‘মিস ইন্ডিয়া’ হয়ে খ্যাতির শীর্ষে, ২৬ বছর বয়সে সেই নায়িকার করুণ মৃত্যু
Published: 23rd, November 2025 GMT
১৯৯৭ সালে ফেমিনা মিস ইউনিভার্সে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। বয়স তখন মোটে ১৯। পরে নাম করেন মডেলিংয়ে, আগামী দিনের প্রতিশ্রুতিশীল তারকা মনে করা হচ্ছিল তাঁকে। কিন্তু কে জানত, তাঁর জীবন থেমে যাবে মাত্র ২৬ বছর বয়সেই। এই অকালপ্রয়াত তারকা আর কেউ নন, নাফিসা জোসেফ।
ছোটবেলা ও ক্যারিয়ার
নাফিসা জোসেফের জন্ম ২৮ মার্চ ১৯৭৮ সালে, দিল্লিতে। তবে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুতে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি ফেমিনা মিস ইন্ডিয়া ইউনিভার্স খেতাব জিতেছিলেন; মায়ামি বিচে অনুষ্ঠিত মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার ফাইনালিস্ট হন।
নাফিসা মাত্র ১২ বছর বয়সে মডেলিং শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এমটিভির জনপ্রিয় ভিডিও জকি হিসেবে পরিচিতি পান। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে এমটিভি হাউসফুল সঞ্চালনা করেন, যা তাঁকে উপমহাদেশজুড়ে পরিচিতি এনে দেয়।
পরে সুভাষ ঘাইয়ের ‘তাল’ ছবিতে অতিথি চরিত্রে তাঁকে দেখা যায়। সিনেমাটির মূল চরিত্রে ছিলেন ঐশ্বরিয়া রাই, অনিল কাপুর ও অক্ষয় খান্না।
প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা
নাফিসা ছিলেন একজন প্রকৃত প্রাণিপ্রেমী। তিনি বিভিন্ন প্রাণিপ্রেমী দাতব্য সংস্থার জন্য সচেতনতা তৈরি করতেন। এ বিষয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সাপ্তাহিক কলামও লিখতেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বছর বয়স
এছাড়াও পড়ুন:
বাউল-পালাকার-বয়াতিরা কাদের শত্রু
বাউল-পালাকার-বয়াতিদের ওপর আক্রমণ যেন কিছুতেই থামছে না। সরকার আসে যায় কিন্তু তাঁদের ওপর ধকল রয়ে যায়। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এই দেশে কয়েক ডজন মাজার ভাঙা হয়েছে, মাজারের মৃত পিরকে কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটেছে।
গত এক দেড় বছরে বেশ কয়েক জায়গায় সংগীতের অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে, আক্রমণের মতো ঘটনাও ঘটেছে। আর সর্বশেষ এই তালিকায় যোগ হয়েছে মানিকগঞ্জের বিখ্যাত পালাগানের শিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেপ্তারের ঘটনা।
কয়েক দিন আগে একটি অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনের সময় ধর্ম অবমাননা ও কটূক্তির অভিযোগে করা মামলায় আবুল সরকারকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এই লেখাটি যখন লিখছি (২৩ নভেম্বর), তখন খবর পেলাম কথিত ‘তৌহিদি জনতা’ হামলায় আবুল সরকারের সমর্থকেরা আহত হয়েছেন। হামলা থেকে বাঁচতে কয়েকজন পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছেন, এমন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনা নাগরিক সমাজকে বিক্ষুব্ধ করেছে।
শুধু আবুল সরকার নয়, এর আগে ২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একইভাবে পালা গানের আসরে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বাউল শিল্পী রিতা দেওয়ানকে। একই বছর শরিয়ত সরকার নামের আর এক বয়াতিকে ইসলামের কটূক্তির অভিযোগে গ্রেপ্তারের মতো ঘটনা ঘটে।
অধ্যাপক ইউনূস সরকারের আমলে গত বছরের ২৫ নভেম্বর যশোরে বাউল শিল্পীদের দুই দিন ব্যাপী সাধু সংঘের বাউল গানের আসর ভন্ডুল করা হয় (ইত্তেফাক, ২৬ নভেম্বর ২০২৪)। চলতি বছর জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বাউল গানের আসর বন্ধ করে সেখান থেকে বাদ্যযন্ত্র জব্দ করে পুলিশ ( ডেইলি স্টার, জানুয়ারি ৯, ২০২৫)। পরের মাসেই মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে প্রয়াত বাউল শিল্পী রশিদ সরকারের ‘সাধুর মেলা' স্থানীয়দের বাধায় পণ্ড করা হয়েছে (বিডিনিউজ, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৫)।
প্রশ্ন হলো, দমন-পীড়নের কারণে শেখ হাসিনা সরকারকে ছাত্র-জনতার উত্থানে বিদায় জানানোর পরও এই দেশে কেন সবার হচ্ছে না? অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হওয়ার পরও তাঁর সরকার ভিন্নমত কিংবা সংগীতে সাধনায় নিমগ্ন অত্যন্ত পুরোনো ধারার মানুষদের ওপর মামলা-মোকদ্দমা কিংবা নির্যাতনের ঘটনা কেন সামাল দিতে পারছে না?
এই অঞ্চলে ধর্ম প্রচারণা কিংবা সুফিবাদ চর্চায় যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন সেই ফকির-বাউলদের গলা-ছেড়ে গান গাওয়ার স্বাধীনতা রুদ্ধ করতে চায় একটি গোষ্ঠী। তাদের কবল থেকে উদারপন্থী মানুষগুলোকে কি আমরা মুক্ত করতে পারব না?
