মারওয়ান বারঘুতিকে মুক্তি দিতে ইসরায়েল কেন ভয় পায়
Published: 18th, October 2025 GMT
প্রতিবার গাজায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এলে বিশ্ব স্বল্পস্থায়ী এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু শান্তি কখনো আসে না। কারণটি খুব সহজ: ইসরায়েল কখনোই কোনো প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান চায়নি। যদি চাইত, তবে আলোচনার তালিকার শীর্ষে থাকত একটাই নাম—মারওয়ান বারঘুতি; বন্দী ফাতাহ নেতা, যার মুক্তি ফিলিস্তিনি রাজনীতিকে পুনর্নির্মাণ করতে পারে এবং বহুদিন ধরে ন্যায়বিচার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত একটি জাতির কাছে বৈধতা ফিরিয়ে আনতে পারে।
১৯৫৯ সালে পশ্চিম তীরের কোবার গ্রামে জন্ম নেওয়া বারঘুতি ১৫ বছর বয়সে ফাতাহতে যোগ দেন। ইসরায়েলি দখলদারির বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ। বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি পরিচিত হন তাঁর বাকপটুতা ও বাস্তববাদী নেতৃত্বের জন্য। ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদার সময় ইসরায়েল তাঁকে বহিষ্কার করে। কারণ, তারা ভয় পায় শৃঙ্খলাপূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তরুণদের সংগঠিত করার বারঘুতির ক্ষমতাকে।
আরও পড়ুনহামাস যেভাবে ইসরায়েলের ‘অপরাজেয়তার মিথ’ ভেঙে দিল২৪ এপ্রিল ২০২৫বারঘুতির জীবন মূলত সংগ্রামেরই ইতিহাস। নির্বাসনে কাটানো বছরগুলো—বিশেষত জর্ডান ও তিউনিসিয়ায়—তাঁকে পিএলওর (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) সঙ্গে যুক্ত করে এবং কূটনীতির পাঠ শেখায়। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তিনি তাতে সতর্ক আশাবাদ নিয়ে সমর্থন করেছিলেন; মুক্তির পথে একটি সম্ভাব্য ধাপ হিসেবে, চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে নয়। পশ্চিম তীরে ফিরে এসে ১৯৯৬ সালে তিনি ফিলিস্তিনি আইনসভা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ফাতাহর ভেতরে তিনি হয়ে ওঠেন গণতান্ত্রিক সংস্কার, জবাবদিহি ও সাম্যের ভিত্তিতে টেকসই শান্তির পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠগুলোর একটি।
কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বারঘুতির হতাশা বাড়তে থাকে। তিনি দেখলেন, অসলো পরিণত হচ্ছে স্থায়ী দখলদারির প্রক্রিয়ায়। ইসরায়েলি বসতি বাড়ছে, চেকপোস্ট বাড়ছে, আর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) ইসরায়েলি নিরাপত্তাব্যবস্থার উপঠিকাদার হয়ে পড়ছে। তিনি সতর্ক করেছিলেন, ‘দখলদারির মধ্যে শান্তি বেড়ে উঠতে পারে না।’ কিন্তু তখন কেউ তাঁর কথা শোনেনি।
বারঘুতির দীর্ঘ বন্দিত্ব ঘিরে আন্তর্জাতিক নীরবতা পশ্চিমা গণতন্ত্রচর্চার দ্বিচারিতা উন্মোচন করে। একই সঙ্গে এটি সেই সম্ভাবনাও প্রকাশ করে—বারঘুতির প্রত্যাবর্তন ফিলিস্তিনি নাগরিক সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে, ন্যায়, মর্যাদা ও আইনের ভিত্তিতে এক নতুন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।২০০০ সালে আরিয়েল শ্যারন আল-আকসা মসজিদে তাঁর কুখ্যাত সফর করেন, যা দ্বিতীয় ইন্তিফাদার জন্ম দেয়। তখন বারঘুতি কোনো প্রান্তিক যোদ্ধা নন, তিনি মূলধারার নেতা, যিনি বুঝেছিলেন যে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র—দুই ধরনের প্রতিরোধই এখন ইসরায়েলেকে মোকাবিলার একমাত্র ভাষা।
২০০২ সালের এপ্রিলে ইসরায়েলি বাহিনী বারঘুতিকে রামাল্লাহ থেকে অপহরণ করে। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ এবং ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য’ হওয়ার অভিযোগ আনা হয়। পুরো বিচার চলাকালে তিনি আদালতেরই বৈধতা স্বীকার করতে অস্বীকার করেন। তাঁর ঘোষণা ছিল, ‘আমি সন্ত্রাসী নই, আমি স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা। প্রকৃত অপরাধ হলো দখলদারি।’ আদালত তাঁকে পাঁচবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
