খুলনায় আদালত পাড়ায় জোড়া খুন: ৪ বিষয় সামনে রেখে তদন্তে পুলিশ
Published: 1st, December 2025 GMT
খুলনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান ফটকের সামনে দুই শীর্ষ অপরাধী হাসিব হাওলাদার এবং ফজলে রাব্বি রাজন হত্যার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তা জোড়া খুনের পিছনে চারটি সম্ভাব্য কারণ যাচাই করছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো মামলা করা হয়নি। এখনো পর্যন্ত সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার হয়নি।
আরো পড়ুন:
খুলনায় ১৬ মাসে ট্রিপল-ডাবলসহ ৪৮ খুন
আলোচিত রায়হান হত্যার রায় ৭ জানুয়ারি
রবিবার (১ ডিসেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খুলনার আদালত পাড়ায় সন্ত্রাসীদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে ফজলে রাব্বি রাজন ও হাসিব হাওলাদার নিহত হয়। তারা মামলার আসামি হয়ে আদালতের শুনানিতে হাজিরা দিতে আসেন।
খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম সোমবার (১ ডিসেম্বর) বলেন, ‘‘পরিবারের পক্ষ থেকে না করলে পুলিশ অভিযোগকারী হিসেবে মামলা করবে। এখনো কোনো সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার হয়নি।’’
খুলনার নতুন কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দুই শীর্ষ চরমপন্থি নেতা নাসিমুল গণি ওরফে নাসিম এবং আরমান শেখ ওরফে আরমিন হাইকোর্টের জামিনে মুক্তি পাওয়ার মাত্র দুই দিন পরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। উভয়ই দৌলতপুরভিত্তিক অপরাধী ‘টাইগার খোকন’ হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। জোড়া খুনের পর থেকে তারা আত্মগোপনে রয়েছেন।
নাসিমুল গণি ওরফে নাসিম এবং আরমান শেখ ওরফে আরমিন কারাগার থেকে মুক্তির পর খুলনার অপরাধ জগতে অস্থিরতা বেড়েছে। খুলনায় বর্তমানে সাতটি বড় গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী চরমপন্থি এবং অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্যের লড়াইয়ের অংশ হিসেবে আরো আক্রমণ চালাতে পারে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা আশংকা করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘‘রবিবারের (৩০ নভেম্বর) ঘটনার সময় আদালতে কর্তব্যরত পুলিশের কাছে কেবল লাঠি ছিল, আগ্নেয়াস্ত্র নয়। যার ফলে হস্তক্ষেপ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অপরাধীদের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হয়।’’
পুলিশ জানায়, কুখ্যাত গ্যাং লিডার ‘রনি চৌধুরী বাবু ওরফে গ্রেনেড বাবু গ্রুপ’ এই জোড়া খুনে জড়িত। খুলনা কারাগারে বাবুর সমর্থকদের সঙ্গে পলাশ গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনার সময় রাজন ও হাসিব কারাগারে ছিল এবং সংঘর্ষে অংশ নেয়। এর প্রতিশোধ নিতে জোড়া খুনের হামলা হতে পারে।
তদন্ত কর্মকর্তারা চারটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কাজ করছেন। এগুলো হলো, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পরবর্তী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পরিবর্তনের পর মাদক নেটওয়ার্কের প্রতিদ্বন্দ্বিতা; চাঁদাবাজি নিয়ে বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তার; বাবু গ্রুপ এবং পলাশ অনুসারীদের মধ্যে সম্প্রতি কারাগারে সংঘর্ষের প্রতিশোধ এবং সোনা, অস্ত্র এবং মাদক চোরাচালানের রুট নিয়ে প্রতিযোগিতা।
কেএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) ত.