এই দেশের সংস্কৃতিতে মিশে থাকা যে মানুষগুলোর গন্ধে বাংলাদেশ নামক দেশটির ঐতিহ্য বিশ্ববুকে ধরা পড়ে, সেই গোষ্ঠীকে কোণঠাসা করা মূলত এই দেশের গৌরবময় ইতিহাসকে অবহেলার শামিল। সুফি গায়ক, পালাকার, বয়াতি, বাউলরা কখনোই কোনো শাসক গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানুষের শত্রু নয়। এরা ধর্মেরও শত্রু নয়। বরং ধর্মকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে, মানুষের ভেতর সুপ্ত আধ্যাত্মিক চিন্তাশীলতাকে শাণিত করতে তাঁরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে পালাগান করেন। পালাগানের ছলে ধর্মের কঠিন বিষয়গুলো মানুষের সামনে সহজভাবে উপস্থাপন করেন।
বাউল-বয়াতি-গায়েনদের এই সংগীতচর্চা ও রীতি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অংশ। তাঁদের উপেক্ষা করে বাংলাদেশের অস্তিত্বের কোনো দাম নেই। বরং তাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ধর্মীয় উদারতার দিকেই পথ দেখায়, যেটা সৃষ্টিকর্তার ধর্মীয় গ্রন্থেরও বড় শিক্ষা।
কিন্তু আমরা করছি কি, তাঁদের দার্শনিক কিংবা স্যাটায়ারমূলক আলোচনা না বুঝে, ধর্মীয় অনুভূতির মতো কঠিন ও স্পর্শকাতর বিষয় সামনে এনে মূলত এই সম্প্রদায়কে নিখিলে বিচরণ সংকুচিত করে দিচ্ছি। পুলিশি বাঁধাসহ কথিত তৌহিদি জনতার মাধ্যমে মব করিয়ে মূলত নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে ব্যস্ত থাকছি। প্রকৃতপক্ষে এখানে মানবতার পরাজয় পরিলক্ষিত, এমনকি বিবেকের বিকাশ বন্ধ করার মতো কাজ করি যাচ্ছি।
মনে রাখতে হবে, পালাকার-বয়াতি-বাউলরা কখনোই ধর্মবিরোধী মানুষ নন। তাঁরা কখনো নিজেদের 'নাস্তিক' দাবি করেন না, কিংবা নাস্তিকতার প্রচারণা করেন না। বরং ধর্মের মহিমান্বিত করার কাজগুলো গানের ছলে বলে যান। কথিত কাগুজে সনদের শিক্ষিত হওয়ার চেয়েও এই মানুষগুলো মানুষের প্রায়োগিক শিক্ষায় শিক্ষিত, যা সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ইতিবাচকতার পথ দেখান।
কিন্তু আফসোস এই মানুষগুলো সব সময় একটি গোষ্ঠীর আক্রোশের শিকার হয়েছেন। আগের সরকারগুলোর সময়ও হয়েছেন, এখনো হচ্ছেন। গত এক দেড় বছরে মাজার-খানকায় হামলার মধ্য দিয়ে এর মাত্রা বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মবের মধ্যে দিয়ে সুফি গায়ক-বাউল-বয়াতিদের বিরুদ্ধে যেসব ভয়াবহ ভয়ানক স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, তা খুবই ভীতিকর। কী সেলুকাস, একজন গায়কের গানকে কেন্দ্র করে খুনোখুনির আয়োজন সম্ভবত আমাদের দেশেই হয়ে থাকে। অথচ যে মানুষগুলো শ্রম ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানুষের জন্য পঙ্ক্তিমালা তৈরি করল, তাঁরায় এখন উগ্রবাদীদের গ্রাসে পরিণত হচ্ছে।
যদিও যেদিন শিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়, ওই সময়ে সরকারের প্রচারণার ফেসবুক পেজ থেকে সংস্কৃতিঙ্গনে কী কী ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তাঁর নির্লিপ্ত প্রচারণা হচ্ছে।
যখন যে সরকারই থাকুক, কিন্তু এসব মানুষের নিরাপত্তার বিধান না থাকলে তাঁরা তাঁদের সংগীতচর্চা থেকে আস্তে আস্তে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন। বহুমত ও বহু পথের যাত্রা সংকুচিত হবে, নিশ্চয়ই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটা চায় না। কিন্তু সরকারের ভেতর লুকিয়ে কোনো শক্তি উদারপন্থী মানুষগুলোকে সমাজের দৃশ্যপট থেকে বিতাড়িত করায় প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
জানি এত কিছু বলার পরও সরকারের কোনো কর্ণপাত হবে না। হয়তো বলবে, কিছুদিন আগে কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়ায় সাধু-সন্তুরা সফলতার সঙ্গে উদ্যাপন করেছে। কিন্তু বাউলদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনে এই সরকারের ভাবমূর্তি বিশ্ব দরবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকছে তা কি সরকার টের পাচ্ছে না?
মনে রাখতে হবে, এই দেশ সবার। সবার জন্য নিরাপদ ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিনির্মাণে সরকারকে কঠোর ও দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এটা করা না গেলে, বাংলাদেশ নামক এক রাষ্ট্রের চারপাশে অন্ধকারের ঘনঘটা বিরাজ করবে, যা থেকে কেউই পরিত্রাণ পাবে বলে মনে হয় না। আশা করি পালাশিল্পী আবুল সরকারের দ্রুত মুক্তিই সরকারের দৃষ্টির প্রসারতা ঘটাবে।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]