এই বিচার আন্তর্জাতিক মহলে ‘রাজনৈতিক নাটক’ হিসেবে নিন্দিত হয়। কিন্তু তাঁর বন্দিত্ব তাঁকে ফিলিস্তিনের ‘ম্যান্ডেলা’য় পরিণত করে, হয়ে ওঠেন প্রতিরোধের এক প্রতীক, নৈতিক দৃঢ়তা ও গণতান্ত্রিক নবজাগরণের প্রতীক।
ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের দখলদারি দেওয়ালে ফাতাহ নেতা মারওয়ান বারঘুতির গ্রাফিতি.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ইসর য় ল দখলদ র
এছাড়াও পড়ুন:
পৌর কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি নিশ্চিত করুন
‘উন্নয়ন প্রকল্প’ যে অনেক সময় সুপরিকল্পিত দখলদারির অংশ হতে পারে, তার আরেক উদাহরণ দেখা গেল যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলায়। সেখানে চিত্রা নদীতে দখলের নেতৃত্ব দিচ্ছে কোনো ভূমিদস্যু বা অপরাধ চক্র নয়; এর নেতৃত্ব দিচ্ছে পৌরসভা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের টাকায়, রাষ্ট্রের নামেই, রাষ্ট্রের আইন ভেঙে রাষ্ট্রীয় সম্পদ দখলের এক খারাপ নজির স্থাপন করা হচ্ছে।
ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল, ১৯৯০ স্পষ্ট ভাষায় বলছে, যে স্থান শুষ্ক মৌসুমে চর পড়ে এবং বর্ষায় পানিতে তলিয়ে যায়, তা নদীতট বা ফোরশোর। এই ভূমির ওপর কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা দপ্তরেরই কোনো অধিকার নেই। এখানে কোনো ভবন তোলা তো দূরের কথা, সীমানার খুঁটি বসানোরও আইনগত সুযোগ নেই। অথচ এ নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে চিত্রা নদীর বুকেই একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে—পৌরসভা ভবন, শৌচাগার, দলীয় কার্যালয়, দোকান, স্মৃতিস্তম্ভ। আর এবার সেই দখলকে পাকাপোক্ত করতে নদীর ভেতর কংক্রিটের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করছে বাঘারপাড়া পৌরসভা।
যে পৌরসভার জনগণের সেবা দেওয়ার কথা, সেই পৌরসভাই যদি নদী দখল করে, তাহলে যে বার্তা যায়, তা হলো আইন দুর্বল মানুষের জন্য; শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান চাইলেই তা অমান্য করতে পারে। এ বার্তা পরিবেশ ধ্বংসের চেয়েও ভয়াবহ। ২০২০ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, সেখানে স্পষ্টভাবে চিত্রা নদী দখলের চিত্র উঠে আসে। সেখানে দখলদার হিসেবে পৌরসভার নামও রয়েছে। এরপরও যদি নদীর ভেতর সীমানাপ্রাচীর দাঁড় করানো হয়, তবে সেটি কেবল আইন ভঙ্গ নয়, এটি আদালত ও কমিশনের প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ।
আরেক দিকে সরকারেরই পানি উন্নয়ন বোর্ড জানাচ্ছে, ৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে চিত্রা নদী পুনঃখনন করা হবে। অর্থাৎ এক হাতে নদী উদ্ধারের প্রকল্প, আর অন্য হাতে নদী দখলের অবকাঠামো। এ যেন রাষ্ট্রের দুই হাতেই একে অপরের গলা টিপে ধরা! এই দ্বিচারিতা কেবল হাস্যকর নয়, এটি সুশাসনের কফিনে পেরেক ঠোকার শামিল।
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তার বক্তব্য, ‘আমি নতুন এসেছি, জানতাম না।’ এটি কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হতে পারে না।
চিত্রা নদীর ভেতরে চলমান সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ইতিমধ্যে যে অংশ নির্মিত হয়েছে, তা দ্রুত ভেঙে ফেলতে হবে। পৌরসভার জড়িত কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। নদী দখলের সঙ্গে যুক্ত সব স্থাপনার তালিকা প্রকাশ ও উচ্ছেদ পরিকল্পনা শুরু করতে হবে। আমরা আশা করি, নদী রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় প্রশাসন আশু পদক্ষেপ নেবে।