জোড়া খুনের তদন্তে অগ্রগতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ আইনজীবী এবং পথচারীদের ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। দ্রুত খুনিদের গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা রয়েছে।’’
ঢাকা/নুরুজ্জামান/বকুল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর হত য কর মকর ত অপর ধ আরম ন তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত খুলনা: ১৬ মাসে ট্রিপল-ডাবলসহ ৪৮ খুন
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গত ১৬ মাসে খুলনায় ট্রিপল ও ডাবলসহ ৪৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে সন্ত্রাসীদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, মাদক ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে হত্যাকাণ্ড হয়েছে ২০টি। চলতি নভেম্বর মাসেই সাতজনকে হত্যা করা হয়েছে। রবিবার (৩০ নভেম্বর) খুলনার আদালত পাড়ায় প্রকাশ্যে দুইজনকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একইদিন রাতে নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় আরো এক যুবককে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
একের পর এক হত্যাকাণ্ডে ভয় আর আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে খুলনা। দিন-দুপুরে আদালত এলাকার মতো জনবহুল জায়গায় হত্যাকাণ্ড স্থানীয় বাসিন্দাদের আরো উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
আরো পড়ুন:
আলোচিত রায়হান হত্যার রায় ৭ জানুয়ারি
খলাপাড়ার গণহত্যা দিবস: স্বাধীনতার প্রান্তে শহীদ হন ১০৬ জন
পুলিশের তথ্য বলছে, গত ১৬ নভেম্বর দুপুরে নগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনারের কালভার্ট এলাকায় বাড়ির মধ্যে নানি মহিতুন্নেসা (৫৫), তার নাতি মুস্তাকিম (৮) এবং নাতনি ফাতিহাকে (৬) হত্যা করা হয়। ওই রাতেই করিমনগরে নিজ বাড়ির ভেতর আলাউদ্দিন মৃধা নামের এক যুবককে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। গত ২৭ নভেম্বর রাতে খালিশপুর ফেয়ার ক্লিনিকের সামনে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় যুবক ইমানকে।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) কর্মচারী মো. মহসিন শেখ লিটুর বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল সন্ত্রাসীরা। ২৮ অক্টোবর ভোর ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে মহানগরীর দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা খুঠিরঘাট এলাকার ওই বাড়িতে গুলিবর্ষণ হয়। তবে, কেউ আহত হননি।
গত ৯ অক্টোবর সকালে খালিশপুর হাউজিং বাজার এলাকায় সবুজ খান (৫৫) নামে এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। গত ৪ সেপ্টেম্বর রাতে খুলনার রূপসা উপজেলায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ইমরান হোসেন মানিক (৩৪) নামে এক যুবক নিহত হন।
সে সময় রূপসা থানার ডিউটি অফিসার জনি আহমেদ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, “রাতে মানিক একটি ভ্যানযোগে ইলাপুরের দিকে যাচ্ছিলেন। এসময় কয়েকজন সন্ত্রাসী তার গতিরোধ করেন। তারা মানিককে লক্ষ্য করে পরপর দুইটি গুলি ছোড়েন। একটি গুলি মানিকের মাথায় লাগে। তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।”
এর আগে, ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে খুলনা মহানগরীর রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে প্রকাশ্যে এক যুবককে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। ওই যুবকের নাম নিক। তিনি নগরীর কালীবাড়ী এলাকার মন্টু দাশের ছেলে।
একের পর হত্যাকাণ্ডে উদ্বিগ্ন নাগরিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। ধারাবাহিক হত্যা ও সহিংস ঘটনার প্রতিবাদে খুলনা মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিটি ওয়ার্ডে বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি পালন হচ্ছে। এছাড়া, আইনশৃখলা পরিস্থিতি অবনতির প্রতিবাদে গত শনিবার নগরীতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন আইন অধিকার বাস্তবায়ন ফোরাম। তার একদিন পরেই রবিবার দুটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটল। এর আগে, খুলনার আদালত চত্বর থেকে ককটেল সদৃশ বস্তু উদ্ধার করেছিল পুলিশ। গত ২০ নভেম্বর বিকেল ৪টার দিকে বস্তুটি পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে চরমপন্থিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল খুলনা। নতুন শতাব্দির শুরুতেও তা বহাল ছিল। বোমা মেরে অথবা গুলি করে মানুষ হত্যা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। চরমপন্থি সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ হারান সাংবাদিকসহ অসংখ্য মানুষ। পরবর্তীতে চারদলীয় জোট সরকার দক্ষিণাঞ্চলে সন্ত্রাস দমনে র্যাব গঠন করে। যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে শুরু হয় অপারেশন ক্লিনহাট, অপারেশন স্পাইডার ওয়েব। এসব অপারেশন অধিকাংশ চরমপন্থি সন্ত্রাসী নিহত ও অনেকে গ্রেপ্তার হন। ধীরে ধীরে শান্তি ফিরে আসে খুলনায়। খুলনার আইনশৃখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আবারো বিশেষ অভিযান শুরুর দাবি জানিয়েছেন নাগরিক নেতারা।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, “একের পর এক হত্যাকাণ্ড সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলছে। এ থেকে খুলনার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের দমনে পুলিশ প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে।”
খুলনায় আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি বিশেষ করে গতকাল রবিবার আদালত অঙ্গনে দিনে দুপুরে লোমহর্ষক জোড়া খুনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ হোসেন বাচ্চু এবং সদস্য সচিব শেখ নুরুল হাসান রুবা। আদালত অঙ্গনে নিরাপত্তা জোরদারসহ খুলনার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে পুলিশ প্রশাসন এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আরো কঠোর ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানান তারা।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, “বেশিরভাগ হত্যার কারণ উদ্ঘাটন করা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। রবিবার দুপুরে দুই হত্যার সঙ্গে জড়িতরাও দ্রুত গ্রেপ্তার হবেন।”
ঢাকা/নূরুজ্জামান/মাসুদ