাদ খান: শিক্ষার্থী, আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া মাখজানুল উলুম খিলগাঁও, ঢাকা।

আরও পড়ুনউপহার দেওয়া সম্পর্কে ইসলাম১৩ আগস্ট ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দাওয়াতের ভাষা হবে মিষ্টি ও সুন্দর