ওষুধে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট বাড়িয়েছে সরকার। একই নীতিতে ভ্যাট বাড়তে পারে বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামেও। একই সঙ্গে বেড়েছে ডলারের দাম। এতে আরেক দফা বাড়তে পারে চিকিৎসা ব্যয়। তবে ঔষধ প্রশাসন বলছে, রোগীর ওপর চাপ পড়ে, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। স্বল্প মূল্যে নিরাপদ ও টেকসই চিকিৎসা সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে চায় সংস্থাটি। এমন পরিস্থিতিতে এসব পণ্যের দর পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

গতকাল সোমবার সকালে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে মহাপরিচালক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং অফথালমিক প্রোডাক্টস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ব্যবসায়ীরা হার্টের স্টেন্ট (রিং), চোখের লেন্সসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম পুনর্বিবেচনার দাবি জানান। নতুন করে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট বাড়ানোর আশঙ্কা থেকে এমন দাবি তাদের। এ ছাড়া অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ২ দশমিক ৪ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে ওষুধের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। 

এদিকে গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অংশীজনের সঙ্গে আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা বৈঠকের পরও দাম নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারেনি সরকার। দু-এক দিনের মধ্যে আবার বৈঠক হতে পারে বলে জানা গেছে।

বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা.

সায়েদুর রহমান বলেন, অনেক দিন আগে অত্যাবশকীয় ১৭১টি ওষুধের তালিকা করা হয়েছিল। এসব ওষুধের দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। যাতে ৯০ ভাগ মানুষের অসুখ হলে এগুলো ভূমিকা রাখতে পারত। তবে পরবর্তী সময়ে সেটি নানাভাবে সংযোজন হয়েছে। এটাকে হালনাগাদ করে ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা আমাদের মূল লক্ষ্য। 
ঔষধ প্রশাসনের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর ২১টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ৪৪ ধরনের কার্ডিয়াক স্টেন্টের (হার্টের রিং) দাম ২ হাজার থেকে ৫৬ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিয়ে নির্ধারণ করেছিল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ১৪ ডিসেম্বর ১২ দেশের ১২৯ ধরনের লেন্সের দাম নির্ধারণ করেছিল অধিদপ্তর। এর পর থেকে নির্ধারিত দামেই হার্টের রিং ও লেন্স হাসপাতালগুলোকে সরবরাহ করতে হচ্ছে আমদানিকারকদের।

এখন তারা বলছে, হার্টের রিং, চোখের লেন্সসহ অধিকাংশ মেডিকেল ডিভাইস আমদানি করতে হয়। সরকার-নির্ধারিত দরে এগুলো বিক্রি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে মানহীন সরঞ্জাম অবৈধ পথে বাজারে আসছে। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগীরা। 

মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) ওয়াসিম আহমেদ বলেন,  চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিতে নিবন্ধন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা দূর করা। সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ার সহজীকরণ, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এমআরপিতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং ডলারের মূল্য অনুযায়ী দাম সমন্বয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ভ্যাট নিয়ে কথা বলেছি। বর্তমানে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এখন যদি সেটি বেড়ে যায়, তাহলে তো আমাদের দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলেছে, মূল্য না বাড়ানোর ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে।

এ বিষয়ে অফথালমিক প্রোডাক্টস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি আমানউল্লাহ বাদল বলেন, আমাদের দাবি প্রোডাক্টের দাম বাড়ানো নয়, ডলারের দামের সঙ্গে সমন্বয় করা। এসব চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম নির্ধারণ করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। মূল্য না বাড়ালে আমাদের পক্ষে ব্যবসা করা কঠিন হবে।
তিনি আরও বলেন, ভ্যাট প্রাইসের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। এর আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মূল্যের সঙ্গে ভ্যাট যুক্ত করার কথা বলেছিল, সেসব নথি আমরা ঔষধ প্রশাসনে দিয়েছি। ভ্যাট বাড়লে কার্ডিয়াক স্টেন্ট, লেন্সের দাম বাড়াতে হবে– এতে রোগীর খরচ বাড়বে। ডলারের মূল্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ১১০ টাকা ধরে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সরকারিভাবে ডলারের মূল্য ১২০; কিন্তু ব্যাংক ১২৫-১২৭ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। ডলারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে মূল্য পুনর্বিবেচনার দাবি জানাই।

এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ড. আকতার হোসেন বলেন, ডলারের মূল্য ও কর বাড়ার কারণে চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীরা যে প্রস্তাবনা দিয়েছেন, তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। মন্ত্রণালয় সে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে রোগীর ওপর চাপ পড়বে– এমন কোনো কিছুই করা হবে না। ওষুধে সরকারের সিদ্ধান্তে কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করা হয়েছে, কোম্পানি থেকে দর কষাকষি করে স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা সরঞ্জামগুলো আমদানি করতে। একই সঙ্গে নিবন্ধনহীন কোম্পানি বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শামীম হায়দার সমকালকে বলেন, রোগীর ওপর চাপ পড়ে, এমন কোনো সিদ্ধান্ত অধিদপ্তর নেবে না। জনসাধারণ যাতে নিরাপদ ও টেকসই চিকিৎসা সরঞ্জাম পেতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের। 

এ সময় ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান আবদুল মুক্তাদির বলেন, দেশে বর্তমানে ওষুধের বাজার ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে যত কম টাকায় ওষুধ পাই, পৃথিবীর আর কোথাও নেই।  বিদ্যুৎ, কর্মীদের বেতনসহ প্রতিটিতে খরচ বেড়েছে। ডলারের মূল্যও বেড়েছে। তাই দাম বাড়ানো ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই।


 

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

গান-কবিতায় ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের মুক্তমঞ্চ গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ

ময়মনসিংহ নগরের জয়নুল আবেদিন উদ্যান এলাকায় সাহিত্য সংসদের মুক্তমঞ্চ গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছেন লেখক, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে দুই ঘণ্টা ব্যাপি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিচে গান, কবিতা ও কথায় এ কর্মসূচি পালিত হয়।

প্রায় চার দশক আগে প্রতিষ্ঠিত ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের মুক্তমঞ্চ গতকাল বুধবার দুপুরে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালায়।

এর প্রতিবাদে আজ ‘ময়মনসিংহের সচেতন নাগরিক ও শিল্পী সমাজ’–এর ব্যানারে প্রতিবাদ জানানো হয়। বেলা ১১টার দিকে প্রতিবাদী কর্মসূচি শুরু হয়। এ সময় পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একটি দল এসে মাইকবিহীন কর্মসূচি করতে বলেন আন্দোলনকর্মীদের। কিন্তু প্রতিবাদী কর্মসূচি চলতে থাকে, দাঁড়িয়ে থাকে ডিবি পুলিশের দল। প্রতিবাদী কথা, গান ও কবিতা পড়তে থাকেন কবি ও সংস্কৃতিকর্মীরা। আগামীকাল শুক্রবার সকাল ১০টার মধ্যে সাহিত্য সংসদের মুক্তমঞ্চ পুনর্নির্মাণের দাবি জানান তাঁরা।

বীক্ষণ আসরের প্রথম আহ্বায়ক কথাশিল্পী সালিম হাসান বলেন, ‘ফ্যাসিস্টের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে মানুষের কথা বলার মঞ্চ গুঁড়িয়ে দেওয়া। বিগত সরকার আমলে দীর্ঘ সময় আমাদের বুকে জগদ্দল পাথর চাপিয়ে আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু নতুন বাংলাদেশে গতকাল প্রশাসনের ভূমিকা আমাদের আশাহত করেছে এবং প্রতিবাদে উজ্জীবিত করেছে। দম্ভের কারণে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু বর্তমান প্রশাসনে যাঁরা আছেন, তাঁরাও দাম্ভিকতা দেখালে পরিণাম ভালো হবে না।’

