নিপাহ ভাইরাস একটি জুনোটিক ডিজিজ, যা প্রাণীর দেহ থেকে মানবশরীরে সংক্রমিত হয়। গত ২৪ বছরে দেশে ৩৪৩ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ২৫৫ জন মারা গেছেন; যা মোট আক্রান্তের ৭১ শতাংশ। এর মধ্যে ৬২ শতাংশ পুরুষ, আর ৩৮ শতাংশ নারী। ৮৮ জন বেঁচে থাকলেও বিভিন্ন জটিলতায় ভুগেছেন। সবচেয়ে বেশি ৭১ জন শনাক্ত হয় ফরিদপুরে। এরপর রয়েছে রাজবাড়ীতে ৩৫, নওগাঁয় ৩২, লালমনিরহাটে ২৪, মানিকগঞ্জে ১৭, রংপুরে ১৬, মেহেরপুরে ১৩ জন। দেশের ৩৪টি জেলায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। তাই বর্তমানে বাংলাদেশকে এ রোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

নিপাহ একটি জুনোটিক ভাইরাস, অর্থাৎ প্রাণীর মাধ্যমে মানবদেহে আসে। প্রাণীর দ্বারা দূষিত খাবার বা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকেও ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ পান করলে শিশুও আক্রান্ত হতে পারে। নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় মূলত পশুপাখি বিশেষ করে বাদুড়ের মাধ্যমে। বাদুড় থেকে মানুষে এই রোগের সংক্রমণ হয়। বাংলাদেশে শীত মৌসুমে ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সাধারণত খেজুরের কাঁচা রস পানের মাধ্যমে এই ভাইরাস সংক্রমিত হয়। কারণ এই সময়টাতেই খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়। এমনকি রস খাওয়ার সময় বাদুড় মলমূত্র ত্যাগ করলে সেই রসে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। সেই বাদুড় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস পান করলে মানুষের ­ এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া বাদুড়ে খাওয়া ফলমূলের অংশ খেলেও রোগ ছড়াতে পারে।

নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ হলে কেউ কেউ উপসর্গহীন থাকতে পারে, কারও আবার শুধু সাধারণ জ্বর-কাশি দেখা দিতে পারে। তবে সবচেয়ে জটিল অবস্থা হলো যখন মস্তিষ্কে সংক্রমণ বা এনসেফালাইটিস দেখা দেয়। নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৫ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। তবে লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াও ৪৫ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় ভাইরাসটি শরীরের মধ্যে থাকতে পারে। শুরুতে প্রচণ্ড জ্বর, মাথা ও পেশিতে ব্যথা, খিচুনি, শ্বাসকষ্ট, কাশি, পেট ব্যথা, বমি ভাব, দুর্বলতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এ রোগে মস্তিষ্কে এনসেফালাইটিস জাতীয় ভয়াবহ প্রদাহ দেখা দেয় এবং এক পর্যায়ে রোগী প্রলাপ বকতে শুরু করে। ঘুমঘুম ভাব, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, খিচুনি এবং অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না হলে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আর যারা বেঁচে যায় তাদের অনেকেই স্মৃতি হারিয়ে ফেলে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না, এমনকি পঙ্গু হয়ে যেতে পারে চিরতরে।

এলাইজা টেস্ট, পিসিআর, সেল কালচার প্রভৃতি পরীক্ষার মাধ্যমে এ ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব। তবে এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসের কোনো ওষুধ নেই। রোগের লক্ষণ দেখা মাত্রই রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। প্রয়োজনে আইসিইউও লাগতে পারে। সাধারণত লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়, আক্রান্ত রোগীর দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থা করলে জীবন রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
এ কথা সত্য, শীতের সময়ে খেজুরের রস পান করা খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। খেজুরের কাঁচা রস কোনোভাবেই পান করা উচিত নয়। পান করতে হলে টগবগ করে ফুটিয়ে নিতে হবে। তবে খেজুরের রসের তৈরি গুড় ক্ষতিকর নয়। খেজুরের রসের রান্না করা পায়েস, পিঠাও নিরাপদ। গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহের হাঁড়ি ঢেকে রাখতে হবে। কোনোভাবেই যেন বাদুড়ের লালা, মলমূত্র খেজুরের রসের সঙ্গে মিশে না যায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ফলমূল পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে খেতে হবে। পাখি বা বাদুড়ে খাওয়া আংশিক ফল যেমন– আম, লিচু, জাম, জামরুল, গোলাপজাম, কাঁঠাল, ডেউয়া, পেঁপে, পেয়ারা, বরই ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো।
খেজুরের কাঁচা রস খেয়ে যে কোনো রোগী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্ট বা অজ্ঞান হলে দেরি না করে কাছের রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন। প্রয়োজনে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। তা ছাড়া নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া কোনো দেশ থেকে কেউ বাংলাদেশে এলে তাকে অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সর্বোপরি আতঙ্কিত না হয়ে সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে।

ডা.

