বাংলাদেশে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের মামলায় যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য টিউলিপ সিদ্দিকের সাজা হওয়ার ঘটনা নিয়ে দেশটির মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোয় গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। বেশির ভাগ প্রতিবেদনের শিরোনামে লেখা হয়েছে, টিউলিপ সিদ্দিকের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের আদালতে বিচারে তাঁকে সাজা দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকায় এই সাজা ভোগ করার সম্ভাবনা কম বলেও উল্লেখ করা হয়েছে কয়েকটি প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশের আদালতে সাজা ঘোষণার পর টিউলিপ সিদ্দিক একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁর ওই বিবৃতিও তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে। একটি সংবাদমাধ্যম বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের বক্তব্যও তুলে ধরেছে।

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে শেখ রেহানার নামে ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দে অনিয়মের ঘটনায় হওয়া মামলায় আজ রায় দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। রায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাঁচ বছর, তাঁর বোন শেখ রেহানাকে সাত বছর এবং রেহানার মেয়ে টিউলিপকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি টিউলিপসহ তিন আসামিকেই এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত।

এ নিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি শিরোনাম করেছে ‘টিউলিপ সিদ্দিক এমপিকে বাংলাদেশে কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচারের পরে’। বাংলাদেশে তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচারে লেবার এমপি ও সাবেক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের দুই বছরের কারাদণ্ড হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে তাঁর পরিবারকে একটি প্লট দিতে খালা বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য টিউলিপকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন আদালত। এ অভিযোগ তিনি জোরালোভাবে অস্বীকার করেছেন।

বিবিসি বলেছে, লন্ডনে অবস্থানরত টিউলিপ সিদ্দিক তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন। তাঁকে এই সাজা ভোগ করতে হবে বলে মনে হয় না। এক বিবৃতিতে টিউলিপ এই বিচারপ্রক্রিয়াকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ‘ত্রুটিপূর্ণ ও প্রহসনের’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

টিউলিপের দল লেবার পার্টির একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, দলটি এ রায়কে স্বীকৃতি দিতে পারে না। তিনি বলেন, ‘খবরে জানা গেছে, অত্যন্ত সম্মানিত জ্যেষ্ঠ আইন বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে এই মামলায় টিউলিপ সিদ্দিক ন্যায়সংগত আইনি প্রক্রিয়ার সুযোগ পাননি এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিস্তারিত কখনোই তাঁকে জানানো হয়নি। তাঁর আইনি পরামর্শক দল বারবার বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলেও এটা করা হয়েছে। যে কারও বিরুদ্ধে যখন কোনো অভিযোগ আনা হয়, সব সময় তাঁর আইনি প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিতে হয়।’

বিবিসি বলছে, তারা বুঝতে পেরেছে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা দলীয় শৃঙ্খলাবিষয়ক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তিনি তাঁর লেবার পার্টির সদস্যপদ এবং হাউস অব কমন্সে হুইপের পদে বহাল থাকবেন।

বিবিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। বাংলাদেশ দেশটির কাছে একটি ‘২ বি কান্ট্রি’ হিসেবে বিবেচিত, অর্থাৎ তাঁকে প্রত্যর্পণের অনুমতি পেতে যুক্তরাজ্যের আইনজীবী ও বিচারকদের সামনে সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে।

‘বাংলাদেশের আদালত যুক্তরাজ্যের এমপি টিউলিপকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে তাঁর অনুপস্থিতি’ শিরোনামে প্রতিবেদন করেছে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে টিউলিপের পারিবারিক সম্পর্ক, নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরে সংঘটিত দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার দ্রুত করতে রাজনৈতিক ও জনমতের চাপ, গত বছর অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত মাসে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়া, আজকের রায় ঘোষণার পর টিউলিপের প্রতিক্রিয়া, লেবার পার্টির প্রতিক্রিয়া, এই মামলার বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সাবেক বিচারমন্ত্রীসহ একদল খ্যাতিমান আইনজীবীর উদ্বেগ প্রকাশসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচার চলাকালে প্রসিকিউটর খান মোহাম্মদ মাইনুল হাসান অভিযোগ করেছিলেন যে রাজধানীর উপকণ্ঠে পরিবারের সদস্যদের জন্য প্লট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে টিউলিপ সিদ্দিক শেখ হাসিনার দপ্তরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ফোন করেন ও মেসেজ পাঠান এবং তিনি সশরীর ঢাকা সফর করেন। তবে প্রসিকিউটররা ওই সব মেসেজের কোনো প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করেননি। তাঁরা বলেছেন, সে সময় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে দায়িত্ব পালন করা দুজন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে টিউলিপ সিদ্দিকের যোগাযোগের এসব তথ্য জানতে পেরেছেন।

যুক্তরাজ্যের আরেক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য ইনডিপেনডেন্ট শিরোনাম করেছে ‘বাংলাদেশে দুর্নীতির জন্য লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিককে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে’। বাংলাদেশে একাধিক মামলার আসামি হওয়ার পর টিউলিপ সিদ্দিকের গত জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার সরকারের ‘সিটি মিনিস্টারের’ পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

ইনডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনেও মামলার পূর্বাপর, টিউলিপের প্রতিক্রিয়াসহ এ বিষয়ে নানা তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আজ ঢাকার আদালত রায় ঘোষণার পর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর চিফ সেক্রেটারি ড্যারেন জোনসের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বিবিসি ব্রেকফাস্ট অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘এটা টিউলিপের ব্যক্তিগত বিষয়, যেটা নিয়ে তাঁকেই কথা বলতে হবে। তবে আমার জানাবোঝা মতে, বাংলাদেশে একটি বিচার হয়েছে, যার অংশ তিনি ছিলেন না। তিনি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিতর্কে যুক্ত হতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁকে তা করতে দেওয়া হয়নি। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে এটা আইনি পরিস্থিতির চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনা প্রতিটি অভিযোগ অস্বীকার করে যাচ্ছেন।’

ড্যারেন জোনস আরও বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত অপর একটি দেশ এবং একটি বিদেশি আদালত নিয়েছেন। আমি নিশ্চিত যে টিউলিপ পার্লামেন্টে তাঁর আসনের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে যাবেন।’

যুক্তরাজ্যের আরেক সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়েছে ‘বাংলাদেশে দুর্নীতির জন্য টিউলিপ সিদ্দিকের দুই বছরের কারাদণ্ড’। এর প্রতিক্রিয়ায় টিউলিপ বাংলাদেশের এই আদালতকে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ আখ্যায়িত করে রায়কে নাকচ করেছেন বলেও প্রতিবেদনে ফলাও করে প্রকাশ করেছে তারা।

প্রতিবেদনে এ মামলা ও রায়সংক্রান্ত নানা তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি বলা হয়েছে, টেলিগ্রাফ এমন সব নথিপত্র দেখেছে, যাতে টিউলিপ সিদ্দিকের বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল বলে মনে হয়েছে, যা তাঁর আগের দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অবশ্য যুক্তরাজ্যের এই এমপি বৃহস্পতিবার বলেছেন, তাঁকে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরার জন্য জাল–জালিয়াতি করে এসব কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে।

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনেও রায় নিয়ে টিউলিপ ছাড়াও লেবার পার্টি ও প্রধানমন্ত্রী চিফ সেক্রেটারির প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আদালতে আরও দুটি দুর্নীতি মামলার বিচার চলছে, যেগুলোয় টিউলিপের নাম রয়েছে। জানুয়ারির প্রথম দিকে এসব মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে বলে প্রসিকিউটররা আশা করছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর জ য র প র ট উল প স দ দ ক র ট উল প র সরক র র র জন য বল ছ ন মন ত র কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

সিঙ্গাপুরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্মার্টফোন ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞায় আরও কড়াকড়ি

সিঙ্গাপুরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আগামী জানুয়ারি থেকে স্মার্টফোন ও স্মার্টওয়াচের ব্যবহার আরও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। ডিজিটাল মাধ্যমে বিধিনিষেধের আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে এটা করা হচ্ছে। গত রোববার দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ ঘোষণা দিয়েছে।

বিশ্বের যেসব দেশের মানুষ ডিজিটাল মাধ্যমের সঙ্গে ব্যাপকভাবে যুক্ত, সিঙ্গাপুর তাদের অন্যতম। দেশটির বর্তমান আইন অনুযায়ী, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীদের ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। নতুন নিয়মে তা পাঠদানের সময়ের বাইরেও কার্যকর হবে। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে স্কুল প্রাঙ্গণে ঢোকার পর স্মার্টফোন ও স্মার্টওয়াচ লকার বা স্কুলব্যাগের মতো নির্দিষ্ট স্থানে রাখা শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক।

নতুন নিয়মের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মন্ত্রণালয় বলেছে, এমন একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা, যা শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বৃদ্ধি করবে, স্ক্রিন (স্মার্টফোন) ব্যবহারের স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলবে এবং সার্বিক সুস্থতা বাড়াবে। তারা আরও বলেছে, শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত স্ক্রিন ব্যবহার ঘুম, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ এবং পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

তবে মন্ত্রণালয় মনে করে, প্রয়োজনে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন ব্যবহার অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সম্প্রতি একই ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইউনেসকোর তথ্যমতে, বিশ্বের ৪০ শতাংশ শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুলে এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। আগামী সপ্তাহ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ১৬ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা চালু হবে। বিশ্বে এ ধরনের সিদ্ধান্ত এটাই প্রথম।

ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে স্কুলে স্মার্টফোন ব্যবহারের কড়াকড়ির কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। যেমন চীনের ঝেংঝৌ শহরের স্কুলে শিক্ষাগত কারণে শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন ব্যবহারের জন্য মা-বাবার লিখিত অনুমতি দরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