প্রতিবাদী কথার ফাঁকে ফাঁকে চলে প্রতিবাদী গান। শিল্পী হিরক সিঙ্গার, মিজান বাউলা, শাহনাজ সাথী বিদ্রোহী গান পরিবেশন করেন। কবি সাঈদ ইসলামের সঞ্চালনায় কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন কবি শামসুল ফয়েজ, নাফিসা মাহজাবিন, কামরুল হাসান ও শরৎ সেলিম, সংস্কৃতিকর্মী মাহমুদুল হাসান, সংগীতশিল্পী অঞ্জনা সরকার, আবুল কালাম আল আজাদ, চিত্রশিল্পী হোসাইন ফারুক, নাগরিক নেতা তৌহিদুজ্জামান ছোটন, আন্দোলনকর্মী আরিফুল হাসান, আজিত দাস, আবদুল্লাহ আল নাকীব প্রমুখ।

আশরাফ মীর বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে বিনা নোটিশে আমাদের মুক্তমঞ্চ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যা আমারের অন্তরে আঘাত দিয়েছে। কেন মুক্তমঞ্চ বিনা নোটিশে ভেঙে দেওয়া হলো? যার ইঙ্গিতে এই মুক্তমঞ্চ ভেঙে দেওয়া হলো, তিনি অনুতপ্ত হবেন এবং মঞ্চটি পুনরায় নির্মাণ করে দেবেন, এই আশা করি। আমরা জীবন ও বেদনার কথা বলি কবিতায়। আমরা শান্তি চাই, কোনো বিশৃঙ্খলা চাই না।’

স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা জানান, ১৯৮০ সালের ২১ মে ময়মনসিংহে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের সমন্বয়ে সাহিত্য সংসদ গঠিত হয়। ১৯৮৩ সাল থেকে নিয়মিত পাঠচক্র বীক্ষণ আসর শুরু হয়। আগামীকাল শুক্রবার ছিল বীক্ষণের ২১৪৬তম আসর। শুরু থেকে বিরতিহীন প্রতি শুক্রবার আসরটি বসে, যা বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘতম পাঠচক্রের আসর। একটি মুক্তমঞ্চে কবি-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিকর্মীরা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কবিতা, গান, আলোচনা করে থাকেন। দেশের বিখ্যাত কবি–সাহিত্যিক এখানের মুক্তমঞ্চে সাহিত্যায়োজনে কবিতা পড়েছেন, সাহিত্য আলোচনা করে গেছেন।

পুনরায় মুক্তমঞ্চ নির্মাণের দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেন সাঈদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগামীকাল গুঁড়িয়ে দেওয়া মঞ্চের সামনে বীক্ষণের নিয়মিত আসর পালন করা হবে। এরপর শনি ও রোববার প্রশাসনকে সময় বেঁধে দেওয়া হবে। এ সময়ের মধ্যে বিষয়টি সমাধান না করলে সোমবার ময়মনসিংহসহ সারা দেশে কর্মসূচি দেওয়া হবে।’

সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি ফরিদ আহমদ দুলাল প্রথম আলোকে বলেন, নগরের জয়নাল আবেদিন উদ্যান এলাকায় ১৯৯৩ সালের দিকে তৎকালীন জেলা প্রশাসন সাড়ে ৬ শতক জমি সাহিত্য সংসদকে বরাদ্দ দেয়। সেই জমিতেই প্রশাসনই মুক্তমঞ্চের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। এখন সেই মুক্তমঞ্চ ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের সচিব সুমনা আল মজিদ গতকাল জানিয়েছিলেন, ‘কাগজপত্রে সাহিত্য সংসদ বলতে সেখানে কিছু নেই। অবৈধভাবে কোনো জায়গা দখল করলে তো হবে না। সাহিত্য সংসদ আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা অন্য জায়গায় ব্যবস্থা করে দেব।’

আরও পড়ুনময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের মুক্তমঞ্চ গুঁড়িয়ে দিল প্রশাসন, সংস্কৃতিকর্মীদের প্রতিবাদ১৫ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