এ বি এম আব্দুল্লাহ: ইমেরিটাস অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
 

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

ব্রেন ক্যানসারের যে ৭টি লক্ষণ আমরা সাধারণ ভেবে এড়িয়ে যাই

শুরুতে উদাহরণ হিসেবে যেসব লক্ষণের কথা জানলেন, ব্রেন ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগের শুরুতে একই রকম লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তবে সমস্যা হলো, এসব লক্ষণ আর সাধারণ মাথাব্যথা বা ক্লান্তির মধ্যে পার্থক্য বোঝা সত্যিই কঠিন।

দীর্ঘদিন ব্রেন ক্যানসার নিয়ে গবেষণা করছেন যুক্তরাজ্যের লরা স্ট্যান্ডেন। এই রোগে আক্রান্ত অনেক রোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে—রোগীরা নিজেরা প্রথম দিকে এসব উপসর্গকে গুরুত্ব দেননি।
এমনকি চিকিৎসকেরাও অনেক সময় ব্যাপারটা হালকাভাবে নিয়েছেন। ফলে রোগ শনাক্ত হতে দেরি হয়ে গেছে।

আর এই দেরি কিন্তু মারাত্মক। কারণ, ক্যানসার যত দেরিতে ধরা পড়ে, চিকিৎসাও তত জটিল ও কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।

আসল সমস্যা হলো মস্তিষ্কের ক্যানসারের উপসর্গ অনেকটা আমাদের দৈনন্দিন সমস্যার মতোই। ক্লান্তি, মানসিক চাপ, মাইগ্রেন, এমনকি মেনোপজের সময়ের সমস্যার সঙ্গেও এর মিল আছে।

আবার অনেক সাধারণ রোগের লক্ষণও প্রায় একই রকম। যেমন দুশ্চিন্তা, সাইনাসের সমস্যা বা দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা।

যখন লক্ষণগুলো অস্পষ্ট আর হালকা থাকে, তখন সেসব উপেক্ষা করা সহজ হয়ে যায়। নিজের মনেই নানা যুক্তি খুঁজে নিই আমরা। তাই অনেকে অপেক্ষা করেন আর ভাবেন, দেখা যাক, সমস্যাটা কত দূর গড়ায়।

অনেকে ব্রেন ক্যানসার হওয়ার দুই-তিন মাস আগে থেকেই লক্ষণ টের পান। কিন্তু সাধারণ সমস্যা ভেবে তা উড়িয়ে দেন। এতে সমস্যা আরও জটিল হয়ে যায়।

এবার জেনে নিই সেই ৭টি সমস্যা সম্পর্কে, যেসব আমরা সাধারণ সমস্যা ভেবে উপেক্ষা করি। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, এসব লক্ষণের মধ্যে একটা বা দুটো থাকলেই যে কারও ব্রেন ক্যানসার হয়েছে, তা কিন্তু নয়। তবে কোনো সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে থাকলে কিংবা একদম অস্বাভাবিক মনে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।

আরও পড়ুনরাতের এই অভ্যাসের কারণে মস্তিষ্ক যেভাবে দ্রুত বুড়িয়ে যায়১১ নভেম্বর ২০২৪১. কথা খুঁজে না পাওয়া

অনেকে হঠাৎ করে নির্দিষ্ট শব্দ মনে করতে পারেন না। পুরো বাক্য বলতে গেলে আটকে যান। কথোপকথনে অংশ নিতে গেলে একটু দেরি হয়।

শব্দ খুঁজে না পাওয়ার সমস্যা অবশ্য ক্লান্তি, মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তার কারণেও হতে পারে। কিন্তু যদি এই সমস্যা দীর্ঘদিন থাকে, কিংবা হঠাৎ করে শুরু হয়, তাহলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার।

২. মানসিক ধোঁয়াশা

অনেকের মনে হয়, যেন মাথার ভেতর কুয়াশা জমে আছে। মনোযোগ দিতে পারছেন না, পরিষ্কার করে ভাবতে পারছেন না, কিছু মনে থাকছে না। ফলে রোগ ধরা পড়তে আরও দেরি হয়ে যায়।

এই মাথার ঘোলাটে ভাব অবশ্য অনেক কারণেই হতে পারে। মেনোপজ, ঠিকমতো ঘুম না হওয়া কিংবা মানসিক চাপ। কিন্তু যদি এই ঘোলাটে ভাবের সঙ্গে আরও কিছু স্নায়বিক সমস্যা দেখা দেয়, যেমন কথা বলতে বা দেখতে সমস্যা হয়, তাহলে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে।

দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তনও ব্রেন ক্যানসারের একটি প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ব্রেন ক্যানসারের যে ৭টি লক্ষণ আমরা সাধারণ ভেবে এড়িয়ে যাই